একজন অধ্যাপক ড. মামুন ও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গবেষণা
এ সপ্তাহটি ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) পরিবারের জন্য একদিকে চরম বেদনার, অন্যদিকে পরম আনন্দের। গত ৯ নভেম্বর রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড নামের একটি মানসিক হাসপাতালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এবং পুলিশের সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম ওই হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর মারধরে প্রাণ হারান। এই অমানবিক ও বর্বর কাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাই একাধারে বিক্ষুব্ধ ও শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে।
এর আগে এক লেখায় আমি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম, মানসিক রোগীদের এ ধরনের মারধর এ জাতীয় কিছু প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হয়ে থাকতে পারে। পরবর্তীতে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ওই হাসপাতালে আসলেই নিয়মিত রোগীদের এভাবে টর্চার করা হতো।
এই বর্বরোচিত ঘটনায় জাবি পরিবারসহ সারা দেশ যখন শোকে মুহ্যমান, তখন সংবাদমাধ্যম তাদের জন্য একটি অনন্য সাধারণ সুখবর নিয়ে উপস্থিত হলো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এ মামুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত এক জরিপে ২০২০ সালের বিশ্বব্যাপী সেরা বিজ্ঞানীদের নিয়ে প্রকাশিত তালিকায় দুই শতাংশের মধ্যে স্থান লাভ করেছেন। এ স্বীকৃতি অধ্যাপক এ এ মামুনের অর্জনের তালিকায় একটি নতুন পালক যুক্ত করল মাত্র।
ছাত্রজীবন থেকে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান এ বিজ্ঞানী কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রুস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্লাজমা ফিজিক্সে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি একাধিক অত্যন্ত মর্যাদাবান পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপের অধীনে জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে কমপ্লেক্স বা ডাস্টি ফিজিক্সে অ্যাডভান্সড রিসার্চ সম্পাদনের সুযোগ লাভ করেন। ‘প্লাজমা ফিজিক্স’ এ অসামান্য অবদানের জন্য তিনি জুনিয়র ও সিনিয়র উভয় গ্রুপে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স স্বর্ণপদক এবং একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে জার্মানির ব্যাসেল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ডসহ দেশ-বিদেশের অনেক খ্যাতনামা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
তিনি ‘ইন্ট্রোডাকশন টু ডাস্টি ফিজিক্স’ নামক বইয়ের একজন কো-অথর, যা এই এরিয়ায় লেখা প্রথম কোনো বই এবং বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যবই হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ যাবত দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা জার্নালে তার ৪১৭টি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে এবং বাংলাদেশে কর্মরত প্রথম কোনো বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি গুগলে ১২ হাজার স্কলার্স সাইটেশনের মাইলফলক অতিক্রম করার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
পৃথিবীর যেসব দেশ জ্ঞান-গরিমা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে, তা মূলত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিচালিত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কার্যক্রমের বদৌলতে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক কার্যক্রমকে আপনি দুটো ভাগে ভাগ করতে পারেন: জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞান সৃষ্টি। বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিকে শিক্ষকরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের আলোকে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দেশ ও সমাজকে সেবাদানের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরি করেন। অন্যদিকে তাদের অধিক্ষেত্রে অমীমাংসিত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য গবেষণা পরিচালনা করেন।
গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টিকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একজন রিসার্চ স্টুডেন্ট যখন তার তত্ত্বাবধায়কের অধীনে কোনো সমস্যা সমাধানে কাজ করে, তখন এর মাধ্যমে যে কেবল নিত্য-নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হয় তা নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে তার মধ্যে নিত্য-নতুন সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানে গবেষণা কার্যক্রম ডিজাইন করার দক্ষতাও অর্জিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বিভিন্ন রিসার্চ অর্গানাইজেশনে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে দক্ষ জনবলের প্রয়োজন হয়, তা এভাবেই তৈরি হয়। এ ছাড়াও, এ অভিজ্ঞতা একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে পরবর্তী কর্মজীবনে, এমনকি সে ভিন্ন ধরনের কাজেও যদি যোগ দেয়, যে কোনো সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সমাধানে অধিকতর আত্মবিশ্বাস ও সক্ষমতা তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অধ্যাপক মামুনের এই যে ঈর্ষণীয় সাফল্য, তা কি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামগ্রিক মানকে প্রতিফলিত করে? আমার বিশ্বাস, এখানে অনেকেই এক বাক্যে বলে উঠবেন, ‘না’। প্রতি বছর সংবাদমাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে র্যাংকিং প্রকাশিত হয়, সেখান থেকেই আপনি অনায়াসে এর একটি মোটামুটি চিত্র পেয়ে যাবেন। এ বছর জুনে বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান কিউএস বিশ্বসেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের কেবল দুটি বিশ্ববিদ্যালয়—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়— স্থান পেয়েছে। তাও শেষের দিকে, ৮০১ থেকে এক হাজারের মধ্যে।
বোঝা দরকার, সামগ্রিক বিচারে গবেষণা ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই পিছিয়ে পড়া অবস্থানের হেতু কী? এটা কি এই বার্তা দেয় যে, আমাদের এখানে অধ্যাপক মামুনের মতো কৃতী ও অধ্যবসায়ী গবেষকের সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল? এটা কি এ কারণে যে, আমাদের গবেষণাকর্মের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার বেশ ঘাটতি রয়েছে? নাকি আমাদের উচ্চশিক্ষার সামগ্রিক পরিকাঠামোতে এমন কিছু দুর্বলতা রয়েছে, যার ফলে এখানে গবেষণাকর্ম যথাযথ মোমেন্টাম পাচ্ছে না? আসুন বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখা যাক।
প্রথমেই আসা যাক দক্ষ জনবলের প্রসঙ্গে। সন্দেহ নেই, এদেশীয় গবেষণার জগতে অধ্যাপক মামুন একটি ব্যতিক্রমী উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে, আপনি খোঁজ নিলে দেখতে পাবেন, আমাদের এখানে বিশ্বের নামিদামি সব বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারে কাজ করে আসা বিপুল সংখ্যক যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন গবেষক রয়েছেন। তবে, হ্যাঁ, এ সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারত। এ দেশ থেকে প্রতি বছর বহু মেধাবী তরুণ উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার জন্যে উন্নত বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাড়ি জমায়। দুর্ভাগ্যবশত, এদের অনেকেই আর দেশে ফিরে আসেন না। অধ্যাপক মামুনের মতো এরকম কিছু ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব আপনি অবশ্যই পাবেন, যারা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও উন্নত বিশ্বের চাকচিক্যের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে না ফেলে দেশ ও মাটির টানে ফিরে আসেন। তবে, অনেকেই মনে করেন, এ সংখ্যা অনেক বেশি নয়। কিন্তু, কেন? সে আলোচনায় পরে আসছি।
দেখা যাক, গবেষণাকর্ম পরিচালনায় দক্ষ জনবলের ঘাটতিই যদি না থাকবে, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আপনি দেখবেন, বেশিরভাগ লোকই ফান্ডিং ও ল্যাবরেটরি বা লাইব্রেরি ফ্যাসিলিটিসের অপ্রতুলতার কথা বলছেন। সন্দেহ নেই, অবশ্যই এগুলো অপরিহার্য প্রধান উপকরণগুলোর মধ্যে পড়ে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও রি-এজেন্টের ব্যবস্থা না হলে এবং দেশে-বিদেশে সংশ্লিষ্ট এরিয়ায় গবেষণার আপ-টু-ডেট অবস্থান জানার জন্য যে বিভিন্ন জার্নাল-আর্টিকেল সাবস্ক্রাইব করার প্রয়োজন পড়ে, তা করা না গেলে যে মানসম্মত গবেষণা করা সম্ভব নয়, তাতে কি দ্বিমতের অবকাশ আছে? তবে, এটাও ঠিক, আপনি যদি মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন এবং আপনার চারপাশ থেকে কম-বেশি সহযোগিতা পান, তাহলে আপনার কাজ খুব ভালোভাবে না এগোলেও কোনো রকমে চালিয়ে নেওয়ার মতো একটি রাস্তা বেরিয়ে আসবে এবং এভাবে একটু সময় লাগলেও, ধীরে ধীরে আপনার একটি ওয়ার্ক সেট-আপ গড়ে উঠতে পারে।
তবে, আমার বিবেচনায় নীতি-নির্ধারকদের যে বিষয়টির দিকে আরও একটু বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার, তা হলো— আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামগ্রিক কর্মতৎপরতা প্রাথমিকভাবে গবেষণামুখী নয়; এটি প্রধানত জ্ঞান বিতরণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এখানে গবেষণা যে হচ্ছে না, তা নয়। তবে, এটার জন্য যে ধরনের অবকাঠামো ও মনোযোগ দরকার, তাতে ঘাটতি রয়েছে। গবেষণার কাজটি যে শিক্ষার্থী করবে এবং যে শিক্ষক তত্ত্বাবধান করবেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কারিকুলামের সামগ্রিক পরিকাঠামো তাদের জন্য কতটুকু অনুকূল?
আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা মূলত তিনটি স্তরে হয়ে থাকে: মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি। তবে, বাস্তব ক্ষেত্রে মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদেরকেই হয়তো আপনি অধিকতর সক্রিয়ভাবে কাজে পেয়ে থাকবেন। এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, একজন মাস্টার্সের শিক্ষার্থী কি তার থিসিসের ওপর কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছে? আপনি যদি মাস্টার্স সিলেবাসে চার শ থেকে পাঁচ শ নম্বরের কোর্স-ওয়ার্ক এবং দুই শ নম্বরের থিসিস রাখেন এবং তা এক বছর সময়ের মধ্যে শেষ করতে বলেন, তাহলে এখানে কি ধরনের গবেষণা হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স বাই রিসার্চ প্রোগ্রামে হয় আদৌ কোনো কোর্স-ওয়ার্ক থাকে না কিংবা থাকলেও নামমাত্র। পুরো একটি বছর শুধুমাত্র গবেষণার পেছনে ব্যয় করেও অনেক শিক্ষার্থী কুলিয়ে উঠতে পারে না। বুঝতেই পারছেন, এখানে সময় একটা বড় ইস্যু। কাজেই আমাদের এখানেও আপনি যদি একজন শিক্ষার্থীকে তার থিসিসের ওপর কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে চান, তাহলে হয় কোর্স-ওয়ার্ক মিনিমাইজ করে এক শ থেকে দুই শ নম্বরে নামিয়ে আনতে হবে। নতুবা প্রোগ্রামটা দুই বছরে উন্নীত করতে হবে।
এবার শিক্ষকরা, যারা গবেষণা তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকেন, তাদের অবস্থাটা দেখি। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের টিচিংয়ে অনেক সময় দিতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে সিংহভাগ সময় এখানেই ব্যয় করতে হয়। এক একটি ক্লাসে ৫০-১০০ জন শিক্ষার্থী থাকে। আদর্শ পদ্ধতিতে এ ধরনের একটি ক্লাসকে দুই থেকে চারটা সেকশনে ভাগ করে প্রতিটি সেকশনের দায়িত্ব আলাদাভাবে এক একজন শিক্ষকের ওপর ন্যস্ত করার কথা। যাতে শিক্ষক প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রতি পর্যাপ্ত মনোযোগ দিতে পারেন। শিক্ষককে যখন এত বড় একটি ক্লাস পরিচালনা করতে হয়, পাঠদানের কাজটি কোনোরকমে সারা গেলেও পরীক্ষার খাতা দেখতে গিয়ে তিনি গলদঘর্ম হয়ে পড়েন। ফলে দেখা যায়, একজন শিক্ষককে সারা বছর পাঠদান ও পরীক্ষার খাতা দেখা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়। এখানে গবেষণায় মনোযোগ দেওয়ার সময় কই?
তাহলে সমাধান? শিক্ষক সংখ্যা কি দ্বিগুণ বা ত্রিগুণ করা সম্ভব? অন্তত আমাদের এখানে বাজেটের যা অবস্থা, তাতে কোনোভাবেই এটা সম্ভব নয়। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষকদের সহযোগিতা করার জন্য মাস্টার্স, এমফিল বা পিএইচডি শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ দেওয়ার বিধান আছে। বিকল্প হিসেবে আমরা কি সেটা ভেবে দেখতে পারি?
