তিনি লেখার মান বিচার করতেন, লেখকের নাম নয়
তিনি নেই, তিনি চলে গেছেন। তবুও ‘কালি ও কলম’ প্রকাশিত হবে। যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ’র সাহিত্য সাময়িকী। কল্পনাই করা যেত না, তিনি ছাড়া সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী! তিন যুগেরও বেশি তিনি সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন। তারপর যোগ দিয়েছেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ সাহিত্য পত্রিকা ‘কালি ও কলমে’। সেখানেও প্রায় দুই যুগ কাটিয়ে বিদায় নিলেন, চলে গেলেন।
বলছি আবুল হাসনাতের কথা। সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত। চলে যাওয়ার পর তার সম্পর্কে লেখা হচ্ছে ‘কালি ও কলম’ সম্পাদক আবুল হাসনাত। কিন্তু ধারণা করি তিনি জীবন্ত হয়ে থাকবেন সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক পরিচয়েই।
আবুল হাসনাতের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৭ জুলাই, পুরান ঢাকায়। চলে গেলেন ৭৫ বছর বয়সে ১ নভেম্বর, ২০২০ এ। ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে তিনি ভারতে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রাখেন।
জীবনকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করে গেছেন। অপচয় বা অপব্যয় করেননি জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়কে। তার স্ত্রী নাসিমুন আরা হক পেশায় সাংবাদিক। একমাত্র মেয়ে দিঠি হাসনাত আমেরিকা প্রবাসী।
আনিসুজ্জামান, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকের মতো বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকেরা সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীকে উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন বছরের পর বছর। যার নেপথ্যে ছিল একজন সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাতের অবদান। এই লেখা যারা পড়ছেন, হয়ত তাদেরও অনেকের চোখের সামনে ভাসছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘হৃৎকলমের টানে’। যা ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন আবুল হাসনাতের সম্পাদনায় সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে। এমন আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ লেখক বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছেন। যার নেপথ্যের প্রেরণা হয়তো ছিলেন আবুল হাসনাত। তার সম্পাদনায় সাহিত্য পত্রিকা ‘কালি ও কলম’ দুই যুগ ধরে মান বজায় রেখে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পাদক নিয়ে কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবে সামনে আসে আহসান হাবীবের নাম। তা সত্ত্বেও আবুল হাসনাতের সম্পাদনায় সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী এক অনন্য নজীর ও স্থান দখল করে রেখেছে। শ্রেষ্ঠত্বের আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক সবকালে ছিল, থাকবে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর নাম, মর্যাদা-গুরুত্ব আলাদা করেই আলোচিত হবে। সেই আলোচনার আলোকিত নক্ষত্র হয়ে থাকবেন আবুল হাসনাত।এদেশের পাঠক রুচি নির্মাণে যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
আবুল হাসনাতের কাজের মগ্নতা, কাজের পরিচ্ছন্নতা সহকর্মীদের মুগ্ধ করতো। দেশের সবচেয়ে প্রখ্যাত লেখকেরাও তার সম্পাদকীয় বিবেচনাবোধকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। এর প্রধান কারণ তিনি ত সম্পাদক হিসেবে সর্বমহলে এই আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তিনি লেখার মান বিচার করেন লেখকের নাম বিচার করেন না। বড় লেখক বা বন্ধু লেখক কখনও তার থেকে বাড়তি সুবিধা পাননি। আবার লেখক হিসেবে প্রখ্যাত নন এমন অনেকে লেখার মান বিবেচনায় অত্যধিক গুরুত্ব পেয়েছেন।
আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণসহ ষাটের দশকের কবি- সাহিত্যিকদের প্রায় সবাই তার বন্ধু, ঘনিষ্ঠজন। তিনি কবিতা লিখতেন মাহমুদ আল জামান নামে। আবুল হাসনাত দেশের অন্যতম শিল্প সমালোচক-লেখক। দেশের প্রধান চিত্রশিল্পীদের প্রায় সবাই তার বন্ধুস্থানীয়। কিন্তু তিনি শিল্প সমালোচনা লেখার ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত নির্মোহ। সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর অন্যতম বিষয় ছিল শিল্প সমালোচনা। ধারণা করা হয় আবুল হাসনাতকে অনুসরণ করেই এদেশের সাহিত্য পাতায় শিল্প সমালোচনা স্থান পেয়েছে। শিল্প সমালোচনা ও শিল্প সংগ্রহ ছিল তার প্রিয় বিষয়। বহু শিল্পকর্মের সংগ্রাহক তিনি।
জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, কোনো একদিন ভুবনডাঙ্গায়, ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়, টুকু ও সমুদ্রের গল্প, যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুরে, রানুর দুঃখ-ভালোবাসা, রবীন্দ্র-চিত্রকলা, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, জীবনানন্দ দাশ: জন্মশতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ, স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা, প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য, হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে, ছোটদের আব্রাহাম লিংকন তার লেখা ও সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
তিনি কথা বলতেন কম, অপছন্দ করতেন স্তুতি। দরকারি কথা বলেই ফোন রেখে দিতেন। ওপাশ থেকে হয়তো আরও কিছু বলতে চাইছিলেন, তার আগেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতেন। সারা জীবন অন্যের লেখার মান বিচার করেছেন। অন্য সব সাহিত্য সম্পাদকদের মতো তার সম্পর্কেও বলা হয়, নিজের লেখায় অতটা মনোযোগ দিতে পারেননি। তিনি ছিলেন ছায়ানটের অন্যতম সংগঠক ও সদস্য।
কাজের প্রতি আবুল হাসনাতের নিবিষ্ট থাকার ছোট্ট একটি ঘটনা বলে শেষ করবো। ২০০৭ বা ২০০৮ সালে একই সঙ্গে নিউইয়র্ক যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সঙ্গী আরও কয়েকজন লেখক-সম্পাদক ছিলেন। প্রায় ১৮ ঘণ্টার বিমানযাত্রায় সবাই গল্পে মেতে থাকলেও, তিনি নিবিষ্ট মনে পড়ছিলেন। কিছু জানতে চাইলে এক বা দুই বাক্যে উত্তর, তার বেশি নয়। দু’দিনব্যাপী ফোবানা সম্মেলন চলাকালীন অনেকেই বিভিন্ন দিকে ঘুরতে গিয়েছিলেন। তাকেও কয়েকজন স্বজন বা বন্ধু ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে এসেছিলেন। ‘যে কাজে এসেছি, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না’-এই ছিল তার দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি যাননি। সম্ভবত আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সম্মেলন চলাকালীন কোথাও ঘুরতে বের হননি।
Comments