তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া

‘সবার জন্যে ভ্যাকসিন’ স্লোগান ও বাংলাদেশের সক্ষমতা

বাংলাদেশের সব নাগরিককে বিনামূল্যে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া হবে, আজকের ডেইলি স্টারে আশা-জাগানিয়া এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে। গত ৩ অক্টোবর ডেইলি স্টার সংবাদ প্রকাশ করেছিল, ‘বিনামূল্যে করোনা ভ্যাকসিন পাবেন জাপানের সব নাগরিক’।
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশের সব নাগরিককে বিনামূল্যে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া হবে, আজকের ডেইলি স্টারে আশা-জাগানিয়া এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে। গত ৩ অক্টোবর ডেইলি স্টার সংবাদ প্রকাশ করেছিল, ‘বিনামূল্যে করোনা ভ্যাকসিন পাবেন জাপানের সব নাগরিক’।

পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ জাপান তার ১২ কোটি ৪০ লাখ নাগরিককে ৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করে ভ্যাকসিন দিবে। বাংলাদেশ জাপানের তুলনায় বহুগুণ পিছিয়ে থাকা অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও, তার ১৬ কোটি ৬৫ লাখ নাগরিককে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। এর জন্যে খরচ হবে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার। ডেইলি স্টারই প্রথম সংবাদ প্রকাশ করে জানিয়েছিল বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাপানের কাছে করোনা ভ্যাকসিন কেনার জন্যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা চেয়েছে। এটা ঋণ না অনুদান তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এখন বাংলাদেশ করোনা ভ্যাকসিন কেনার জন্যে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থার কাছে দুই বিলিয়ন ডলার স্বল্প সুদের ঋণ চাইছে।

এই ঋণ পাওয়া অসম্ভব নয়। প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়, ঋণ বাংলাদেশ পেয়ে যাবে। অর্থাৎ করোনা ভ্যাকসিন কেনার জন্যে যে অর্থ প্রয়োজন, তা বাংলাদেশের জোগাড় হয়ে যাবে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে তিনটি প্রশ্ন:

ক. বাংলাদেশ পৃথিবীর কোন দেশ বা প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাকসিন কিনবে?

খ. ভ্যাকসিন কিনে আনা ও পুরো ব্যবস্থাপনার বিষয়টি কেমন?

গ. ভ্যাকসিন কার বা কাদের প্রয়োজন?

রাশিয়া, চীন, আমেরিকা, জার্মানি, ভারতসহ পৃথিবীর যেসব দেশ ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের কাজ করছে, তাদের কিছু তথ্য জানা যাচ্ছে। যদিও সেসব তথ্যে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না যে, ভ্যাকসিন কবে বাজারে আসবে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বছরের শুরুতে দুটি বা তিনটি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিন বাজারে আসবে। ইতোমধ্যে রাশিয়া তার ভ্যাকসিন সাফল্যের যে দাবি করছে, তা ইউরোপ বা আমেরিকা মানতে চাইছে না।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, যে দেশ বা প্রতিষ্ঠান আগে ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে, বাংলাদেশ তাদের থেকেই ভ্যাকসিন কিনে আনবে।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠন করা বিশেষজ্ঞ কমিটির কোনো সদস্য নাম প্রকাশ করে এ বিষয়ে কথা বলতে চান না। করোনা ভ্যাকসিনের খোঁজ-খবর রাখা একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলছিলেন, ‘করোনা ভ্যাকসিন এমন পণ্য না যে টাকা থাকলেই কিনে আনা যাবে। যেসব প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন উৎপাদনের সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছেছে, তাদের ভ্যাকসিন ইতোমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাকসিন কিনে আনার সুযোগ নেই। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়ার জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ভারতসহ আরও কিছু দেশ উৎপাদনের আগেই অগ্রিম অর্থ দিয়ে ভ্যাকসিন কিনে ফেলেছে। বাংলাদেশ কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেনি, অগ্রিম অর্থ দেয়নি। সুতরাং উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষে ভ্যাকসিন পাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশের ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্যে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে, তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না।’

আরেকজন সদস্য বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পেরে চীনের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের সুবর্ণ সুযোগ হারিয়েছে। দেশে চীনের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করতে পারলে সহজে ভ্যাকসিন পাওয়া নিশ্চিত হতো। বাংলাদেশ হয়তো ভারতের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল করতে পারবে। কিন্তু, নিজেদের ভ্যাকসিন উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভারত এখনো অনেক পিছিয়ে আছে।’

এবার আসি ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করতে হবে হিমশীতল বা কোল্ড চেইন ব্যবস্থাপনায়। কোনোটি সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ১৮, কোনোটি মাইনাস ১৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায়।

বাংলাদেশে এই কোল্ড চেইন ব্যবস্থাপনা সরকারি দু-একটি প্রতিষ্ঠানে সীমিত পরিসরে আছে। বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির কিছু আছে। আইসিডিডিআর,বির আছে। ওষুধ নিয়ে কাজ করে না এমন আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আছে। কিন্তু, পর্যাপ্ত সংখ্যক ভ্যাকসিন সংরক্ষণের কোল্ড চেইন ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের নেই।

