নারী গৃহশ্রমিকের জীবন ও সম্মানের বিনিময়ে রেমিট্যান্স নয়
ছোট্ট নদীর জীবনটা নদীতেই ভেসে গেল। সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায় যে মেয়েটিকে দালালের মিথ্যা প্ররোচনায় সৌদি আরবে পাঠিয়েছিল পরিবার, আজ তারাই শাহজালাল বিমানবন্দরে কিশোরী মেয়ের মরদেহ নিয়ে কাঁদছেন। ১৩ বছরের এই কিশোরীকে গতবছর সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছিল। কাগজপত্রে আত্মহত্যা বলা হলেও, তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে তার পরিবার মনে করছে।
নদীর মায়ের মতোই আরেকদিন কেঁদেছিলেন নাছিমা বেগম, সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা কিশোরী কুলসুমের মরদেহ নিয়ে। ২০১৬ থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৭৩ নারীর মরদেহ দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে ১৭৫ জনের মরদেহ এসেছে সৌদি আরব থেকে। বলা হচ্ছে এদের মধ্যে ৫১ জনই আত্মহত্যা করেছেন।
চলতি বছর করোনার কারণে নিয়মিত বিমান চলাচল বন্ধ থাকলেও থেমে থাকেনি মরদেহ পরিবহন। এই বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিদেশ থেকে অন্তত ৬৩ জন নারীর মরদেহ দেশে ফেরত এসেছে। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকেই এসেছে ২২ জনের মরদেহ। এ ছাড়া, লেবানন থেকে ১৪, জর্ডান থেকে ১১, ওমান থেকে সাত, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে চার জনের মরদেহ এসেছে।
শুধু ভাবুন আপনার কোলে থাকা মেয়েটি কোথাও কাজ করতে এরকম নির্মমতার বলি হচ্ছে। আপনার মনের অবস্থা তখন কেমন হতো? এভাবে মৃত্যু মিছিলের কথা শুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ তাদের মেয়েদের সৌদিতে পাঠাচ্ছে মৃতদেহ হয়ে ফিরে আসার জন্য। নদী, নাজমা, কুলসুম বা ফরিদা বা কেয়া এরা শুধু নামেই আলাদা। কিন্তু এদের প্রতি নির্যাতনের ধরন এক, এদের মৃত্যুর কারণও এক, দালালদের খপ্পড়ে পড়ার পদ্ধতিও এক, নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরে আসার পর, তাদের প্রতি লাঞ্ছনার চিত্রও এক এবং সর্বোপরি তাদের প্রতি বিচারহীনতার সংস্কৃতিও এক।
নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। গত চার বছরে অন্তত ১০ হাজার নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে গত বছরের আগস্টে একটি প্রতিবেদন পাঠায় মন্ত্রণালয়। তাতে সৌদি আরব ফেরত ১১০ নারী গৃহকর্মীর তথ্য দিয়ে বলা হয়, ৩৫ শতাংশ নারী শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। ৪৪ শতাংশ নারীকে নিয়মিত বেতন দেওয়া হতো না। গত বছর সৌদি আরবের সঙ্গে যৌথ কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশ নিপীড়নের বিষয়টা তুলে ধরেছিল কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এরপরও লাশ হয়ে ফিরছে আমাদের মেয়েরা।
ঠিক বুঝতে পারছি না বাংলাদেশ সরকার সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী গৃহশ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি কেন এখনো গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে না? কেন কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না নারী গৃহ শ্রমিকদের হয়রানি ঠেকানোর জন্য? বাংলাদেশী নারীরা বারবার যৌন নির্যাতনসহ নানাভাবে নিপীড়িত হওয়ার পরও তাদের বাঁচানোর জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে কেন প্রতিকার চাওয়া হচ্ছে না?