আমি মাস্টার্স পর্যায়ের গবেষণার ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করেছি। কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেটুকু গবেষণা হয়, তা মূলত এ পর্যায়েই। অথচ বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে আপনি দেখতে পাবেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলে ইন-ডেপথ রিসার্চ হয় পিএইচডি পর্যায়ে। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি পর্যায়ের গবেষকদের সার্বক্ষণিক কাজ করার জন্য ল্যাব বা অফিস স্পেস থাকে। সাধারণভাবে, একটি পিএইচডি প্রোগ্রামের অফিসিয়াল কার্যকালই থাকে তিন থেকে চার বছর। এখানে একজন গবেষককে মাস্টার্স প্রোগ্রামের তুলনায় অনেক বেশি সময় দিতে হয়। রাত-দিন খেটেও অনেক সময় গবেষকরা তাদের কাজ তিন থেকে চার বছরে শেষ করতে পারেন না। সময় বাড়াতে হয়।
আমাদের দেশে অনেক শিক্ষার্থী এমফিল বা পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হয় এবং তাদের অনেকে ডিগ্রিও পায়। কিন্তু, উপরে খাটা-খাটনির যে চিত্রটি তুলে ধরলাম, সে ধরনের একটি পরিবেশ কি আমরা এখানে তৈরি করতে পেরেছি? আপনি যদি চান, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ব্যাপক ভিত্তিতে উঁচুমানের গবেষণা হবে, তাহলে এই এরিয়াটাকে কীভাবে আরও অর্গানাইজ করা যায়, সেদিকে আপনাকে মনোনিবেশ করতে হবে। সংখ্যায় কম হোক, যে কয়জন গবেষক এমফিল বা পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হবেন, তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করুন, তাদের গবেষণা নিয়মিত মনিটর করুন, তাদের গবেষণাকর্মের মূল্যায়নের জন্য শক্তিশালী নিয়ম-কানুন ও বডি গঠন করুন।
এভাবে দিন শেষে একটিও যদি বিশ্বমানের কাজ বেরিয়ে আসে, সেটাই হবে অনেক বড় প্রাপ্তি। এখানে উল্লেখ করা দরকার, এমফিল বা পিএইচডি প্রোগ্রামে যারা ভর্তি হন, তাদের অনেকের পরিবার-পরিজন থাকে। আপনি যদি চান, গবেষক কোনোরূপ পিছুটান ছাড়াই পূর্ণ উদ্যমে তার গবেষণায় আত্মনিয়োগ করবে, তাহলে তার জন্য এমন পর্যায়ের বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তাকে আলাদাভাবে আয়-রোজগারের চিন্তা করা না লাগে। বিশ্বের সবখানেই, যেখানে অর্গানাইজড ফ্রেম-ওয়ার্ক আছে, এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়।
এমফিল বা পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণার ওপর যথাযথ গুরুত্ব আরোপ ও উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে আমাদের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যারা উচ্চতর গবেষণায় আগ্রহী, তাদের বেশিরভাগ বিদেশে পাড়ি জমায়। আমি এতে দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু, আমরা যদি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই লেভেলের গবেষণার জন্য একটি অর্গানাইজড স্ট্রাকচার গড়ে তুলতে পারি, তাহলে অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে যাওয়ার অপেক্ষায় বসে না থেকে এখানেই সক্রিয় হতো, তাদের মধ্যে হীনমন্যতা বোধ কাজ করত না।
দুর্ভাগ্যবশত, আমরা সে ধরনের পরিবেশ গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে, আমাদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে মূলত উন্নত বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ল্যাবরেটরিগুলোতে কাজ করার জন্য কাঁচামালের যোগান দেওয়া। অথচ এই ছেলে-মেয়েগুলোকে একই মানের কাজে গাইড করার মতো অনেক গবেষক আমাদের এখানে আছেন। একবার ভেবে দেখুন তো, এরকম শত শত মেধাবী তরুণ যদি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বসে বিশ্বমানের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করে, তাহলে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা কার্যক্রমের সামগ্রিক মান কোন পর্যায়ে উপনীত হতে পারে?
সবশেষে, আমাদের যেসব মেধাবী তরুণেরা উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসে না, তাদের বিষয়টি একটু বিবেচনা করা যাক। এটা কি শুধু স্বার্থপরতা? দেশপ্রেমের অভাব? উন্নত দেশের আলোক-ধাঁধানো জীবনের প্রতি আকর্ষণ?
হতে পারে, আবার নাও হতে পারে! অধ্যাপক মামুনের মতো আপনি এমন আরও অনেককেই পাবেন, যারা দেশের প্রতি টান অনুভব করে, দেশে ফিরে এসে নিজেকে দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে চান। কিন্তু, বুঝে উঠতে পারেন না, দেশে এসে তাদের মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী দেশকে সেবা দেওয়ার কতটুকু সুযোগ পাবেন। প্রত্যাশাটা হতাশায় রূপ নেবে না তো? কারণ যাই হোক, নিট ফল হচ্ছে, এদেশ যাদের কোলে-কাঁধে করে মানুষ করল, তাদের মেধা ও শ্রম নিয়োজিত হচ্ছে অন্য দেশের শোভা বর্ধনে। এ অবস্থার তো পরিবর্তন হওয়া দরকার। তাদের প্রত্যাগমনে উৎসাহিত করার জন্য আমরা কি কিছু করতে পারি?
লেখক: ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন, অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
muhsin_ju@yahoo.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
আরও পড়ুন:
বিশ্বের সেরা ২ শতাংশ বিজ্ঞানীর একজন জাবি অধ্যাপক ড. মামুন
বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন ড. এ এ মামুনের বিশেষ সাক্ষাৎকার
Comments