স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা যাবে না?

marital_rape-1.jpg

টাঙ্গাইলে ১৪ বছর বয়সী মেয়েটিকে যে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেটি তার বিয়ের ছবি দেখলেই যে কেউ বুঝতে পারবে। বিয়েটা ছিল তার কাছে আতংকের নাম। সাবালিকা কোনো মেয়ে যখন বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়িতে যায়, তখন তার মনে একদিকে যেমন স্বপ্ন, আনন্দ ও শিহরন থাকে, তেমনি থাকে ভয়। নতুন মানুষ, নতুন জীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ভয়। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য ও যৌন সম্পর্ক নারী-পুরুষ দুজনের জন্যই এক নতুন অভিজ্ঞতা।

এই কিশোরী মেয়েটির কাছে ছিল এই অভিজ্ঞতা আরও বেশি কিছু, আরও ভয়াবহ। তার চেয়ে ২০ বছরের বড় স্বামীর পাশে তাকে দেখাচ্ছিল ভয়ার্ত হরিণের মতো। সেই ভয়টিই সত্যি হয়েছিল মেয়েটির জীবনে। অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন সম্পর্কের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাকে শেষপর্যন্ত মারা যেতে হলো। হয়তো তার এই মৃত্যু এ দেশের অগণিত নারীর জীবনে কোনো শুভ পরিণতি বয়ে নিয়ে আসবে। তার এই অকালে ঝরে যাওয়া হয়তো নারীকে বৈবাহিক ধর্ষণের হাত থেকে মুক্তি দেবে?

কী জানি, কী হবে- কারণ এই দেশের শহর ও গ্রামের শতকরা ৬৩ ভাগ পুরুষ এখনো মনে করেন ‘সহবাসে রাজি না হলে বউকে মারাটা জায়েজ’। অন্যদিকে শতকরা ৬২ জন পুরুষ বিশ্বাস করেন যে ‘এমনও সময় আসে, যখন বউয়ের নিজের কাজের জন্যই তার মার খাওয়াটা উচিৎ হয়ে যায়’। ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ’র করা সাম্প্রতিক এক জরিপে এই ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে।

আমরা জানি যে, ৩ নভেম্বর হাইকোর্ট নারী ও ১৩ বছরের বেশি বয়সী কিশোরীদের বৈবাহিক ধর্ষণ অনুমোদনকারী আইনসমূহ, যা বৈষম্যমূলক এবং বিবাহিত নারী ও কিশোরীদের মৌলিক অধিকার সমতা (অনুচ্ছেদ ২৭), বৈষম্যহীনতা (অনুচ্ছেদ ২৮), আইনের সুরক্ষা (অনুচ্ছেদ ৩১), জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকারের সুরক্ষা (অনুচ্ছেদ ৩২) ক্ষুণ্ণ করে, তা কেন বাতিল হবে না এবং এই আইনসমূহ বাতিল করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কেন বিবাদীদের নির্দেশনা দেওয়া হবে না, তার কারণ দর্শানোর জন্য সরকারের প্রতি রুল  জারি করেছেন।

বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে নিষিদ্ধ হলেও বিশেষ ক্ষেত্রে ‘সর্বোত্তম স্বার্থে’ আদালতের নির্দেশে ও বাবা মায়ের সম্মতিতে যেকোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে হতে পারবে। আইনের এই ফাঁকটিরই যথেচ্ছ ব্যবহার করছেন অভিভাবকরা। কারণ আমাদের সমাজে এখনো ১১/১২ বছর বয়সের বিয়েটাকেই বাল্যবিয়ে বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ১৬ বছর পর্যন্ত শিশু। অথচ জাতিসংঘের হিসেবে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু। আবার বিয়ে হয়ে গেলে ১৩ বছর বয়সের স্ত্রীর সঙ্গে বাধ্যতামূলক যৌন সম্পর্ক করাটা বৈধ। আইনে বলা হচ্ছে, বিবাহিত সম্পর্কের মধ্যে কোনো স্বামী যদি ১৩ বছরের কোনো মেয়েকে নিজের স্ত্রী হিসেবে জোর করে যৌন সম্পর্কে বাধ্য করে, তবে সেই মেয়েটি ধর্ষণের কোনো মামলা করতে পারবে না এবং এর মাধ্যমে আমরা ১৩ বছরের একটি মেয়ের ধর্ষণকে বৈধতা দিচ্ছি।

