পুলিশ কেন এত অসহিষ্ণু হবে
চলচ্চিত্রের সংলাপে পুলিশকে ‘হেয়’ করা হয়েছে, এই অভিযোগে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা এবং পরিচালক, অভিনেতা গ্রেপ্তার। চলচ্চিত্রটি দেখিনি। ‘হেয়’ করার দৃশ্যটি দেখলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। একটি মেয়েকে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে, মেয়েটি থানায় গেছেন মামলা করতে। সেখানে পুলিশ তাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেছে। ধর্ষণ যেভাবে করা হয়েছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্নও সেভাবে করা হয়েছে।
হতে পারে পুলিশ যেভাবে যেসব প্রশ্ন করেছে, চলচ্চিত্রে যেভাবে দেখানো হয়েছে, এখনকার পুলিশ বাস্তবে হয়তো সেভাবে প্রশ্ন করে না। পুলিশ হয়তো তাদের পূর্বের অবস্থান থেকে বেশ কিছুটা সরে এসেছে। সামগ্রিকভাবে থানায় জিডির পরিবেশ আগের তুলনায় অনেক উন্নত হয়েছে। চলচ্চিত্রে যা দেখানো হয়েছে তা হুবহু বাস্তবের সঙ্গে না মিললেও, অনেককিছুই যে মিলবে— বোধকরি কেউই এই সত্য অস্বীকার করবেন না বা করতে পারবেন না।
আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, পুলিশের ভেতরে আচরণগত অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন আমরা সামনে দেখি আধুনিক-শিক্ষিত পুলিশ অফিসারদের। তারা একটি মানবিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে চাইছেন। করোনা মহামারির শুরুতে আমরা তেমন নজিরও দেখেছি। পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে যা আমাদের আশাবাদী করে তুলেছিল। করোনা মহামারির মধ্যেই কিছু পুলিশের কৃতকর্মে সেই আশাবাদ আবার ধাক্কা খেয়েছে। যদিও আশা একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি। পুলিশের বর্তমান আইজি বেনজীর আহমেদ অসৎ পুলিশ সদস্যদের বিদায় করা ও নেওয়ার কথা বলছেন। পুলিশকে মাদকসেবীমুক্ত করার জন্যে চালু করেছেন ডোপ টেস্ট। মাদকাসক্ত প্রমাণের পর বরখাস্তের ঘটনাও দেখছি। এরকম সময়ে পুলিশকে ‘হেয়’ করার অপরাধে পরিচালক, অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করা হলো।
আচরণগত পরিবর্তনের সঙ্গে সহনশীলতায়ও তো পরিবর্তন আসতে হবে। এত কম সহ্যক্ষমতা নিয়ে মানবিক পুলিশ গড়ে তোলা সম্ভব? পুলিশ যা করবে, তা বলা যাবে না? দেখানো যাবে না?
একজন প্রদীপ তো পুলিশই, তাই না? কক্সবাজার-টেকনাফে ওসি হিসেবে ২২ মাস দায়িত্ব পালন করেছে। মাদক বা ইয়াবামুক্ত করার জন্যে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার’র উৎসব করেছে। গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী, তার দায়িত্বকালে ১৪৪টি ক্রসফায়ারের ঘটনায় ২০৪ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে হত্যার পর জানা গেল আসল ঘটনা। তার আগে ২০৩ জনকে হত্যা করলেও কোনো তদন্ত হয়নি, সত্য জানা যায়নি। একজন মেজর হত্যার পর যে সত্য জানা গেল, তা পুলিশ বাহিনীর ইমেজের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
র্যাবের তদন্তে জানা গেল, ওসি প্রদীপ ইয়াবা চোরাকারবারি বা ইয়াবা চোরাকারবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই তথ্য জেনে যায় মেজর সিনহা। পরিণতিতে পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয় মেজর সিনহাকে। যে ওসি নিজে ইয়াবা চোরাকারবারি, যার নেতৃত্বে ২০৪ জন মানুষকে হত্যা করা হলো মাদকমুক্ত করার নামে, অথচ পুলিশের কোনো কর্মকর্তা, কোনো গোয়েন্দা সংস্থা কিছুই জানল না। মেজর সিনহাকে হত্যার পর তার সহযোগী সিফাত ও শিপ্রার সঙ্গে কী করল কক্সবাজারের পুলিশ? তাদের নামে মাদকের মামলা দিলো। শিপ্রার ল্যাপটপ, মোবাইল সিজ করে নিলো। সেই মোবাইল, ল্যাপটপে রক্ষিত ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও এসপি পর্যায়ের পুলিশ অফিসারদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে দেখা গেল। তদন্তে শিপ্রার বিরুদ্ধে পুলিশের আনা অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। র্যাবের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে পুলিশ নারাজি দিয়েছে।
ওসি প্রদীপ একজন সাংবাদিককে নির্যাতন করে পঙ্গু করে দিয়েছে। মিথ্যা মামলায় জেল খাটিয়েছে। সেই টেলিফোন সংলাপ ফাঁস হয়েছে। মেজর সিনহা হত্যার পর কক্সবাজারের এসপির সঙ্গে ওসি প্রদীপের কথোপকথনের টেলিফোন সংলাপ থেকেও বহু সূত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। সেই এসপির কোনো শাস্তি হয়নি, বদলি হয়েছে।
