বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য: কেন ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের জবাব দেয়নি কেউ?
প্রায় ৩৫ বছর আগে আব্বার সঙ্গে আমি আর আমার ভাই প্রেসক্লাবের দিকে যাচ্ছিলাম। আব্বার রিকশায় ছিল তার পরিচিত একজন ভদ্রলোক। আমি আর আমার ভাই পিছনের রিকশায়। পিজি হাসপাতালের সামনে গিয়ে হঠাৎ আব্বার রিকশাটি থেমে গেল এবং সহযাত্রী সেই লোকটিকে আব্বা রিকশা থেকে নামিয়ে দিয়ে বলছেন, আর কোনোদিন তুমি আমাদের বাসায় আসবে না।
ব্যাপার কী, আব্বা কেন তার পরিচিত এই লোকটিকে হঠাৎ নামিয়ে দিল? সে কী এমন অপরাধ করল? আব্বা জানাল লোকটির অপরাধ, সে বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করছিল। তাই আব্বা তাকে নামিয়ে দিয়েছে। আমরা বলেছিলাম, মানুষ তো বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করতেই পারে, তাই বলে তাকে নামিয়ে দিতে হবে? আব্বা বলল, অবশ্যই সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু আমার সামনে বললে আমি সহ্য করব না। আমার সামনে বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করবে, আর তাকে আমি পাশে বসিয়ে নিয়ে যাব? কখনোই না।
আমার আব্বা বঙ্গবন্ধুর একজন অন্ধ সমর্থক ছিলেন। কাজেই তিনি তার জায়গা থেকে প্রতিবাদ করেছেন এবং পরিচিত লোকটিকে রিকশা থেকে ছেলেমানুষের মতো নামিয়ে দিয়েছেন। পারিবারিক এই গল্পটি বলার একটি কারণ আছে, তা হচ্ছে- বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের মামুনুল হক জনসভা করে বলেছেন, ‘ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপন বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে গাদ্দারি করার শামিল। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন করে, তারা বঙ্গবন্ধুর সু-সন্তান হতে পারে না। এর মাধ্যমে মসজিদের শহরকে মূর্তির শহরে পরিণত করার অপচেষ্টা চলছে। এ মূর্তি স্থাপন বন্ধ করুন। যদি আমাদের আবেদন মানা না হয়, আবারও তৌহিদি জনতা নিয়ে শাপলা চত্বর কায়েম হবে।’
আমার প্রশ্নটি কিন্তু মূর্তি বা ভাস্কর্য বানানো নিয়ে নয়, বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করা নিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে অবমাননার অভিযোগ তুলে এ পর্যন্ত কতোজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, এর কি কোনো হিসাব আছে? বলতে পারেন, কতোজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? অথচ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে চরমোনাই আর মামুনুল হকের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের জবাব দিল না কেউই। সবাই যেন কেমন চুপ হয়ে গেল। আওয়ামী লীগের কোটি কোটি সমর্থক, কাগজে-কলমে যারা আওয়ামী লীগ করেন, যারা বিভিন্নভাবে দলের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ করেন, তারা সব কোথায়? একজনও তো এর প্রতিবাদ করল না। একজনও তো মামুনুল হকের হুমকির পাল্টা জবাব দিল না। কিন্তু কেন? এর একটি কারণ হতে পারে- এসব বিষয়ে আমরা অনেক তথ্য ও বিশ্লেষণ জানি না। অথবা এসব বিতর্কে জড়াতে চাই না।
অবশ্য আওয়ামী লীগের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ আরও দু-একজন বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিবাদ করেছেন। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, উনারা অবজারভ করছেন। উনার বক্তব্যকে কি আমরা অফিসিয়াল বক্তব্য বলে ধরে নিতে পারি? মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রীও বলেছেন, যে যাই বলুক, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য হবেই।