যৌনাঙ্গে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে বাল্যবিয়ের শিকার ১৪ বছরের যে শিশু নিহত হয়েছে, তাতে আবার আমাদের সামনে উঠে এলো যে, কীভাবে আমরা আইন করে ধর্ষণকে বৈধ করেছি। দেশে বহু নারী বিয়ে পরবর্তী ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ৩৭৫ অনুযায়ী ধর্ষণের সংজ্ঞায় একটি ব্যতিক্রম যোগ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, নারীর বয়স ১৪ বছরের কম হলে তবেই তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। জেন্ডার বৈষম্যমূলক এই আইনের কারণে অধিকাংশ নারীই কোনো প্রতিকার পায় না। এখনই ৩৭৫ ধারার সংশোধন হওয়াটা জরুরি। কারণ এই ধারা সংবিধানে বর্ণিত ২৮, ৩১ ও ৩২ এবং ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর কারণে বহু নারী তার বিচারের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ধর্ষণসহ যৌন অপরাধের যে শাস্তির কথা কথা বলা হয়েছে, তাতে বিবাহিত নারী বিশেষ করে কোনো শিশুও যে ধর্ষিত হতে পারে, সে সম্পর্কিত কোনো কিছু লেখা নেই। এই ধারা অনুযায়ী, ‘কোনো স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর সঙ্গম বা সহবাস কখনো ধর্ষণ হতে পারে না, শুধুমাত্র স্ত্রীর বয়স ১৪ বছরের নীচে হলেই তা হবে ধর্ষণ।’ কোথাও বলা নেই, যদি কোনো বিবাহিত নারী বা শিশু স্বামীর সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে সহবাস করতে গিয়ে মারা যায়, সেক্ষেত্রেও কি ধর্ষণ মামলা হবে? বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের ৩৬টি দেশের একটি, যেখানে ১৩ বছরের একটি শিশুকে সহবাসে বাধ্য করা যায়।

২০১৯ সালে ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ ডিপার্টমেন্ট একটি জরিপে দেখেছে যে, উত্তরদাতাদের প্রায় কেউই বিয়ে পরবর্তী ধর্ষণকে নারীর প্রতি সহিংসতা বলে মনে করে না। মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ মনে করে যে, স্বামী দ্বারা স্ত্রী ধর্ষণের শিকার হতে পারে। আর তাই এই বিয়ে পরবর্তী ধর্ষণ বিষয়টি সম্পর্কে কেউ কথাও বলে না, কেউ অপরাধ বলেও মনে করে না। সমাজ মনে করে, নারীর শরীরের ওপর তার স্বামীর অধিকার আছে। স্বামী যখন ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা তার স্ত্রীকে ভোগ করতে পারে।

এমনকি এই ভয়াবহ মহামারি চলাকালেও মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত টেলিফোনের মাধ্যমে দেশব্যাপী সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন দেখেছে যে, নারী যে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, এর একটি বড় কারণ সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর শারীরিক সম্পর্ক করতে না চাওয়া। এসময়টা নারীর ওপর গৃহস্থালি কাজসহ সবধরনের কাজের চাপ অনেক বেশি ছিল। ছিল সাংসারিক অভাব-অনটন ও দুশ্চিন্তা। কিন্তু এরপরও স্বামী চাইতো স্ত্রী তার সঙ্গে মিলিত হোক। এই অভিযোগ অনেক স্ত্রীই করেছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, শতকরা ২৭.৩ শতাংশ নারীই বলেছেন, তারা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর জোরজবরদস্তির কারণেই  মিলনে বাধ্য হন।

মানুষকে বিয়ে পরবর্তী ধর্ষণ বিষয়টি বুঝানো খুবই কঠিন কাজ বলে মন্তব্য করেছেন ওয়ার্ল্ড ভিশনের একজন কর্মী। উনি বলেছেন, বাংলাদেশে মানুষকে বিয়ে পরবর্তী ধর্ষণ কথাটা বোঝানো খুব কঠিন। গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে তারা যখন অভিভাবকদের এই কথাটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, বিয়ের পর জোর করে  সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলে তা মেয়েদের শরীর ও মনের ওপর প্রভাব ফেলবে। তখন বাবা-মায়েরা বলেছেন, এই বিষয়ে তারা কোনো কথা শুনতে চান না। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সবই বৈধ। যতক্ষণ পর্যন্ত আইন সংশোধন না হবে এবং এ সংক্রান্ত প্রচারণা চালানো না হবে বা সামাজিক ট্যাবু ভেঙে দেওয়া যাবে না, ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ বলে গণ্য করাতো হবেই না, ধর্ষণ বলেও মনে করা হবে না।

অবশ্য আইনে আছে, যদি স্ত্রীর বয়স ১৩ বছরের ওপরে হয়, তাহলে একজন পুরুষ কখনোই তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে পারে না এবং এক্ষেত্রে নারীরা কোনো আইনগত সহায়তা পাবে না। যেমন পায়নি নাহিদ এবং শাম্মী। এই দুই মেয়ে নানাভাবে স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে এই সহবাসকে কেন্দ্র করেই, কিন্তু কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি।

যদিও আইনে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ১৪ বছরের কম বয়সী স্ত্রীর সঙ্গে  সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। কিন্তু একবারও ভাবা হয়নি একজন শিশু কীভাবে এই কাজে সম্মতি দেবে বা দেবে না? শিশুর পক্ষে সহবাস করা কি উচিৎ নাকি উচিৎ না? জীবনের বা সংসারের কোনো কিছু বোঝার আগে, যে মেয়েকে সহবাস বুঝতে হয়, যার শরীরের ওপর যে বয়স্ক স্বামী অত্যাচার করছে, সে তো এই কথা বুঝতেই পারবে না। যেমনটা বুঝেনি টাঙ্গাইলে রক্তক্ষরণে মৃত মেয়েটি।