১৯৯৮ সালে ডিবির এসি আকরাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুবেলকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। গাইবান্ধার সাঁওতাল পল্লীতে পুলিশ কর্তৃক আগুন দেওয়ার ঘটনার ভিডিও প্রকাশিত হয়েছিল। এসব ঘটনার প্রতিফলন যদি নাটক সিনেমায় আসে, সেটাকে ‘হেয়’ মনে করার তো কারণ নেই। একটি ঘটনা দেখানো মানে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের দায়, সমগ্র পুলিশ বাহিনীর নয়। বাহিনীর ওপর দায় তখনই আসবে, বাহিনী যদি অভিযুক্ত পুলিশের পক্ষ নিয়ে ব্যবস্থা না নেয়।
একথা বিবেচনায় রাখছি যে, নেতিবাচক এই চিত্র সব পুলিশের নয়, গুটিকয়েকের। পুলিশই মানুষকে নিরাপত্তা দেয়। কাজটি করা তাদের দায়িত্বও বটে।
ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে হত্যা ও ইয়াবা চোরাকারবারের অভিযোগে যদি পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হতো, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসিত হতো। কিন্তু, বেদনাদায়কভাবে লক্ষ্য করা গেছে নিহত মেজর সিনহা, তার সহযোগী সিফাত-শিপ্রাকে অপরাধী বানানোর চেষ্টা হয়েছে। চলচ্চিত্রের সংলাপে ‘হেয়’ করার অভিযোগে মামলা, তাৎক্ষণিকভাবে পরিচালক ও অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শিপ্রার ব্যক্তিগত ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে তাকে ‘দুশ্চরিত্র’ বলে প্রচারণা চালানো পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শিপ্রাকে কি ‘হেয়’ করা হয়নি?
এমন কি শিপ্রার মামলা পর্যন্ত কক্সবাজার-টেকনাফ থানা নিতে অস্বীকার করেছে। শিপ্রার সঙ্গে যে আচরণ করেছে আর চলচ্চিত্রে দেখানো মেয়েটির সঙ্গে যা করেছে, দুটি ঘটনায় কি বড় কোনো পার্থক্য আছে? শিপ্রার ঘটনাটি কি আরও হৃদয়বিদারক ও অসম্মানজনক নয়?
পুলিশের ভেতরে বহু ভালো সদস্য যেমন আছেন, তেমনি ওসি প্রদীপদের সংখ্যাও কম নয়। একজন এসআই আকবর যখন থানার মধ্যে পিটিয়ে একজন রায়হানকে হত্যা করে, মানুষের ভেতরে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। একটি গণতান্ত্রিক ও সভ্য দেশের পুলিশকে সহনশীলতার সর্বোচ্চ নজির দৃশ্যমান করতে হয়। দৃশ্যমান করতে হয় যে পুলিশের অবস্থান জনগণের পক্ষে। একটি দেশ বা সমাজে যা ঘটে, তা নাটক-সিনেমায় উঠে আসে। ‘এটা কেন এভাবে দেখানো হলো, দেখানো ঠিক হয়নি’— এসব নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক হতে পারে। মামলা, গ্রেপ্তার নয়।
ভারতের পুলিশ ও নাটক-সিনেমার দিকে তাকান। নকশাল আন্দোলন থেকে কাশ্মীর, পুলিশি নির্যাতনের কী বীভৎসতা দেখানো হয়। নারী নিপীড়ন দেখানো হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ অফিসারদের অসততা ও নিপীড়ক চরিত্র দেখানো হয় নিয়মিত। ভারতের পুলিশ মামলা করে না। পরিচালক, অভিনেতা গ্রেপ্তার হয় না। মামলা করেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও।
ভারতের গণমাধ্যমে কথা-লেখা ও কার্টুনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কেমন সমালোচনা করা হয়, তা অজানা থাকার কথা নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দিনে কয়টি মিথ্যা বলেন, মাসে কয়টি মিথ্যা বলেন, বছরে তার মিথ্যার মোট সংখ্যা— সব হিসাব করে প্রকাশ করে গণমাধ্যম। মার্কিন পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা নিয়ে কঠিনতম সমালোচনা করে মার্কিন গণমাধ্যম। সেখানে মামলা বা গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটে না।
এই উদাহরণগুলো একারণে যে আমরা নিয়ম করে বলি, অমুক অমুক ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছি। জঙ্গি মোকাবিলায় নিঃসন্দেহে পুলিশ বাহিনীর সাফল্য আছে। কিন্তু, সহনশীলতা বা সহ্যক্ষমতা এত কম হবে কেন? পুলিশকে মানবিক করতে চাইছেন, আধুনিক-সৎ বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছেন, আমরা আপনাদের এই উদ্যোগকে সমর্থন করি, সঙ্গে থাকতে চাই। কিন্তু, এত কম সহ্যক্ষমতা নিয়ে মানবিক মানুষ বা বাহিনী কোনোটাই হওয়া সম্ভব নয়। পুলিশ বাহিনী পরিশুদ্ধ হলে নাটক-চলচ্চিত্রে তার প্রতিফলন ঘটবে। দাপট ও ক্ষমতা দেখিয়ে মামলা-গ্রেপ্তার করা গেলেও, জনভাবনায় পরিবর্তন আনা যাবে না। সম্মান থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করতে হবে।
s.mortoza@gmail.com
Comments