এরপরও প্রশ্ন জাগে আওয়ামী লীগ এতোগুলো বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পরও কেন এই দুর্বল আচরণ? তবে কি ধরে নেব যে, তারাও বিশ্বাস করে যে, ওই লোকগুলো যা বলেছে, ঠিক বলেছে? ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ঠিক এমনটিই ঘটেছিল। সেসময় কোনো আওয়ামী লীগার কোনোরকম প্রতিবাদ করেনি। অবশ্য সময়টি ছিল ভিন্ন, সামরিক ক্যু’র পর সাধারণত কেউ পথে নামতে ভয় পায়। সেই দুর্বলতার ভার অবশ্য বহুবছর আওয়ামী লীগকে এবং দেশবাসীকে বহন করতে হয়েছে।
একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক মন্তব্য করেছেন যে, আওয়ামী লীগের কর্মীদের গায়ে চর্বি জমে গেছে, তাই তারা রাজপথের আন্দোলনে নেই। এ কথাটি যেমন ঠিক, সেই সঙ্গে এটিও ঠিক যে, এখন যারা দলে-বলে নিজেদের আওয়ামী লীগার বলে দাবি করেন, তাদের মধ্যে কতোজন প্রকৃত সমর্থক? কতোজন ছদ্মবেশী সমর্থক? এর একটি জরিপ হওয়া দরকার আছে। শুধু ফেসবুকে বসে গালাগালি করেই যারা নিজেদের আওয়ামী লীগার বলে মনে করে, তারা আসলে কেউই প্রকৃত ভক্ত নয়, বরং তারা দলটির ক্ষতিই করছে। সরকার এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এটি কি এক ধরনের অসহায়ত্ব নয়?
বছরের পর বছর ধরে, যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা আছেন, তারা খুবই অবাক হয়ে যান ইতিহাস সমৃদ্ধ দলটির কৌশলগত এই পরিবর্তন দেখে। বঙ্গবন্ধুর সময়কার একজন সাবেক এমপি এবং মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুর আগে একটি লেখায় লিখে গেছেন, আমার স্বদেশ আমার কাছে ক্রমশ অচেনা হয়ে যাচ্ছে। আমার দল এবং দলের লোকগুলোও অন্যরকম হয়ে গেছে, আর মুক্তিযুদ্ধ? এর কথা আর নাইবা বললাম।
এর আগেও, বিভিন্ন জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, কিন্তু আমরা দেখিনি কোথাও কোনো প্রতিবাদ হয়েছে। তাহলে কি এরকম ছোট ছোট ঘটনা ঘটিয়ে তারা পরীক্ষা করে দেখতে চাইছে যে, কেউ কোনো জায়গা থেকে প্রতিবাদ করে কি না? আমরা সবাই প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছি। বিভিন্ন তরফ থেকে বিভিন্ন ধরণের ভয়-ভীতি আমাদের কলিজা ছোট করে দিয়েছে। ব্রিটিশ শোষক, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আমাদের এবং যে ভূমিকা ছিল, তা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছি না। আর পারছি না বলেই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করার সাহস দেখাতে পারে একটি গোষ্ঠী।
এবার দৃষ্টি ফেরাই অন্য একটি বিষয়ের ওপর। কেন আমরা বলতে পারছি না যে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের সঙ্গে মূর্তি উপাসনার কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই জাতীয় হিরোদের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়ে থাকে, তাদের স্মরণীয় করে রাখার জন্য, পূজা করার জন্য নয়। আমাদের কাছে অসংখ্য ইসলামি দেশের এরকম উদাহরণ আছে।
