চাকরির নামে অনলাইনে প্রতারণা
‘ঘরে বসে মাত্র দুই ঘণ্টা কাজ করে মাসে ২০ হাজার টাকা আয় করতে চান?’
অনলাইনে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে যুক্ত থাকা নারীদের ফাঁদে ফেলতে এমনই লোভনীয় প্রস্তাব দেওয়া হয়।
আপাতদৃষ্টিতে লোভনীয় এমন চাকরির প্রস্তাবে প্রায়শই নারীরা আগ্রহী হন, যারা ঘরে বসেই আয় করা সম্ভব এমন কাজ খুঁজছেন। তবে, এই ফাঁদে পা দেওয়ার আগে তারা জানতেও পারেন না যে একটি বড় সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে ছোট ছোট অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার এটি একটি কৌশল।
এমনই একটি অফারে আগ্রহী হন ২০ বছর বয়সী ঢাকার বাসিন্দা সামিরা জান্নাত। আন্ডারগ্রাজুয়েট এই শিক্ষার্থী 'আদিবা নূর' নামের একটি আইডি থেকে এরকম পোস্ট দেখে মেসেজ করেন ইনবক্সে। ওই আইডি থেকে রিপ্লাই আসে এড ফির ব্যাপারে। সেখানে বলা হয়, কাজ নিশ্চিত করতে হলে তাকে একটি মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে ৬০ টাকা ‘ফি’ পাঠাতে হবে। এই ‘ফি’ প্রদান করলে তাকে প্রশিক্ষণের জন্য একটি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে যুক্ত করা হবে।
সামিরার কাজ হবে প্রতিদিন প্যারাগ্রাফ লেখা এবং সেগুলো জমা দেওয়া। এর জন্য তিনি প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকা বেতন পাবেন। প্যারাগ্রাফের বিষয় যে কোনও কিছু হতে পারে। হতে পারে, শীতের সকাল বা গ্রামের বাজার কিংবা টি স্টল, যে কোনও কিছু। স্কুলে যেমন লিখতে হতো তেমন করে।
কাজ শুনতে সহজ এবং সাধারণই মনে হয়। তবে বিপরীত অনুভূতি আসে যখন তারা ভিন্ন একটি অফার দেয়।
তাকে বলা হয়, যদি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে নিজের মতো আরও চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগ দিতে পারেন তবে কমিশন হিসেবে অর্ধেক ‘ফি’ পাবেন। ৩০ জন বা তার বেশি চাকরিপ্রার্থীদের যুক্ত করতে পারলে বোনাস হিসেবে দেওয়া হবে ১০০ টাকা।
ফি প্রদানের পর সামিরাকে ‘ট্রেনিং গ্রুপ-১৮’ তে যুক্ত হয়। এই গ্রুপে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন মেয়ে যুক্ত হতো। সামিরাকে একটি ‘সাবমিট গ্রুপে’ও যুক্ত করা হয়েছিল। সেখানে তাকে তার প্রতিদিনের লেখা প্যারাগ্রাফ জমা দিতে বলা হয়েছিল।
সামিরাকে সতর্ক করা হয়, প্রশিক্ষণ গ্রুপের অন্য কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করা যাবে না এবং কোনো প্রশ্ন থাকলে যে তাকে গ্রুপে যুক্ত করেছে তার সঙ্গেই যোগাযোগ করতে হবে। তা না হলে গ্রুপ এডমিন তাকে গ্রুপ থেকে বের করে দেবে এবং তিনি ‘চাকরি’ হারাবেন।
সামিরা বলেন, ‘প্রত্যেকেই প্রতিদিন প্যারাগ্রাফ জমা দেওয়া শুরু করলেও, কয়েক দিন পর বুঝতে পারছিলাম যে গ্রুপ অ্যাডমিন আমাদের লেখার প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। আমার মনে হয় না, সেখানে যে প্যারাগ্রাফগুলো জমা দেওয়া হচ্ছিল তা তারা দেখেছে।’ তিনি জানান, লেখার চেয়ে গ্রুপ এডমিন সবাইকে চাপ দেন আরও সদস্য যুক্ত করতে এবং তাদের কাছ থেকে ‘ফি’ সংগ্রহ করতে।
তিনি আরও বলেন, ‘শিগগির আমি বুঝতে পারি কোনো সমস্যা আছে এখানে। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখলাম ২৫০ জনের বেশি নারীকে এখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ভেবে পাচ্ছিলাম না এত মানুষকে কিভাবে তারা ২০ হাজার টাকা করে বেতন দেবে। সবাইকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেতন দিতে গেলে মাসে দিতে হবে ৫০ লাখ টাকা।’
সামিরার মনের প্রশ্ন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই উত্তর খুঁজে পায়। গ্রুপে যারাই ২০ দিনের বেশি সময় ধরে আছে এবং বেতনের বিষয় জানতে চায় তাদেরকেই গ্রুপ থেকে বের করে দেওয়া হয়। যাদের বের করে দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে সামিরাও ছিল ।
এরপর থেকে আর গ্রুপ এডমিন বা তাকে যে নিয়োগ দিয়েছিল তার ফেসবুক প্রোফাইল আর খুঁজে পায়নি সামিরা। তিনি বুঝতে পারেন, তাকে ব্লক করে দেওয়া হয়েছে কিংবা তারা তাদের অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাকটিভেট করে দিয়েছে।
যে নম্বরে ‘ফি’ এর টাকা পাঠিয়েছিলেন সেখানে কল দিয়ে দেখতে পান তার নম্বরটি ব্লক করে রাখা হয়েছে।
