‘দুর্নীতির বিস্তৃতি ঘটেছে’
ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেনন রাজনীতির ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধসহ সব আন্দোলন-সংগ্রামের সামনের সারির একজন। বর্তমানে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি। ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য। জোট সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে রাশেদ খান মেনন কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।
দ্য ডেইলি স্টার: আওয়ামী লীগ সরকার বা ১৪ দলীয় জোট সরকার তো পরপর তিনবার ক্ষমতায়। বর্তমানে যে রাজনীতি এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট, একজন রাজনীতিবিদ ও ১৪ দলের একজন হিসেবে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
রাশেদ খান মেনন: দেশে যে উন্নয়ন ও অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল, গত ১৫ বছরে তার অভাবনীয় সফলতা এসেছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থাও বিরাজ করছে। যদিও এদেশের রাজনীতিতে দুই দলের, বিশেষ করে দুই পক্ষের যে দ্বন্দ্ব সেটা খুবই প্রকট। তারপরও এক ধরনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এই উন্নয়নের সঙ্গে যে প্রশ্নটি এসেছে সেটা হলো— ১৪ দলের মূল কথা ছিল দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অর্থায়ন ও রাজনীতি থেকে দেশকে মুক্ত করা। কিন্তু, এখন দেখা যাচ্ছে দুর্নীতির বিস্তৃতি ঘটেছে। খুব দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই বিষয়গুলোতে সরকার জিরো টলারেন্স ঘোষণা করায় মধ্যস্তরের কিছু দুর্নীতিবাজ ধরা পড়লেও সমাজের সর্বস্তরের চিত্রটাই এক। আর রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন যেটা ঘটেছিল, তারও অবসান হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি কিছুটা হলেও এর প্রকোপ বেড়েছে। যদিও অতীতের তুলনায়, সামরিক শাসনামলের তুলনায় অথবা বিএনপি-জামায়াত আমলের তুলনায় অনেক কম।
ডেইলি স্টার: আপনি বলছেন, দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। কিন্তু, আরেকটি আলোচনা বা প্রশ্নও আছে— দেশে কি আদৌ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আছে? বিরোধী দলকে কোনো কিছু করতে দেওয়া হয় না, কথা বলতে দেওয়া হয় না, গুম-খুনের প্রশ্ন আছে।
মেনন: বিরোধী দলকে কিছু করতে দেওয়া হয় না এই অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি বিরোধী দল কিছু করতে পারে না সেই অভিযোগও আছে। এর চেয়ে কঠিন অবস্থার মধ্যে থেকেও তো আমরা লড়াই করেছি। আইয়ুব খানের শাসনামলে লড়াই করেছি, ৭৫ পরবর্তীকালে প্রায় দেড় দশক ধরে আমরা লড়াই করেছি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে অপারেশন ক্লিন হার্টের মতো ঘটনায় বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন, বহু মানুষের অঙ্গহানি হয়েছে। তার মধ্যেও লড়াইটা তো কেউ থামিয়ে রাখেনি। গণতান্ত্রিক চেতনার যে পুনরাবৃত্তি, সেখান থেকে লড়াইটা কেউ থামিয়ে রাখেনি। সুতরাং, গণতন্ত্র নেই বলে চিৎকার-কান্নাকাটি করে তো লাভ নেই।
ডেইলি স্টার: আপনি যে ইতিহাসের কথা বললেন, সেটা সত্য ইতিহাস। অনেক প্রতিকূলতার মাঝে আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশের জন্ম। আগেও নিপীড়ন ছিল, কিন্তু এভাবে গুলি করে হত্যা বা গুম করার ব্যাপার ছিল না বলে বিরোধী দল এখন অভিযোগ করে।
মেনন: আমি এটাকে এভাবে বলব না। হ্যাঁ, এটা গা-সহনীয় হয়ে গেছে। কিন্তু, আমি যদি দেখি, ক্রসফায়ারের জন্মই তো হয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে। র্যাব দিয়ে বিএনপি শুরু করল ক্রসফায়ার। তার আগে অপারেশন ক্লিন হার্ট। সেসময়ও যে গুম-খুন হয়নি, ব্যাপারটা সেরকম না। তবে, দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এর অবসান হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি। বরং এখন বলা হয় আত্মরক্ষার্থে বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আমরা সবাই প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিলাম, এই ক্রসফায়ারের রাজনীতি আমরা দূর করব। এটা আমরা দূর করতে পারিনি। এই ব্যর্থতা অবশ্যই আমাদের আছে।
ডেইলি স্টার: হেফাজতে ইসলামকে আবার রাজনীতির মাঠে দেখা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বানানোর পরিপ্রেক্ষিতে হেফাজতের বক্তব্য ‘ভাস্কর্য বানানো যাবে না, বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে’ এবং আওয়ামী লীগ নেতা-মন্ত্রীদের বক্তব্য ‘ভাস্কর্য আর মূর্তি এক না’— এই যে রাজনীতি, আপনার বিশ্লেষণ কী?