যেমন: মিশর একটি ইসলামিক দেশ। সেখানে ধর্মীয় রীতি-নীতি যেমন মানা হচ্ছে, তেমনি সে দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকেও তুলে ধরা হচ্ছে। মিশরের বিভিন্ন জায়গায় সে দেশের ফেরাউনদের ইতিহাসকে ঘিরে নানা রকমের স্ট্যাচু বিক্রি করছে দোকানিরা। তাই দেখে আমি এক বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা ইসলামি দেশ হওয়া সত্ত্বেও এতো ধরণের মূর্তি বা ভাস্কর্য বিক্রি করছ, তোমাদের গুনাহ হবে না? দোকানি হেসে বলল, কেন তা হবে? একটি আমার ধর্ম, অন্যটি আমার কালচার। কোনোটির সঙ্গে কোনোটির বিরোধ নেই। আমরা কি এসবকে দেব-দেবী হিসেবে পূজা করতে যাচ্ছি? তাহলে আর অসুবিধা কোথায়? উত্তর শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। একজন দোকানির কনসেপ্ট কতো পরিষ্কার। সেখানে পর্যটকদের দেখানোর জন্য তালিকায় পুরনো মসজিদ, গির্জা সব আছে। মিশরে এখনো স্ফিংস রয়ে গেছে। আইএসরা ভাঙার আগ পর্যন্ত মেসোপটেমিয়ার এইসব মূল্যবান স্ট্যাচু সেখানে হাজার বছর ধরে টিকে ছিল। তালেবানদের হাতে আফগানিস্তানের বৌদ্ধ মূর্তি ভাঙার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
তুরস্কও আরেকটি ইসলামিক দেশ। সে দেশে অনেক মসজিদ, পুরনো আমলের চার্চ ও স্থাপত্য নিদর্শন আছে। সব কিছুকে ঘিরে আছে সে দেশের ইতিহাস। আয়া সোফিয়া ছিল এমন একটি পর্যটন কেন্দ্র, যেটি একইসঙ্গে চার্চ, মসজিদ এবং মিউজিয়াম হিসেবে মানুষ দেখতে যেতো। এটি নির্মাণ করা হয়েছিল সেই ৫৩২ এবং ৫৩৭ সালের মধ্যে কনস্টান্টিনোপলের খ্রিস্টান ক্যাথেড্রাল হিসাবে। চার্চটি প্রজ্ঞার ঈশ্বর লোগোসকে উৎসর্গ করা হয়েছিল।
১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর অটোমান সাম্রাজ্যের তৎকালীন মুসলিম শাসক ফাতিহ সুলতান মুহাম্মদ এটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। যদিও চতুর্থ ক্রুসেডের নেতৃত্বাধীন ভেনিসের ডেজ এবং ১২০৪ স্যাক কনস্টান্টিনোপল, এনরিকো দানডোলোকে এই গির্জার মধ্যেই সমাহিত করা হয়েছিল। আয়া সোফিয়ার বাইজেন্টাইন আর্কিটেকচার অনুযায়ী নীল মসজিদ, ইহজাদে মসজিদ, সলেমনিয়া মসজিদ, রিস্টেম পাশা মসজিদ এবং কালী আলী পাশাসহ আরও অনেক উসমানীয় মসজিদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।
এটি ১৯৩১ সাল পর্যন্ত মসজিদ হিসেবে থেকে যায়। এরপর এই স্থাপনাটি ১৯৩৫ সালে আধুনিক তুরস্কের স্থপতি ও স্বাধীন তুরস্কের প্রথম রাষ্ট্রপতি মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক যাদুঘরে রূপান্তর করেন। সেই যাদুঘরে গিয়ে দেখেছিলাম খৃষ্টীয় ও মুসলিম সভ্যতার কী অনবদ্য রূপ। সেখানে একদিকে যেমন মিনার আছে, নামাজের জায়গা দেখা যাচ্ছে, আবার একইসঙ্গে মার্বেল পাথরে অঙ্কিত যীশু ও মা মেরির অনেকগুলো ছবি। এর ভেতরে প্রবেশের পর অদ্ভুত একটি অনুভূতি হতে বাধ্য। মনে হয়, চোখের সামনে ইতিহাসের দরজা খুলে গেল।
অবশ্য মসজিদ হিসেবে ঘোষণার পর যীশুর ছবিগুলো প্রায় ৫০০ বছরের জন্য সিমেন্টের নিচে চাপা ছিল। কিন্তু এই স্থাপনাটিকে যাদুঘরে রূপান্তরের পর ছবিগুলো পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। যদিও ২০২০ সালে কাউন্সিল অব স্টেট আয়া সোফিয়াকে আবারও একটি মসজিদ হিসাবে পুনর্নির্মাণের আদেশ দেয়।
সেদিন পত্রিকায় দেখলাম তুর্কমেনিস্তানের রাজধানীর ঠিক মাঝখানে সোনা দিয়ে বাধানো একটি বিরাট আকারের এলাবাই কুকুরের স্ট্যাচু উদ্বোধন করা হয়েছে। কারণ এই এলাবাই কুকুর হচ্ছে তাদের খুব প্রিয় ও জরুরি পাহারাদার কুকুর। তাই তাকে সম্মান জানানোর জন্য অনেক স্ট্যাচুর পাশে সেই কুকুরের স্ট্যাচুও শোভা পাচ্ছে। আরও আছে ঘোড়ার স্ট্যাচু, তার ওপর সওয়ার হয়ে আছেন দেশের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং। তারা মনে