কয়লা নয় ভবিষ্যতের জ্বালানি
কয়লা আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়া ও পরিবেশের কথা বিবেচনায় নিয়ে অবশেষে সরকার কয়লা-ভিত্তিক জ্বালানি প্রকল্প থেকে সরে আসার পরিকল্পনা করছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। তা শিগগির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে (পিএমও) পাঠানো হবে। এর সঙ্গে থাকবে তরলকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও পেট্রোলিয়াম-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাব।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, যদি এই প্রস্তাব পিএমও-তে গৃহীত হয় তাহলে পাঁচটি প্রকল্প ছাড়া বাকিগুলো বাতিল করা হবে।
২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে সরকার ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৮টি কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে।
এই ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ৩৫ শতাংশ কয়লা থেকে উৎপাদন করার কথা ভাবা হয়েছিল।
বিগত বছরগুলোতে প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ১৩টির কোনো অগ্রগতি হয়নি অথবা প্রকল্পগুলোর জন্যে তহবিল জোগাড় করা সম্ভব হয়নি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘অনুমোদন পাওয়ার পর কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তহবিল জোগাড় করতে পারেনি। তাই আমরা সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছি। কারণ, তারা অনুমোদন পাওয়ার পর অবকাঠামো তৈরির কাজ এখনো শুরু করতে পারেনি।’
যে পাঁচটি প্রকল্প অবকাঠামো তৈরির কাজ শুরু করতে পেরেছে ও তহবিল সংগ্রহ করতে পেরেছে সেগুলো হলো: পটুয়াখালীর পায়রায় ১,৩২০ মেগাওয়াটের বাংলাদেশ-চীন যৌথ প্রকল্প, বাগেরহাটের রামপালে ১,৩২০ মেগাওয়াটের বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১২২৪ মেগাওয়াটের এস আলম বিদ্যুৎ প্রকল্প, বরগুনায় ৩০৭ মেগাওয়াটের বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি ও কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে ১২০০ মেগাওয়াটের বাংলাদেশ-জাপান যৌথ প্রকল্প।
এগুলোর মধ্যে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট উৎপাদনে গিয়েছে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘গত কয়েকমাস থেকে এটি জাতীয় গ্রিডে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে।’ এখন তারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় ইউনিটের নির্মাণ কাজ শুরু করবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আগে দেশে একমাত্র কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ছিল দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায়। এর উৎপাদন ক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট।
মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২০২৩ সালে উৎপানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র
দেশের আর সব কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মধ্যে রামপাল প্রকল্পটি দেশ-বিদেশের পরিবেশবাদীদের প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে। কেননা, এটি তৈরি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্যারাবন সুন্দরবনের কাছে।
প্রতিমন্ত্রীর মতে, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তিনি বলেছেন, ‘রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪০ শতাংশ নির্মাণকাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। তাই এটি বাতিল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’
তিনি মনে করেন, ‘ এসব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি হবে না। কেননা, কেন্দ্র নির্মাণে সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।’
তবে, সরকারের এই মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন পরিবেশ সংরক্ষণবাদীরা।
তাদের যুক্তি, কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নিঃসৃত কালো ধোঁয়ায় বাতাস দূষিত হবে এবং জাহাজে করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিয়ে আসা কয়লায় পানি দূষিত হবে। যা সুন্দরবনের হুমকিতে থাকা জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
কয়লার বিকল্প
পরিবেশ সংরক্ষণবাদীরা বলছেন, পরিবেশের জন্যে ক্ষতিকর কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে আসলেও ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো ক্ষতি হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও শীর্ষ জ্বালানি সংরক্ষণবাদী বদরুল ইমাম ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘আমাদের কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা, দেশে বিদ্যমান চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি।’
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। আর কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট।
দেশে গ্যাস, তেল, পানি, সৌরশক্তি ও কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এছাড়াও, রূপপুরে দেশের একমাত্র পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদনে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ২০২৪ সালের মধ্যে।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেছন, পরিবেশ দূষণ ছাড়াও কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বহুল হয়ে যাচ্ছে বিধায় সরকার বিকল্প খুঁজছে।
‘ভবিষ্যতের চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো প্রয়োজন। তাই সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে এলএনজি, তেল, কয়লা ও সৌরশক্তি ব্যবহারের দিকে যাবে। যাতে কোনো একটির ওপর নির্ভর করে থাকতে না হয়।’
সৌরশক্তির মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এর জন্যে অনেক জায়গা প্রয়োজন হয়। এছাড়াও, রাতে ব্যবহারের জন্যে বিদ্যুৎ মজুদ করে রাখার কম খরচের কোনো ব্যবস্থা নেই।’
তার মতে, ১ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে ১০ বর্গমাইল জায়গার প্রয়োজন হয়।
তিনি আরো বলেছেন, ‘যতদিন পর্যন্ত বিদ্যুৎ মজুদ করে রাখার প্রযুক্তি না আসছে ততদিন সৌরবিদ্যুৎ আমাদের জন্যে টেকসই কোনো বিকল্প হবে না। তবে আমরা এখনো কৃষি কাজে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছি। দেশে ৬০ লাখ বাড়িতে সৌরবিদ্যুৎ রয়েছে, যা বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ।’
Comments