মেনন: এটা শুধু বঙ্গবন্ধু বা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিষয় নয়। এর সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে একটা রাজনীতি আছে। সেই রাজনীতি হচ্ছে বাংলাদেশকে একটি মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। হেফাজতের মমিনুল হক সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধুকে মানি, কিন্তু ভাস্কর্য মানি না। যখন আমরা নৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করতে পারব, তখন সমস্ত ভাস্কর্য টেনে-হিঁচড়ে নদীতে ভাসিয়ে দেবো।’
মমিনুল হকের প্রয়াত পিতা মাওলানা আজিজুল হক ১৯৯৭ সালে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের শিখা চিরন্তন বিষয়ে বলেছিলেন, ‘ক্যান্টনমেন্টে অস্ত্র নিয়ে মিলিটারি পাহারা দেয়। ওইখানে যাইতে হইলে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়া যাইতে হইব। আমরা সেই প্রস্তুতি নিতাছি।’ তার এই সাক্ষাৎকার আপনিই নিয়েছিলেন এবং ১৯৯৭ সালে বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে তাদের অবস্থান যে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে এবং পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, সেই সাক্ষাৎকারে তিনি তাও বলেছিলেন। আজিজুল হক বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালে আমগো অবস্থান ছিল নিরপেক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে।’ এই বক্তব্যের সঙ্গে তার ছেলে মামুনুল হকের বক্তব্যের ধারাবাহিকতা রয়েছে।
বাবুনগরী বলেছেন, ‘এই সরকার থাকুক। কিন্তু, থাকতে হবে আমাদের শর্ত ও দাবি মেনে নিয়ে।’ তাদের শর্ত বা দাবি হলো, নারীনীতি বাদ দিতে হবে, শিক্ষানীতি বাদ দিতে হবে। তাদের বিষয়ে কোনো কথা বলা যাবে না, যাকে খুশি তাকে তারা মুরতাদ ঘোষণা করতে পারবে।
লালনের ভাস্কর্য বা হাইকোর্টের সামনের ভাস্কর্যের সময় তারা একইভাবে হইচই শুরু করেছিল। সরকার তাদের সঙ্গে আপস করেছিল।
ডেইলি স্টার: তখন তো আপনি নিজেও সরাসরি সরকারের অংশ, মন্ত্রী ছিলেন।
মেনন: আমি তখন মন্ত্রী থেকে বলেছিলাম, এটা আমাদের একটা নৈতিক পরাজয়। তখন প্রধানমন্ত্রী আমাকে এবং হাসানুল হক ইনুকে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, মন্ত্রী থেকে একথা বলেন কীভাবে? পদত্যাগ করে বলতে পারেন।
আজিজুল হক, বাবুনগরী, মামুনুল হকরা কখনো তাদের অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসেনি। সরকার বারবার পিছিয়েছে।
ডেইলি স্টার: সরকারের মন্ত্রী-নেতারা এখন যে বলছেন ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়, এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মেনন: গত ৩০ নভেম্বর ১৪ দলের মিটিংয়ে বলেছি, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় হেফাজত যখন মাঠে নেমে গেল, তখন হয়তো প্রধানমন্ত্রী একটি কৌশল নিয়েছিলেন। কিন্তু, কৌশল যখন নীতিকে ছাপিয়ে যায়, সেটা তো বিপদ ডেকে আনে।
বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যখন ধর্ম-বিরোধিতার অভিযোগ আনা হয়েছিল, তখন সংসদে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার করে বলেছিলেন, ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। মুজিব বর্ষে আমরা পদে পদে আপস করছি। আর কোনোটাই আমার কাছে কাকতালীয় মনে হয় না। সংসদে বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণ বাজানো হলো, সেখানে দেখা গেল ধর্মনিরপেক্ষতার অংশটুকু বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ এর দায়-দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না।
১৪ দলের মিটিংয়ে বলেছি, নতুন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান ঘটানোর একটা চেষ্টা চলছে।
ডেইলি স্টার: ১৪ দল কি আদৌ সক্রিয় আছে? ১৪ দলের কী কার্যক্রম আছে?