সামিরার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই গ্রুপ এডমিনরা এবং তাদের সঙ্গে থাকা মানুষগুলো দুই থেকে তিন সপ্তাহে হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত দেড় লাখ টাকা। এর জন্য তাদের বিনিয়োগ করতে হয়নি একটি পয়সাও।
আরও তদন্তের জন্য দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে এমনই একটি চাকরির প্রস্তাবে আগ্রহ দেখানো হয়। সেখানে ৩০০ টাকার বিনিময়ে যুক্ত করা হয় ‘ট্রেনিং গ্রুপ-৩৮’ এ। এই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ২০০ জনেরও বেশি ছিল।
যদি এমন ৪০টি গ্রুপে গড়ে ২০০ জন সদস্য নিজ নিজ গ্রুপ এডমিনের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে অর্ধেক ‘ফি’ পাঠিয়ে থাকে তাহলে গ্রুপ এডমিনরা তরুণ চাকরিপ্রার্থীদের ফাঁদে ফেলে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১২ লাখ টাকা।
দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে অন্তত ৫০ জন নারী ও পুরুষের সঙ্গে কথা বলা হয়। যাদের বেশিরভাগ গৃহকর্মী এবং শিক্ষার্থী। তাদের সবাই প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন। পিরামিড স্কিমের মতো এই গ্রুপগুলোর সদস্যদেরও অন্য সদস্য যুক্ত করতে হয় এই গ্রুপে। নতুন সদস্যদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ৬০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। এর অর্ধেকটা পেতেন যিনি সদস্য যুক্ত করেছেন তিনি।
এই চাকরির অফারগুলোতে প্যারাগ্রাফ লেখা থেকে শুরু করে মেয়েদের কাপড়ের ছবিতে কোড লিখে বিক্রি করাসহ বিভিন্ন কাজ দেওয়া হয়। তবে যে কাজই দেওয়া হোক না কেন মাস পেরোবার আগেই বের করে দেওয়া হয় গ্রুপ থেকে। ব্লক করে দেওয়া হয় ফেসবুক আইডি এবং ফোন নম্বর।
নতুন রূপে পুরানো স্ক্যাম
২০১৩ সালে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ২০১৩ পাস করার মাধ্যমে পিরামিড আকৃতির বিপণন নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
ডেসটিনি-২০০০, ইউনিপে২ইউ এবং আইটিসিএল-এর মতো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের কেলেঙ্কারি ধরা পরার পর এই আইনটি চালু করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বহীন পণ্য ও সেবা বিক্রি করে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ আত্মসাৎ করে।
একই ধরনের প্রতারক চক্র এখন নতুন করে অনলাইনে, এমনকি ফেসবুক ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ সাইবার ও আইনি কেন্দ্রের সহ-প্রতিষ্ঠাতা গাজী মাহফুজ উল কবির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এই জাতীয় সাইবার কেলেঙ্কারির ভুক্তভোগী প্রায় দেড় শতাধিক মানুষের মুখোমুখি তারা হয়েছেন এবং অভিযোগ পেয়েছেন প্রায় আটটি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের উপকমিশনার এএফএম আল কিবরিয়া বলেন, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ ভিত্তিতে এ জাতীয় কেলেঙ্কারি সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি অভিযোগ তারা পেয়েছেন।
সিটিটিসি এ বিষয়ে দুটি অভিযোগ পেয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তদন্তের পর আমরা জানতে পেরেছি যে তারা মূলত জালিয়াতি চক্রের সদস্য। তাদের কোনো ব্যবসা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দুজন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছি, যারা ৫০ লাখ টাকারও বেশি আত্মসাৎ করে তাদের মেসেঞ্জার গ্রুপে সদস্য যুক্ত করে। তাদের কাছ থেকে প্রায় ছয় লাখ টাকা জব্দ করা হয়।’
আল কিবরিয়ার মতে, অর্থের পরিমাণ কম হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থরা অভিযোগ করতে চান না। এই সুযোগ নিয়ে জালিয়াতি চক্রগুলো তাদের প্রতারণার স্কিম অনলাইনে চালিয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘এই জাতীয় ফেসবুক জালিয়াতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাইলে ভুক্তভোগীরা আমাদের কাছে আসতে পারেন। কারণ তারা যদি অভিযোগ না দেন তাহলে ফেসবুকের ‘ক্লোজড’ গ্রুপের মাধ্যমে চলা এসব অপরাধ বন্ধ করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।’
Comments