ঢাকা থেকে সারা দেশে বিতরণের জন্যে যে ধরনের কোল্ড চেইন সিস্টেমের গাড়ি দরকার, তা বাংলাদেশে নেই। ঢাকার বাইরে প্রায় কোথাও সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনা তো নেই-ই।

একজন বিশেষজ্ঞ বলছিলেন, ‘ভ্যাকসিন কেনা, সংরক্ষণ, বিতরণের বিষয়গুলো নিয়ে তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করে না। ভ্যাকসিন কিনে আনার আগে তো সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। ভ্যাকসিন কোল্ড চেইন থেকে বের করে সাধারণ ঠান্ডায় হয়তো এক-দুই ঘণ্টা সংরক্ষণ করা যায়। তার চেয়ে বেশি সময় কোল্ড চেইনের বাইরে রাখলে তো কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাবে। সারা দেশে আগে কোল্ড চেইন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। কোল্ড চেইন পরিবহন লাগবে। এর জন্যে তো কমপক্ষে ছয় মাস সময় দরকার। এসব নিয়ে কোনো কাজ বা উদ্যোগ আছে, এমন কোনো তথ্য জানা নেই।’

ভ্যাকসিন কার বা কাদের দরকার, তিন নম্বর প্রসঙ্গে কিছু কথা। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তির শরীরে কমবেশি ১৪ বা ২১ দিনে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। অ্যান্টিবডি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। করোনার ভ্যাকসিনও মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। যারা ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের সবার শরীরে কমবেশি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। যাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তাদের ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ড. বিজন কুমার শীলসহ বাংলাদেশের আরও অনেক বিশেষজ্ঞ একথা বারবার বলেছেন। তা ছাড়া, এই তথ্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতও।

একারণেই বাংলাদেশের সব নাগরিকের করোনা ভ্যাকসিন দেওয়ার চিন্তার আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার যে, কত শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বা কত শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। সরকারের বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যরা বারবার দেশে অ্যান্টিবডি পরীক্ষার তাগিদ দিয়েছেন। কিন্তু, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেদিকে মনোযোগী হয়নি। এরমধ্যে আইসিডিডিআর,বি একটি গবেষণা করে জানালো যে, ঢাকার ৪৫ শতাংশ এবং বস্তির ৭৪ শতাংশ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। সেই গবেষণা তথ্য প্রকাশ করা অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, আইইডিসিআর’র পরিচালকসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকলেন। গবেষণার ফলাফলকে স্বাগত জানালেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আইসিডিডিআর,বি ও সরকারকে সেই ফলাফলকে প্রায় অস্বীকার করতে দেখা গেল। বলা হলো, এই ফলাফল ঢাকার সামগ্রিক চিত্র নয়। তাহলে এত বড় করে গবেষণা তথ্য প্রকাশ করা হলো কেন?

মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও ইউএসএআইডির অর্থায়নে এই গবেষণা হয়েছে বলে জানানো হলো। কত হাজার বা লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে এই গবেষণায়, জানা যায়নি। কোনো বিশেষ ব্যক্তি না আইসিডিডিআর,বি পেয়েছিলেন এই অর্থ, তাও জানা যায়নি।

সরকার নিজে অ্যান্টিবডি পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়নি। নেবে বলেও জানা যায়নি। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত অ্যান্টিবডি কিটের অনুমোদন মেলেনি।

বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ভ্যাকসিন কেনার জন্যে অর্থ জোগাড় করা দরকার। তবে, তারচেয়ে বেশি দরকার অগ্রাধিকার-ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে তিনটি কাজ একইসঙ্গে এখনই শুরু করা। ভ্যাকসিন কেনার জন্যে এখনই অগ্রিম অর্থ দিয়ে চুক্তি করা জরুরি। ১৬ কোটি মানুষের ভ্যাকসিন একবারে কেনা যাবে না। পর্যায়ক্রমে কিনতে হবে।

যত দ্রুত সম্ভব দেশজুড়ে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা শুরু করা দরকার। তাহলে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে এমন জনসংখ্যাকে বিবেচনার বাইরে রেখে ভ্যাকসিন সংগ্রহের পরিমাণ নির্ধারণ করা যাবে। এতে সরকারের চাপ অনেক কমে যাবে। অনেক কম অর্থ ব্যয় হবে। ভ্যাকসিন সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্যে দেশজুড়ে কোল্ড চেইন সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। গাড়ি কিনতে হবে।

এক্ষেত্রে করোনা মহামারিকালেও স্বাস্থ্য খাতে যে অনিয়ম-দুর্নীতি দৃশ্যমান হয়েছে, তা সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। ঋণ করে আনা দুই বিলিয়ন ডলার যেন স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির সাগরে তলিয়ে না যায়।

s.mortoza@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh approves export of 3,000 tonnes of hilsa to India for Durga Puja

The government has approved the export of 3,000 tonnes of hilsa fish to India on the occasion of Durga Puja, the commerce ministry said in a statement today

3h ago