মেনন: ১৪ দলের জন্মটা হয়েছে আন্দোলনের মধ্যে। নির্বাচন হওয়ার পরে দেখলাম ১৪ দলের কর্মকাণ্ড কমে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে বা বিএনপি-জামায়াত যখন অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করল তখন আবার কাজ করেছে। কিন্তু, সম্প্রতি ১৪ দলের কার্যক্রম একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে এবং সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হচ্ছে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে এর কোনো কার্যক্রম নেই। আগে তবুও সরকার বলত যে এটা জোট সরকার বা মহাজোট সরকার বা ১৪ দলীয় সরকার। এখন কিন্তু সেটা বলে না। এখন বলে আওয়ামী লীগ সরকার। কিছুদিন আগেও একটি অনুষ্ঠানে আমি এই কথা বলেছি।
ডেইলি স্টার: আপনি তো সারা জীবন আদর্শিক রাজনীতি করেছেন। যে সমাজের কথা বলেছেন, যে সংগ্রাম করেছেন সেই জায়গা থেকে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বা ২০১৮ সালের নির্বাচনে এমপি হওয়া কি আপনার আত্মমর্যাদা বোধে সমস্যা তৈরি করে না?
মেনন: নিশ্চয়ই। আমি এ প্রশ্ন করেছি। যদি আমার সংসদের বক্তব্যগুলো দেখেন সেখানে আমি বলেছি, নির্বাচন নিয়ে মানুষ ক্রমাগত আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। শুধু তাই না, মানুষ ভোটের অধিকার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। বাজেট বক্তব্যে, রাষ্ট্রপতির ভাষণের ধন্যবাদ বক্তব্যসহ বিভিন্ন সময় আমি এসব বলেছি। তার জন্য সমালোচিতও হয়েছি। কিন্তু, নির্বাচন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যে মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে, এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা যে লড়াই করেছি পাকিস্তান আমলে, বাংলাদেশ আমলে, সেই অবস্থান থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গেছি।
ডেইলি স্টার: আপনাদের জোটের একটি স্লোগান ছিল, ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বা লড়াই। সেখান থেকে ‘ভোট’ শব্দটি একদম বাদ দিয়ে, জনগণ ছাড়া ভোট, দিনের ভোট রাতে দেওয়ার মতো যে অভিযোগ উঠছে, সেখানে একটি রাষ্ট্র চলে গেল কেন? আপনারা তো ক্ষমতার সঙ্গে বা রাজনীতির সঙ্গেই থাকলেন।
মেনন: যখন কোনো প্রতিরোধ থাকে না, যখন কোনো সংগ্রাম-আন্দোলন থাকে না, তখন এটা হয়। আইয়ুব খানের প্রথম আমলে আমরা দেখেছি বেসিক ডেমোক্রেসির নির্বাচনে তারা সানন্দেই পাঁচ বছর সরকার চালিয়েছে। এরশাদের আমলেও আমরা দেখেছি ৮৬’র নির্বাচন, ৮৮’র নির্বাচন। আবার তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হয়েছে। আমি মুখে বলব জনগণের ভোটের অধিকার, কিন্তু সেই অধিকার বাস্তবায়নের জন্য আমার যে লড়াই-সংগ্রাম করা দরকার সেটা না করে অভিযোগ করব, তা হয় না। এটা তো অক্ষমের আর্তনাদ ছাড়া আর কিছু হচ্ছে না। আমি খুব স্পষ্টতই মনে করি ভোটের অধিকার যদি প্রয়োগ করা না যায়, তাহলে গণতন্ত্র বিপন্ন হয় এবং আমাদের দেশে সেই অবস্থাটা বিরাজ করছে। এটা ফিরিয়ে আনার জন্য কী প্রয়োজন, সেটা আলোচনা করা দরকার। ১৪ দলের আলোচনায় এ প্রশ্নটা আমরা তুলেছি।
ডেইলি স্টার: আমরা আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসির কথা ইতিহাস থেকে জানি, জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের এবং নির্বাচনের কথাও জানি, হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের আমলের নির্বাচনের কথাও আমরা বলছি। আইয়ুব খান, জিয়াউর রহমান বা হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের সময়ের যে নির্বাচন, আওয়ামী লীগও কি সেই নীতি অনুসরণ করে সেই দিকে চলে গেল?
