ঢাবির ঐতিহ্য আর ‘মুলা-কুলা-ঢেঁকি’র মতো হাতি!

যিনি চোখে দেখতে পান না, তারও হাতি দেখা নিয়ে গল্প আছে বাংলা ভাষায়। অন্য ভাষায়ও থাকতে পারে, জানা নেই। গল্পের নানা সংস্করণের মধ্যে বহুল প্রচলিত গল্পটি এমন:
DU Protest.jpg
ধর্ষকের বিচারের দাবিতে ঢাবি শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ। ৭ জানুয়ারি ২০২০। ছবি: এমরান হোসেন

যিনি চোখে দেখতে পান না, তারও হাতি দেখা নিয়ে গল্প আছে বাংলা ভাষায়। অন্য ভাষায়ও থাকতে পারে, জানা নেই। গল্পের নানা সংস্করণের মধ্যে বহুল প্রচলিত গল্পটি এমন:

চোখে দেখেন না এমন তিন বন্ধু হাতি দেখার জন্য জমিদার বাড়িতে গেলেন। প্রথম বন্ধু হাত দিয়ে হাতির দাঁত স্পর্শ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, হাতি দেখতে মুলার মতো। দ্বিতীয় বন্ধু কান স্পর্শ করে বললেন, হাতি দেখতে কুলার মতো। তৃতীয় বন্ধু হাতির পা স্পর্শ করলেন এবং তার ধারণা হলো হাতি দেখতে ঢেঁকির মতো। এই গল্পের অবতারণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের একটি চিঠিকে কেন্দ্র করে।

গত ৫ সেপ্টেম্বর তিনি দৃক গ্যালারি কর্ণধার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে একটি চিঠি দিয়েছেন। ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, অনুমতি ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দৃক গ্যালারির ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন করা হয়েছিল। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে জনসমাগম ঘটানো হয়েছিল। প্রক্টরের চিঠির মূল ভাষ্য- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেকোনো আয়োজনের জন্য ঢাবি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। উল্লেখ্য, দৃক গ্যালারি আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের মতোই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত নাম। দৃক গ্যালারির ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজু ভাস্কর্যের সামনে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। তা করতে দেওয়া হয়নি। ছাত্রলীগের ভাঙচুরে ভণ্ডুল হয়ে যায় প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীর আয়োজন করাকে কেন্দ্র করে চিঠি দেওয়া হয়েছে শহিদুল আলমকে।

এই চিঠির প্রেক্ষিতে ভাবছি, কর্তৃপক্ষ বা প্রক্টর আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কোন চোখ দিয়ে দেখছেন! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সীমানা বা পরিধি, সে সম্পর্কে তাদের ধারণা আসলে কতটা স্বচ্ছ? শহীদ মিনার, কার্জন হল, দোয়েল চত্বর, কাঁটাবন, চারুকলা-শাহবাগ, বর্তমান ঢাবি প্রশাসন পুরো বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছে কি না! এখানে কে, কারা, কোথায় সমাবেশ, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ বা আলোচনা করছেন, তা দেখার সক্ষমতা প্রক্টরিয়াল বডি বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আজ পর্যন্ত যত সমাবেশ, আন্দোলন, প্রতিবাদ হয়েছে, তার কোনটি ঢাবি প্রক্টরের অনুমতি নিয়ে হয়েছে?

পেছনে না ফিরে বরং বর্তমান নিয়ে আলোচনা করি। গত কয়েকদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদ-বিক্ষোভ-সমাবেশে। বাম ছাত্র সংগঠনগুলো সমাবেশ করছে শাহবাগ এলাকায়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে প্রেসক্লাব, সমাবেশ-বিক্ষোভ করছে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ। রাজু ভাস্কর্যের সামনে অনশন করছেন একজন শিক্ষার্থী ধর্ষণের প্রতিবাদে। সেখানে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে সংহতি প্রকাশ ও অবস্থান নিতে দেখা গেছে।

এই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ, তা কি অনুমতি নিয়ে হচ্ছে? প্রক্টর তাদের সবাইকে অনুমতি দিয়েছেন?

যারা সমাবেশ-বিক্ষোভ করছেন, তাদের সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তারা লিখিত বা মৌখিক কোনো অনুমতি চাননি, নেননি। প্রক্টর বা ঢাবি কর্তৃপক্ষ লিখিত বা মৌখিক কোনো অনুমতিও দেননি। এই বিক্ষোভ-সমাবেশ চলছে অনুমতি ছাড়া। ঢাবি কর্তৃপক্ষ বা প্রক্টর বিক্ষোভকারীদের চিঠি দিয়েছেন? চিঠি দিতে হলে কতজনকে দিতে হবে? চিঠি না দিলে প্রশ্ন আসবে, দৃক গ্যালারিকে কেন চিঠি দেওয়া হলো? এখন থেকে কি ধরে নিতে হবে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ-সমাবেশ বা আলোকচিত্র প্রদর্শনীর অনুমতি নেওয়ার দরকার হবে না?

এসবের কোনোটিই আসলে প্রশ্ন বা মূল প্রসঙ্গ নয়। মূল প্রসঙ্গ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চিন্তা ও চেতনার জগত দলীয় সংকীর্ণতায় সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। তারা হাতিকে মূলা, কুলা বা ঢেঁকির মতো করে দেখছেন, ভাবছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব বা ঐতিহ্য কী, তা তারা ভুলে গেছেন। বা জানতেনই না বা জানলেও আংশিক জানতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য শিক্ষা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য সর্বকালের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মনীষী শিক্ষাবিদরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য-গৌরব অন্যায়-অনাচার-অনৈতিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। সেই অন্যায় দেশের যেকোনো জায়গায়, যার বা যাদের ওপরই হোক না কেন। সাধারণত প্রথম প্রতিবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই হয়েছে। পথ দেখিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যরা তা অনুস্মরণ করেছে। এমনকি জাতীয় রাজনীতিও তা অনুস্মরণ করেছে। এটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব, এটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য।

এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে গৌরব আর ঐতিহ্যের বিষয়ে পরিণত হয়েছে ১০ টাকার ‘চা-সিঙ্গারা-সমুচা’ আর ‘১২ টাকা’ বেতন, ৪০ হাজার শিক্ষার্থী, ৬০টি গবেষণা ল্যাব আর কিছু ভবন! চিন্তা আর চেতনার জগতটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে।

এই ১২ টাকা বেতন বা ১০ টাকার চা-সিঙ্গারা-সমুচার কৃতিত্ব নেওয়ার সঙ্গে বর্তমান বা তার আগের বা তারও আগের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তো কোনো সম্পর্ক নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে পাবলিকের অর্থে। শিক্ষার্থীর বেতন, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন সবই যোগান দেন জনগণ। বেতন কম, খাবারে ভর্তুকি এটা দেশের নীতি। এই তথ্যে বিদেশিরা ‘অ্যামেজিং’ বলবেন কেন? তারা কি জানেন না যে, পৃথিবীর উন্নত অনেক দেশেও উচ্চ শিক্ষা সম্পূর্ণ ফ্রি।

বিদেশিরা কি জানেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ৪ জনের এক রুমে ৪০ জন শিক্ষার্থী থাকেন, যার নাম গণরুম? সরকারি ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রশ্রয়ে ‘গেস্টরুমে’ প্রতি রাতে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করে, শীতের রাতে বারান্দায় থেকে শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয় পৃথিবীর কোন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে? পৃথিবীর আর কোন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এত পুষ্টিমানহীন খাবার খান? পৃথিবীর আর কোন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার বাজেট এত কম?

আলোচনা বা দাবির বিষয় হওয়ার কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট কম, বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদের খাওয়া-থাকার মান বৃদ্ধি করতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কারও মুখে এসব দাবির কথা কখনো শোনা যায় না।

৬০টি ল্যাব আছে, তো উল্লেখযোগ্য গবেষণা কী? নাম বলতে পারেন না! ৬০টি ল্যাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য বা গৌরবের বিষয় নয়। ল্যাব পাঁচটি থাকলেও গৌরবের হতে পারত, যদি সত্যিকারের গবেষণা থাকত। অথচ ঐতিহ্য-গৌরব দুটোই ছিল। যার নাম আইনস্টাইনের সঙ্গে মিলিয়ে আলোচনা হয়, সেই সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য-গৌরব। সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি। মনীষীতুল্য শিক্ষকেরা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য-গৌরব। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই হাজারের ওপরে শিক্ষক। কিন্তু একটি প্রতিক্রিয়া জানার জন্যে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বা এমন দু-একজন ছাড়া নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। পৃথিবীর কোনো র‌্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থাকে না, নাম থাকে শ্রীলংকা এমনকি নেপালের বিশ্ববিদ্যালয়েরও!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য-গৌরব শুধু সাহস-সংগ্রাম নয়, শিক্ষা-গবেষণাও। শিক্ষা-গবেষণার গৌরব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বহু আগেই হারিয়েছে। টিকে ছিল সাহস-সংগ্রাম। ১৯৫২, ৬৯, ৭১, ৯০, ২০০৭ এর ইতিহাস জ্বলজ্বল করছে। ২০০২ সালের শামসুন্নাহার হল আন্দোলন বা সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অংশ। সেই বিচ্যুতি ক্রমশ দৃশ্যমান।

কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারবে না, এমন নির্দেশনার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো প্রতিবাদ আসতে দেখা যায়নি। ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রথম প্রতিবাদ ঢাবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের থেকেই আসার কথা ছিল। ঢাবি শিক্ষক-প্রশাসনের অবস্থানও এসব সিদ্ধান্তের পক্ষে, প্রতিবাদ আন্দোলনের বিপক্ষে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তা দেখা গেছে। এখনকার ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনেও যা অদৃশ্য নয়। আশার কথা- সরকারি ছাত্র সংগঠনের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদ এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই হচ্ছে।

s.mortoza@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh approves export of 3,000 tonnes of hilsa to India for Durga Puja

The government has approved the export of 3,000 tonnes of hilsa fish to India on the occasion of Durga Puja, the commerce ministry said in a statement today

3h ago