করেন, দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ধর্মের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। অথচ তুর্কমেনিস্তান একটি মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র। এখানে শতকরা ৮৯ ভাগই সুন্নি মুসলিম। চারপাশে প্রতিবেশী কট্টর মুসলিম দেশ উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ইরান। সে দেশের মানুষেরা মনে করেন, তাদের ধর্ম ইসলাম এবং তারা ইসলামকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই গ্রহণ করেছেন।
কিরগিজস্তান আরেকটি মুসলিম দেশ। শতকরা ৮৮ জনই মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে ইসলাম ধর্মকে নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন তারা। চমৎকার সব ভাস্কর্য রয়েছে শহর জুড়ে।
আমরা কি জানি, পাকিস্তানেও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বিশাল সাইজের ভাস্কর্য আছে। বিশ্বের মধ্যে অন্যতম বড় সাইজের এই ভাস্কর্যটি নিয়ে কিন্তু সে দেশে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। পাক-ভারত উপমহাদেশের শিখ রাজ্যের অধিপতি ছিলেন মহারাজা রণজিৎ সিং। তিনি পরিচিত ছিলেন শের-এ-পাঞ্জাব নামে। রণজিৎ সিংয়ের স্ট্যাচু উদ্বোধন করা হয়েছে লাহোর ফোর্টে, বীরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে।
তবে হ্যাঁ, এই সেদিনও পুরনো ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমৃদ্ধ গৌতম বুদ্ধের একটি স্ট্যাচু পাওয়া গিয়েছিল পাকিস্তানের খাইবার পাকতুনখাওয়া এলাকায়। এটি ছিল ১৭০০ বছর আগের গান্ধারা সভ্যতার একটি নিদর্শন। শ্রমিকেরা মাটি খুঁড়তে গিয়ে এটি পেয়ে অপবিত্র মনে করে সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে ফেলেছে। এ ছাড়াও, পাকিস্তানে বুদ্ধের অনেক মূল্যবান স্ট্যাচু আগেও পাওয়া গিয়েছিল। কারণ ২৩০০ বছর আগে সম্রাট অশোকের সময়ে পাকিস্তানে ইসলাম নয়, বরং বৌদ্ধধমর্ই ছিল শক্তিশালী।
তাকাই ইউরোপের দিকে, ১১ শতকে আল-আন্দালুস বা ইসলামিক স্পেনে তৈরি করা হয়েছিল পিসা গ্রিফিন বলে বিশালাকায় একটি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য। এটি ছিল একটি মিথলজিক্যাল চরিত্র, সামনে ঈগলের মুখ, পেছনে সিংহের শরীর। এটিই ছিল মধ্যযুগের ইসলামিক মেটাল ভাস্কর্য।
ইসলামিক চরমপন্থি দল আইএস সদস্যরা ২০১৫ সালে ইরাকের মসুল মিউজিয়ামে গিয়ে হাজার হাজার বছর আগের পুরাতাত্ত্বিক সব নিদর্শনগুলো ভেঙে ফেলেছিল। ওই একই সময়ে মুসলমানদের একটি অংশ পূর্ব জাভার জয়ানদারু ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার দাবি জানিয়েছিল। অথচ এটি ছিল ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি জেলে ও কৃষকদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য তৈরি একটি ভাস্কর্য। যারা ভাঙতে চেয়েছিল, তাদের যুক্তিও ছিল ওই আইএসদের মতোই। তারাও মনে করে, এর মাধ্যমে একটি আদর্শকে পূজা করা হচ্ছে, যা পাপ।
আবার এমনও চরমপন্থি গ্রুপ আছে, যারা ইসলামি সুফি-ওলামাদের পবিত্র মাজার ভাঙারও পক্ষে। আইএসরা ইরাকে হযরত ইউনুস নবীর কবর, সিরিয়াতে ইমাম আন-আননাওয়াইয়ের কবর ভাঙতে চেয়েছিল আল-নাসরা বাহিনী। যদিও অনেক ইসলামিক পণ্ডিত মনে করেন, বিখ্যাত মুসলিম ব্যক্তিত্বদের এসব কবরের ঐতিহাসিক মূল্য আছে। ভাস্কর্য ও পবিত্র মাজারগুলো তো এক জিনিস নয়। অনেক মুসলমান তাদের ধর্ম পালনের অংশ হিসেবে এসব মাজার জিয়ারত করেন। তাহলে নবী-আউলিয়াদের কবর ভাঙার প্রশ্ন উঠেছে কেন?