মেনন: আমি আমার গত নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কথা বলি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমার প্রতিপক্ষ ছিলেন একজন জাঁদরেল বিএনপি নেতা। আমি তাকে প্রচারেই পেলাম না। আমি তাকে পোলিং বুথেই পেলাম না। তার কোনো কর্মীও পেলাম না। তখন স্বাভাবিকভাবেই এই নির্বাচন যে একপক্ষীয় হয়ে যাবে এবং এই নির্বাচন যে কলুষিত হবে, সেটা না বোঝার তো কোনো কারণ নেই।
ডেইলি স্টার: ধরেন, বিএনপি বা বিরোধী দল তাদের কাজ সঠিকভাবে করল না। তারা প্রার্থী, পোলিং এজেন্ট দিতে পারল না, কর্মী নিয়োগ দিতে পারল না, সভা-সমাবেশ করল না বা করতে পারল না। কিন্তু, সেই কারণে কী দিনের ভোট রাতে হয়ে যাবে?
মেনন: না, আমি সেটা মানি না। আমি সংসদে একথা বলেছি যে এই ধরনের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রযন্ত্র যখন অতি উৎসাহী হয়ে যায়, তখন তা সমস্ত ব্যবস্থাটিকেই ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। নির্বাচন কমিশনের কথাই ধরেন। তারা দিনের বেলা চোখ বুজে ঘুমাচ্ছে। হয়তো বলবেন নির্বাচন কমিশন ইচ্ছাকৃতভাবে এভাবে গঠন করা হয়েছে। কিন্তু, সব সরকারের আমলেই তো নির্বাচন কমিশন এভাবেই করা হয়। সেই নির্বাচন কমিশন যদি প্রতিক্রিয়া না দেখায়, তাহলে নির্বাচন তো দুষ্টু হবেই।
ডেইলি স্টার: যখন আপনি এমপি হচ্ছেন, তখন এই নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম মেনে নিচ্ছেন। যখন আপনি মন্ত্রী থাকছেন, তখনো আপনি এটা নিয়ে সেই অর্থে কথা বলছেন না বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু, এখন আপনি কথা বললে বিষয়টি কেমন হয়?
মেনন: আমি যখন মন্ত্রী ছিলাম তখনো বলেছি, সংসদে ২০১৮ সালের পরে দাঁড়িয়েও বলেছি। আমি নির্বাচন কমিশনে গিয়েও বলেছি। এখন আমি একক চিৎকার করে তো লাভ হবে না। সকল গণতান্ত্রিক শক্তি, সামাজিক শক্তি, বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিকে এক হতে হবে।
ডেইলি স্টার: এই এক হওয়ার ক্ষেত্রে যারা বিরোধী রাজনৈতিক দলে আছেন তাদেরই ভূমিকা, নাকি সরকারে যারা আছেন তাদেরও ভূমিকা থাকা দরকার?
মেনন: দুদিকেরই ভূমিকা থাকা দরকার।
ডেইলি স্টার: এখনকার চিত্রটা কেমন?
মেনন: এখনকার চিত্র হয়ে গেছে একপাক্ষিক। যদি আমি এককভাবে অবস্থান করি, তাহলে তো আমার ইচ্ছেরই প্রতিফলন হবে।
ডেইলি স্টার: আপনার রাজনীতির জায়গাতে আসি। আপনারা যে আদর্শের রাজনীতির কথা বলেছেন, বলছেন, বলেন আর সরকার যে ধরনের ব্যবস্থাপনায় চলছে এবং আপনারা এমপি হয়েছেন, সেখান থেকে এই প্রশ্ন কি করা যায় না যে, আপনারা আপনাদের নীতির সঙ্গে অনেকটাই আপস করে ফেলেছেন?
মেনন: যখন আমাদের কাজকে বিচার করবেন, ১৪ দলের আন্দোলন-সংগ্রামসহ সামগ্রিকভাবে করতে হবে। আপনারা যদি লক্ষ্য করে দেখেন, এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরে আমাকে মন্ত্রিত্বের আহ্বান জানানো হয়েছিল। আমি কিন্তু গ্রহণ করিনি। আবার যখন বিএনপি-জামায়াত অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করল এবং দেশজুড়ে যুদ্ধাপরাধীদের তাণ্ডব চলল, নির্বাচনকালীন সরকারে আমি প্রথম যোগ দেই। কিন্তু, কোনো সময়েই আমি আপস করিনি, হয়তো কণ্ঠ স্তিমিত হয়েছে। অনেক সময় অনেক বাস্তবতার কারণে কণ্ঠ স্তিমিত হয়েছে। কিন্তু, এর দ্বারা আমরা আমাদের আদর্শকে বিসর্জন দিয়েছি বলে আমরা মনে করি না। আমরা আমাদের সর্বশেষ কংগ্রেসের রিপোর্টেও বলেছি, সব কিছুর পরেও এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে সন্ত্রাস ও মৌলবাদের যে অবস্থান সেটি বিদ্যমান রয়েছে এবং আমাদের এই লড়াইকে আরও জোরেশোরে এগিয়ে নিতে হবে। জনস্বাস্থ্যের ডাক্তার প্রজ্ঞাপন দিয়ে বলে দেন যে গোড়ালির উপরে প্যান্ট পরতে হবে, বোরকা পরতে হবে। তার মানে এই ভাবনাটা প্রবলভাবে বিদ্যমান রয়েছে বাংলাদেশে।
ডেইলি স্টার: এই যে একজন সরকারি কর্মকর্তা এমন প্রজ্ঞাপন দেন, তার ওপর আপনাদের সঙ্গে হেফাজতের আপসের প্রভাব আছে কি?
মেনন: আমাদের সঙ্গে নয়, বলতে পারেন সরকারের সঙ্গে হেফাজতের আপস হয়েছে।
ডেইলি স্টার: আপনারা তো সরকারের থেকে বিচ্ছিন্ন না।
মেনন: দুটো এক না। কারণ, আমরা এ বিষয়ে সমালোচনা করেছি। সরকার কী প্রয়োজনে এটা করেছে সেটা সরকারের কৌশল। এই কৌশলকে আমি সঠিক কৌশল বলে মনে করি না। এটা অতীতেও বলেছি। যখন জামায়াতের সঙ্গে গেল, তখনো বলেছি। এটা নিয়ে সংসদে কথা বলায় হেফাজতের তরফ থেকে, মাওলানা শফির তরফ থেকে মিছিল করা হয়েছে এবং আমাকে ফাঁসি দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে।
ডেইলি স্টার: আপনি যখন জোট সরকার বা আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেন, সেই সময়েও দুর্নীতি হয়েছে, অর্থপাচার হয়েছে, আর্থিক খাতের ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে, চুরি হয়েছে, লুটপাট হয়েছে। এসবের দায়ভার থেকে আপনারা বা আপনি কীভাবে মুক্ত থাকবেন?
মেনন: আমি তো বলছি না যে আমি এর দায়ভার মুক্ত। আমি যদি মাঠে খেলতে নামি, গায়ে কাঁদা তো লাগবেই। সেই কর্দমাক্ত মাঠকে পরিষ্কার করার দায়িত্ব আমার। সেই দায়িত্ব সব রাজনীতিবিদদের। আমরা সেটা করতে পারিনি। কিন্তু, আমরা দায়কে অস্বীকার করি না। আমরা সবাই মিলে এর জন্য দায়ী। আমরা সবাই এর সঙ্গে আপস করেছি বা প্রকারান্তে অনুমোদন করেছি। শুধু রাজনীতিবিদ হিসেবে না, একজন নাগরিক হিসেবেও আমার দায়ভার থাকে।
ডেইলি স্টার: সেক্ষেত্রে আবারও অভিযোগ আসে, একজন টাকনুর উপরে প্যান্ট পরার প্রজ্ঞাপন দিচ্ছেন, একজনকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, ধর্ষণের বিস্তার ঘটেছে। বেগমগঞ্জে যে ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছে তার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামে গ্রামে এক ধরনের মাস্তানতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে রাজনৈতিক আশ্রয়ে। সমাজ ব্যবস্থায় এই যে ঘটনা ঘটে গেল, এর কারণ কী?
মেনন: এটা তো একদিনে হয়নি। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সামাজিক পরিণতি হিসেবে এগুলো হয়েছে। ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত থেকে তারা নানা রকমের সুবিধা পায়। সব সময়েই আমরা এটা দেখে আসছি। যারা দুর্বৃত্ত তারা সব সময়ই ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করে।
তবে, আমি মনে করি একটি বার্তা যাচ্ছে সমাজে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কথা বলছেন এসব বিষয় নিয়ে। তবে, তার সেই কথাগুলো সমাজের নিচের দিকে পৌঁছায় কি না, সেটা চিন্তার বিষয়। ক্ষমতার বাইরে যে বলয় তৈরি হয়, তার কথা মেনেই চলতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। আর যাই হোক, এখন বিষয়গুলো সামনে আসছে।
ডেইলি স্টার: যারা ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে, লং মার্চ করছে, তাদের ওপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং স্থানীয় এমপি, ছাত্রলীগ, যুবলীগের লোকজন যে আক্রমণ করছে, এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন? আপনার কাছে এর ব্যাখ্যা কী?
মেনন: আমার কাছে এর ব্যাখ্যা আছে। আমি এমন ঘটনার তীব্রভাবে নিন্দা জানাই। একইসঙ্গে একটি জিনিস বুঝতে হবে যে, আমার পারিপার্শ্বিকতা বুঝেই আমাকে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হবে। যদি মনে করেন এটা পরিকল্পিতভাবে করতে দেওয়া হচ্ছে না, সেটা এক ধরনের বিষয় হতো। এটা একটি আকস্মিক ঘটনা। আমি এটাকে অনুমোদন করি না, আমি মনে করি এটা সঠিক নয়। ঢাকায় রাত ১২টার সময় মেয়েরা কত সুন্দর শেকল ভাঙার পদযাত্রা করেছে। সেটাও তো তুলনায় আছে।
ডেইলি স্টার: বেগমগঞ্জের ঘটনাকে কেন্দ্র করে লং মার্চ, ফেনীতে তাদের ওপর আক্রমণ, আক্রমণকারীদের ছবি দেখা গেল। কিন্তু, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার হলো না।
মেনন: হ্যাঁ, এটা খুব অন্যায়। ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। অনেকক্ষেত্রেই আমাদের স্থানীয় যারা আছেন, তারা উপরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপরে যখন সব কিছু একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে, তখন তারা তৎপর হয়ে যান। ওই অঞ্চলের যে পরিবেশটা, ফেনী অঞ্চলের পরিবেশটা তো আপনাদের না জানার কথা নয়।
ডেইলি স্টার: আপনি বহু বছর আগে ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে এসেছেন। কিন্তু, এখনো আপনার পরিচিতির কথা বলতে গেলেই আপনার ছাত্র রাজনীতির প্রসঙ্গ আসে। গত ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশে যে ছাত্র রাজনীতি, বিশেষ করে ছাত্রলীগের যে রাজনীতি দেখলেন বা দেখছেন, তার বিশ্লেষণ কী আপনার কাছে? এক সময়ের যে ছাত্রলীগের সঙ্গে একসঙ্গে ছাত্র রাজনীতি করেছেন, তার সঙ্গে এই ছাত্রলীগকে কীভাবে দেখেন?
মেনন: ছাত্র সংগঠন যখন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হয়ে যায়, তখন এ ধরনের আচরণ হবেই। এজন্য আমরা সব সময়ই বলে আসছি, ছাত্র সংগঠনকে স্বাধীনভাবে রাখতে।
ডেইলি স্টার: ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ ছিল। কিন্তু, ছাত্রনেতারা ধর্ষণ করবে, সেই অভিযোগ তো বাংলাদেশে বা পাকিস্তান আমলেও ছিল না।
মেনন: আমরা তো অনেক কিছুই নতুন দেখছি। ধর্ষণ বলেন, খুন বলেন, রাহাজানি বলেন, অনেক ঘটনা নতুন করে দেখছি। এগুলোকে আমি বিচ্ছিন্ন বিষয় হিসেবে দেখি না। আমি দেখি সামগ্রিকভাবে। এটা একদিকে যেমন রাজনৈতিক লড়াই, তেমনি আরেকদিকে সামাজিক লড়াই। সবদেশে সবকালে এই ঘটনাগুলো যুক্ত আছে। যেসব রাজনীতিবিদরা ছাত্রলীগ করে এসেছেন, তারা নিশ্চই ছাত্রলীগের এমন আচরণ অনুমোদন করেন না, এটা আমি বিশ্বাস করি। রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র সংগঠনকে তাদের অঙ্গ সংগঠন করে। নির্বাচন কমিশন বলছে এটা করা যাবে না, কিন্তু তারা করছে।
ডেইলি স্টার: অভিযোগ আছে, আপনি যখন মন্ত্রী ছিলেন তখন যে কথাগুলো বলেননি, সেগুলো মন্ত্রী না থাকাকালীন বলছেন। অনেককেই বলতে শুনি, আবার যদি আপনাকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়, তাহলে আপনার এসব কথা বলা পুনরায় বন্ধ হয়ে যাবে বা আপনি আবার মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করবেন।
মেনন: আবার বলি, আমি যখন মন্ত্রী ছিলাম, তখনো সংসদে দাঁড়িয়ে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর নিয়ে বক্তৃতা করেছি। সেসব কথায় প্রধানমন্ত্রী কিছুটা মনক্ষুণ্ন হয়েছেন। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে আমি অ্যামেন্ডমেন্ট এনেছি মন্ত্রী থাকা অবস্থায়। সেসময় আমাকে বলা হয়েছে, এ কথাগুলো তো আপনি অন্য জায়গায় বলতে পারতেন। এই লড়াইগুলো তো আছেই।
ইতিহাসটা একটু দেখেন। ২০১৩ সালে আমাকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়েছিল, আমি তা গ্রহণ করিনি। এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। আমাকে অনেক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা হয়েছে। ২০১৩ সালের শেষে এসে যখন অগ্নিসন্ত্রাস শুরু হলো, তখন নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলাম। এখন আমাদের পার্টির সিদ্ধান্ত স্পষ্ট। মন্ত্রিত্ব গ্রহণে তো আমরা আসছিই না, নির্বাচনের প্রতীকের ক্ষেত্রেও স্বাধীনভাবে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ডেইলি স্টার: তার মানে ডাকলেই আপনি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করবেন না?
মেনন: না, এটা আমাদের পার্টির সিদ্ধান্ত। খেয়াল করে দেখেন, আমি মন্ত্রী হয়েছি নির্বাচনকালীন সরকারে। তখন বিএনপিকেও আসতে বলা হয়েছিল, বিএনপি আসেনি।
ডেইলি স্টার: পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো, পাটকল শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন কেন?
মেনন: এ ব্যাপারে ওয়ার্কার্স পার্টি এবং আমি নিজে প্রতিবাদ করেছি। প্রথম থেকেই আমরা প্রতিবাদ করছি। নতুন করে পাটকল সংগ্রাম পরিষদকে পুনর্গঠিত করে সেই লড়াইগুলো এখনো চালাচ্ছি।
ডেইলি স্টার: কিন্তু, সরকারের পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার যে নীতি, এই নীতিকে কীভাবে দেখেন?
মেনন: এটা করা হয়েছে খুবই ক্ষুদ্র স্বার্থে। কিছু ব্যক্তি মালিকানায় এগুলো লুটপাট-দখলের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনার পাটকল বন্ধ করা হয়েছে।
ডেইলি স্টার: শেষ প্রশ্ন করি। বর্তমান সময়ের সুশাসনের ব্যাখ্যা কী আপনার কাছে?
মেনন: সুশাসন বলতে বোঝায়, রাষ্ট্রের অর্গানগুলোকে কার্যকর থাকতে হবে। সংসদ বলি, স্থানীয় সরকার বলি, প্রশাসন বলি— সবই কার্যকর হতে হবে। প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক কিছু আছে আমাদের, আইনও আছে। কিন্তু, পুরোপুরিভাবে কোনোটাই কার্যকর নয়।
Comments