আমাদের সমাজ এটা মানতেই চায় না বা কথা বলতেই চায় না স্বামী তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে পারে। কোনো মেয়ে যখন এটা নিয়ে কথা বলে, তখন তাকে রীতিমতো একঘরে করা হয়। বলা হয়, বিবাহিত জীবনে আবার ধর্ষণ কী? ম্যারিটাল রেপ নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদের নীচে মন্তব্যের ঘরে গিয়ে দেখলাম, অনেকেই হাসাহাসি করছে এই ইস্যুটা নিয়ে। অনেক পুরুষ বলছে স্ত্রীর সঙ্গে জোর করে সহবাস করলে, সেটা অপরাধ হতে পারে, কিন্তু তাই বলে ধর্ষণ হবে কেন? আমরা তো তাকে ধর্মমতে ও সামাজিকভাবে বিয়েই করেছি।

মূল সমস্যাটা হচ্ছেই এখানেই, এই ‘ধর্ষণ’ শব্দটার মধ্যে। আমরা ধর্ষণ বলতেই বুঝি স্বামীর বাইরের কোনো ব্যক্তি নারীকে ধর্ষণ করেছে। পরিচিত, অপরিচিত, পরিবারের সদস্য যে কেউ কিন্তু স্বামী নয়। কারণ স্বামী বিয়ে করার মাধ্যমে স্ত্রীর শরীরের ওপর মালিকানা লাভ করে। অথচ বৈবাহিক জীবনে ধর্ষণ একজন নারীর কাছে খুবই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। একজন অপরিচিত ব্যক্তির কাছে ধর্ষিত হওয়ার চেয়েও ভয়াবহ। একটি লেখায় দেখলাম, ড. ডেভিড ফিঙ্কলর, যিনি কাজ করছেন বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধে, তিনি বলেছেন, ‘যখন কোনো নারী অপরিচিত কোনো পুরুষ দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছেন, তখন তিনি খুব ভীতিজনক একটি স্মৃতি নিয়ে বাঁচেন। কিন্তু স্বামী দ্বারা ধর্ষণের শিকার হলে তার মনে হয় তিনি একজন ধর্ষকের সঙ্গে ঘুমাচ্ছেন।’

নারীর মাসিক চলাকালীন সময়ে, অসুস্থ শরীরে, গর্ভবতী অবস্থায়, অপারেশনের পর, বাচ্চা হওয়ার ঠিক পরপর স্বামী জোর করে  মিলনে বাধ্য করেছে এরকম বহু নজীর আছে। অধিকাংশ পুরুষের দিক থেকে ভাবাই হয় না যে, সহবাসের সময় স্ত্রীর অনুমতি নিতে হয় বা তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা জানতে হয়। তারা মনে করে, বিয়ের পর স্ত্রী তাদের সম্পত্তি। আইনটা পরিবর্তন হলে হয়তো অনেকেই বুঝতে পারবে স্ত্রীকে সহবাসে জোর করলে বা এর জন্য তার ওপর জুলুম করলে, সেটা ধর্ষণ হবে। আমাদের মতো দেশে অবশ্য এটা নিয়ে প্রচুর প্রচারণা চালাতে হবে।

ব্রিটিশ আমলের তৈরি এই আইনে স্ত্রীকে যথেচ্ছ ভোগ করার জন্য পুরুষকে দায়বদ্ধ করা ছিল অকল্পনীয়। স্বাধীনতার পর নারীর প্রতি সহিংসতা নিরোধের জন্য এই পর্যন্ত তিন বার বিশেষ আইন প্রণীত হয়েছে। কিন্তু, প্রতিবারই আমাদের আইন প্রণেতারা সজ্ঞানে দণ্ডবিধি থেকে বৈবাহিক ধর্ষণের এই ব্যতিক্রম ধারা বাতিলের পরিবর্তে বহাল রেখেছেন। অথচ ব্রিটিশরা কিন্তু সেই ১৯৯১ সালেই বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি পাকিস্তানও ২০০৬ সালে বৈবাহিক ধর্ষণের ওই ব্যতিক্রম ধারা বাতিল করেছে। (তথ্যসূত্র: তাকবির হুদা এবং অর্পিতা শামস মিজান)

বাংলাদেশের মেয়েরা আর কতদিন মেনে নিতে বাধ্য হবে যে, নূরনাহারের মতো কিশোরীরা যখন জবরদস্তিমূলক সঙ্গমে মারা যাচ্ছে, সেটা আসলে ধর্ষণ না, কারণ পুরুষটি মেয়েটির ‘স্বামী’। আর এসব ক্ষেত্রে সেই স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা যাবে না।

শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Anti-Discrimination Students Movement

Students to launch political party by next February

Anti-Discrimination Student Movement and Jatiya Nagorik Committee will jointly lead the process

10h ago