আইএস যে যুক্তিতে ভাস্কর্য ভাঙার পক্ষে, সেই একই যুক্ততে তালেবানরা ২০০১ সালে আফগানিস্তানের বামিয়ানে ৬ শতকের দুটি খুব মূল্যবান বৌদ্ধমূর্তি বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল। কারণ তারা জানতোই না যে, বৌদ্ধধর্মে নিজস্ব ঈশ্বর বলে কিছু নেই। শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধ তাদের সেই রকমের দেবতাও নন।
ইসলামি পণ্ডিতদের অনেকেই মনে করেন, বিভিন্ন মূর্তির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কোনো কোনো মূর্তি নিছক মূর্তি বা ভাস্কর্য, আবার কোনো কোনোটি তৈরি করা হয় পূজা করার জন্য। ইসলামে মূর্তি পূজা নিষিদ্ধ ও ভয়াবহ অপরাধ। কিন্তু পূজা না করে, শুধু স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে যে ভাস্কর্য তৈরি করা হয়, তাতে কোনো অসুবিধা নেই।
জাকার্তা পোষ্টের একটি লেখায় দেখলাম, আল আজহার’র সাবেক গ্র্যান্ড ইমাম (১৯৮২-৯৬) এবং ইসলামি সংস্কারক ও চিন্তাবিদ যাদ আল হক এবং আরেকজন ইসলামি চিন্তাবিদ ও আধুনিক ইসলামের ব্যাখ্যাকারী মুহাম্মদ ইমারাহ বলেছেন, যতোক্ষণ পর্যন্ত কোনো স্ট্যাচুকে পূজা করা হয় না, ততোক্ষণ পর্যন্ত এতে কোনো সমস্যা নেই।
এই মতের সমর্থনে প্রথমদিককার মুসলিম ইতিহাসের কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে ওই লেখায়। নবী করিম হযরত মুহাম্মদ (স:) এর সঙ্গী এবং আরব কমান্ডার আমর ইবনে আল আস আল সাহমি যখন মিশর জয় করেন এবং ৬৪০-৬৬৪ পর্যন্ত বিরতি দিয়ে মিশরের গভর্নর ছিলেন, তখন তিনি সেখানকার কোনো মূর্তি ভেঙে ফেলেননি। নবীজির আরেকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস যখন পারশিয়া বা আজকের ইরাক জয় করে সেখানকার গভর্নর হন ৬৩৬ খৃষ্টাব্দে, তখন তিনিও মূর্তি ভাঙার কোনো উদ্যোগ নেননি। কারণ ওগুলো তখন আর পূজার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছিল না।
তাই আমাদেরও এইসব বিতর্ক বন্ধ করার জন্য, একটা সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখার জন্যই দেশ-বিদেশের ইসলামি স্কলারদের মতামত নেওয়া উচিত। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্যই এটি করা দরকার, নয়তো আমাদের শহীদ মিনার, অপরাজেয় বাংলাসহ আরও অনেক সৃষ্টিই ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে। আমাদের বুঝতে হবে- ফুল দিয়ে ভালোবাসা জানানো মানেই পূজা করা নয়।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
ranjana@manusher.org
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments