ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা কেন?
আপনারাই বলেন, ‘ধর্ষক যেই হোক তার বিচার হবে। নিজেদের দলের হলেও ছাড় দেওয়া হবে না।’
তাহলে, ফেনীতে ধর্ষণবিরোধী লংমার্চে হামলা হলো কেন?
তারচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, হামলা করলো কারা?
হামলার পর লংমার্চে অংশগ্রহণকারী বাম ছাত্র সংগঠনের নেতারা অভিযোগ করেন, পুলিশ-গোয়েন্দা পুলিশ-ছাত্রলীগ সম্মিলিতভাবে লংমার্চে অংশগ্রহণকারীদের ওপর হামলা করেছে।
এই অভিযোগের জবাবে ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘ওই রকম হামলা না। সমাবেশের শেষ পর্যায়ে সামান্য হাতাহাতি হয়েছে। সমাবেশে স্থানীয় সংসদ সদস্যের তিনটি ছবি ছিল। যেখানে তাকে কটূক্তি করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে সংসদ সদস্যের সমর্থকরা মিছিল করে। সে সময় লংমার্চে অংশগ্রহণকারীরা তাদের দিকে তেড়ে যায়। এতে সামান্য হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।’ (দ্য ডেইলি স্টার, ১৭ অক্টোবর ২০২০)।
লংমার্চে অংশগ্রহণকারীদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হলো, মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হলো- অথচ পুলিশ বলছে সামান্য হাতাহাতি!
চৌমুহনী লাইফ কেয়ার হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. রাকিব উদ্দিন ৩৫ জনের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার কথা স্বীকার করে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আহতদের বেশিরভাগের অবস্থা বেশ গুরুতর। আহতদের মাথা, হাত, পা ও শরীরের বিভিন্নস্থানে আঘাতে গুরুতর জখম হয়েছে। অনেকের হাত ও পা ভেঙে গেছে।’
মারা না গেলে বা হত্যা না করা পর্যন্ত যেন কোনোকিছুই বড় ঘটনা না। এসআই আকবর যদি পিটিয়ে মেরে না ফেলত, সেটাকেও হয়তো সামান্য ঘটনাই বলা হতো।
এরপর এই ‘সামান্য হাতাহাতি‘র কিছু স্থির ও ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেখানে দেখা যায় পুলিশ এবং সাধারণ পোশাক পরিহিতরা লাঠি হাতে লংমার্চে অংশগ্রহণকারীদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ছবিতে পুলিশের পোশাক পরিহিতদের সঙ্গে সাধারণ পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশের উপস্থিতি বোঝা যায়। তার বাইরে আরও অনেককে দেখা গেছে। যারা লাঠি হাতে মারমুখী ছিলেন!
এই ছবির বিষয়ে পুলিশের ব্যাখ্যা, ‘লংমার্চে অংশগ্রহণকারীরা স্থানীয় সংসদ সদস্যকে নিয়ে কটূক্তি করলে তার সমর্থকরা লাঠি হাতে মারমুখী অবস্থান নেয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশও অবস্থান নেয়। পুলিশ সংসদ সদস্যের সমর্থকদের সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে লংমার্চে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।’ (ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাইনুল ইসলাম, দ্য ডেইলি স্টার, ১৭ অক্টোবর ২০২০)।
বেগমগঞ্জের ধর্ষক-সন্ত্রাসী দেলোয়ার বাহিনী যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠেছে, সেই সংবাদ গত কয়েকদিনে প্রায় সব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। টেলিভিশনেও প্রচার হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ক্ষমতাসীন দলের নেতা। সেই সংসদ সদস্যের বিচার চাওয়া হলে, প্লাকার্ড লেখা হলে অথবা শ্লোগান দিয়ে বিচার চাইলে বা ধর্ষক-সন্ত্রাসীর মদদদাতা বললে, পুলিশ সেটাকে ‘কটূক্তি’ মনে করবে কেন? আন্দোলনকারীরা বলেছেন আর তা প্রমাণ হয়ে গেছে, বিষয়টি তো তেমন নয়। সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ যদি সত্য না হয়ে থাকে, তাহলে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তা জনগণকে জানানো যায়।
নির্বাচন যেমনই হোক সংসদ সদস্য জনপ্রতিনিধি। জনগণ তার প্রতিনিধির কোনো কর্মে বা অপকর্মে বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ করবেন, এটা জনগণের অধিকার। সেই অধিকার কেউ হরণ করতে চাইলে, পুলিশের দায়িত্ব তা প্রতিরোধ করা। অর্থাৎ পুলিশের অবস্থান থাকবে জনগণের পক্ষে। আমরা জানি বাংলাদেশে তা থাকে না। প্রশ্ন হলো, থাকবে না কেন?
আলোচনা করে মীমাংসার জন্যে লাঠিধারী এমপি সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে পুলিশ লংমার্চকারীদের কাছে গেল। এমপির লাঠিধারী সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে কেন পুলিশকে লংমার্চকারীদের কাছে যেতে হলো? ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে লংমার্চকারীদের বাসে হামলা করছে লাঠিধারীরা। পুলিশ এসব হামলাকারীদের গ্রেপ্তার তো করেইনি, হামলার শিকার আন্দোলনকারীদের রক্ষারও চেষ্টা করতে দেখা যায়নি।
এখানে তো পক্ষ থাকার কথা তিনটি। এক, লংমার্চে অংশগ্রহণকারীরা। দুই, ছাত্রলীগ-এমপি সমর্থকরা। তিন, পুলিশ-গোয়েন্দা পুলিশ।
এক আর দুই মুখোমুখি হলে, তিন নম্বর অবস্থানে থাকা পুলিশের চেষ্টা থাকবে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া থেকে দুই পক্ষকে বিরত রাখা। এখানে পুলিশ এবং এমপি সমর্থকরা এককে পরিণত হয়েছেন। ছবি তেমনই প্রমাণ করছে। ছবি প্রমাণ করছে না যে, লংমার্চে অংশগ্রহণকারীরা ‘তেড়ে’ গিয়েছিলেন। ছবি প্রমাণ করছে না যে, প্রতিবাদকারীদের হাতে লাঠি ছিলো। শুধু এই ছবি নয়, এখন পর্যন্ত প্রকাশিত কোনো ছবিতেই তেমন প্রমাণ নেই। তাছাড়া খালি হাতের বাম ছাত্র সমগঠনের নেতাকর্মীরা লাঠিধারী এমপি সমর্থকদের দিকে ‘তেড়ে’ যাবেন, কারো কাছেই সম্ভবত তা বিশ্বাসযাগ্য নয়।
রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে ধর্ষক-সন্ত্রাসী তৈরি হচ্ছে। কখনো তারা সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করছে, কখনো পিটিয়ে মানুষ হত্যা করছে। কখনো কখনো কোনো ধর্ষক বা হত্যাকারী ধরা পড়লেও, মদদদাতারা চিহ্নিত হলেও থেকে যাচ্ছে নিরাপদে। তাদের বিচারের দাবি উঠলেই হামলা-মামলা এবং ‘পাড়িয়ে মিশিয়ে‘ ফেলার হুমকি।
মুখে বলা হচ্ছে, ‘আমরাও বিচার চাই, ধর্ষণকারীরা আমাদের কেউ না।’
আর যারা বিচার চাইছেন, প্রতিবাদ করছেন-তাদের পিটিয়ে আহত করা হচ্ছে।
অভিযোগ করেন, গণমাধ্যম আপনাদের উপর দোষ চাপায়।
ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদ করতে দিতে না চাইলে, প্রতিবাদকারীদের পেটালে যে, ধর্ষকদের পক্ষ নেওয়া হয়ে যায়-তা তো কারো বুঝতে না পারার কথা নয়।
মদদদাতা বা পৃষ্ঠপোষকদের বিচার বা নিবৃত্ত করার উদ্যোগ না নিয়ে, কখনো কখনো দু’চারজন দেলোয়ারদের বিচার করার নীতিতে চলছে বাংলাদেশ। ফলে, একজন দেলোয়ারের পরিবর্তে আবার একাধিক দেলোয়ার তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
s.mortoza@gmail.com
Comments