এতো অভিযোগ, এত অত্যাচার, এত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, সংবাদমাধ্যমে খবর হয়ে আসছে বছরের পর বছর, অথচ সরকার নির্বিকার। যে এজেন্সিগুলো মানুষের দারিদ্র্য ও সরলতার সুযোগ নিয়ে মেয়েদের নোংরা কতগুলো মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? এই মানুষগুলো দরিদ্র ও অসহায় বলে? নাকি এদের হয়রানির মাধ্যমে পুরুষ শ্রমিকদের অভিবাসনের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে বলে? এর মানে কি এই দাঁড়ায় না যে, আমরা নারী শ্রমকে অন্যায়ভাবে বিক্রি করছি? ২০১৫ সালে সৌদি সরকারের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে তাতে নারী গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও আইনি বিষয়গুলোতে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি এবং এখনো দেওয়া হচ্ছে না।
আসলে নারী গৃহশ্রমিক পাঠানোর পাশাপাশি সরকার সুযোগ পেয়েছে পুরুষ শ্রমিক পাঠানোর। একজন নারী গৃহশ্রমিকের সঙ্গে দুজন পুরুষ শ্রমিক যেতে পারে। প্রথমদিকে প্রবাসে নারী শ্রমিকের দেখাশোনা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকার নিলেও, পরবর্তীতে এই দায়িত্ব বিভিন্ন এজেন্সির হাতে চলে যায়। এরা সুয়োগ পেয়ে টাকার জন্য ভাল-মন্দ কোনোকিছু না ভেবে মেয়েদের সৌদি আরবে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
নিয়োগকর্তা হিসেবে সৌদিরা এতটাই বর্বর ও অত্যাচারী যে ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন সৌদি আরবে বহু আগেই নারী গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। আর আমরা যেকোনো মূল্যে সেই বাজারে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। আমাদের মেয়েদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের চাই না। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো নারী গৃহকর্মী, যারা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে আসে, তারা কিন্তু একটি টাকাও সঙ্গে আনতে পারে না। শুধু কষ্টটাই সঙ্গে করে নিয়ে আসে। দেশে সমাজও তাকে গ্রহণ করে না।
তবে এটাও ঠিক যে সব নিয়োগকর্তা এক নয়। অনেকে বেশ ভালো। গতবছর মদীনা বিমানবন্দরে আমি নিজে ১০/১২ জন বাংলাদেশি নারীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, যারা সবাই খুব ভালো নিয়োগকর্তার কাছে ছিলেন। ওনারা দুই বছর পর দেশে ফিরছেন। আবার ফিরে আসবেন এখানেই কাজ করতে। অথচ মদীনা থেকেই লাশ হয়ে ফিরেছেন আরেক নারী কর্মী। ১০০ জন ভালো থাকলেও পাঁচ জন যে খারাপ আছে, এটা মেনে নেয়াও তো কষ্টকর। কল্পনাও করা যায় না ১৩ বছরের একটি মেয়ে কী করে বিদেশে যাচ্ছে, কীভাবে তার পাসপোর্ট হচ্ছে, এজেন্সি, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কী করছে সেগুলো তদন্ত করে দেখা দরকার। অন্তত ৪/৫টি ঘটনা তদন্ত করে দেখলেও বোঝা যাবে মূল সমস্যাটা কোথায়?
সৌদি আরবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো একটি বিতর্কিত স্পনসরশিপ প্রোগ্রাম চালু আছে। যাকে বলে ‘কাফালা পদ্ধতি’। এই কাফালা পদ্ধতির কারণে অভিবাসী শ্রমিকরা হয়ে যায় চাকুরিদাতা মালিকের সম্পত্তি। যখনই একজন অভিবাসী শ্রমিক চাকরি নিয়ে এমন কোনো দেশে প্রবেশ করে, যেখানে কাফালা পদ্ধতি চালু আছে, তখনই সে হয়ে যায় নিয়োগকর্তার সম্পত্তি। মালিক তাদের পাসপোর্ট নিয়ে নেয় এবং তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। এই অবস্থার মধ্যে পড়ে অভিবাসী শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার বলতে আর কিছু থাকে না। সব ধরনের বিচার পাওয়ার সুযোগও কমে যায়।
সরকারের উচিৎ খুব দ্রুত সৌদি সরকারের সঙ্গে নারী গৃহকর্মীদের সুরক্ষা বিষয়ে আলোচনায় বসা। তাদের কঠিনভাবে বলে দেওয়া উচিৎ যে আমাদের মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে আমরা সেই দেশে নারী শ্রমিক পাঠাবো না। কেন আমাদের মেয়েদের যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে হাত-পা, কোমর ভেঙে দেওয়া হয়, চোখ নষ্ট করে দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যাওয়া হয়? তাদের অনেককে বেতন না দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।
আমরা আশা করব সরকার সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানোর সময় সবচেয়ে আগে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আমরাও চাই আমাদের মেয়েরা কাজ নিয়ে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ুক। রেমিট্যান্স আয়ে পুরুষের পাশাপাশি তাদেরও ভূমিকা থাকুক। কিন্তু এর বিনিময়ে কোনোভাবেই নারীর অমর্যাদা আমাদের কাম্য নয়। নারী যেখানেই, যে দেশেই কাজ করুক, তাকে অবশ্যই নিরাপত্তা দিতে হবে। সৌদি সরকারের সঙ্গে এই কথা স্পষ্ট করে বলে নিতে হবে, আমাদের দেশের মেয়েরা সেখানে কাজ করতে যায়, যৌনবৃত্তি করতে নয়।
নারী গৃহকর্মীদের জন্য এর চেয়ে অনেক ভালো ও সভ্য শ্রমবাজার হতে পারে হংকং, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপ। আমাদের উচিৎ হংকং বাজারকে চাঙ্গা করা। সিঙ্গাপুরের হারানো বাজার উদ্ধার করা। অষ্ট্রেলিয়াতে গৃহশ্রমিকের চাহিদা আছে। তবে এজন্য কিছু শর্ত পূরণের ব্যাপার আছে বাংলাদেশের জন্য। অন্যান্য কয়েকটি দেশ ইউরোপে গৃহশ্রমিক পাঠায়। তাহলে আমরা কেন এই বাজার অনুসন্ধান করছি না? এসব দেশে আইনের শাসন আছে, নারীবান্ধব পরিবেশ আছে।
মানব সম্পদ উন্নয়নের কোনোকিছুর সঙ্গে জড়িত না থেকেই শুধুমাত্র ইচ্ছার উপর ভর করে আমি আমার বাসার তিন জন নারী গৃহকর্মীকে হংকং ও একজনকে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়েছি। তাদের তিন জন এসে আবার কনট্রাক্ট নবায়ন করে গেছে। ওদের বেতন প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। থাকা খাওয়া, আসা-যাওয়া সব ফ্রি। সেখানে তারা থাকে মানুষের পরিচয়ে, সম্মানের সঙ্গে। কী সুন্দর লাগে ওদের দেখলে। ফিটফাট, স্মাট, হাসিখুশি জীবন। একা একা কোন অচেনা মুল্লুকে গিয়ে কাজ করে টিকে যাচ্ছে ওরা। এবং এটা সম্ভব হয়েছে ওরা সভ্য দেশে গেছে বলেই।
শিল্পী, চম্পা, সুলতানা ও রুপা নারী হয়েও অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে সফল হয়েছে। মনোবল, স্মার্টনেস, ভালো এজেন্সির সহায়তা পেলে, নিয়ম মেনে বিদেশ গেলে এবং ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে আমরা ওদের পাশে দাঁড়ালে, অনেকেই এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারবে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন সরকারের সহায়তায় অনেকজন নারী কেয়ার গিভার তৈরি করেছে, যারা জাপানে যাওয়ার জন্য টিকেট হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছেন। করোনার কারণে যাওয়া হচ্ছে না। এরা যাতে করোনার পরপরই জাপানে যেতে পারেন, সেদিকে সরকারের তদবির চালাতে হবে। সরকারের উচিৎ সৌদি আরব বাদ দিয়ে সভ্য দেশে নারী গৃহশ্রমিক ও কেয়ার গিভার পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া।
যখন দেখি আমার দেশের খুব সাধারণ একজন নারী বা পুরুষ বিদেশের মাটিতে নিজ উদ্যোগে, সাহস করে, কষ্ট সহ্য করে দাঁড়িয়ে গেছে এবং তাদের আয়ের টাকায় আমার দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে – তখন বুকটা গর্বে ভরে ওঠে। স্যালুট জানাই আমার দেশের সব অভিবাসী ভাই ও বোনদের। আপনাদের কাছে আমরা ঋণী। কারণ আপনাদের কারণেই ২০২০ সালে বেশির ভাগ দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে ধস নামলেও, বাংলাদেশের রেমিট্যান্স বেড়ে প্রবাসী আয়ে বিশ্বে অষ্টম অবস্থানে উঠেছে, এই আশার কথাটি জানিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments