জীবন ফজলুর রহমানদের নয়!
মো. ফজলুর রহমানের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। প্রথমাবস্থায় মনে হতে পারে এই নির্দয় নগরের রাস্তায় পড়ে থাকা মানসিক অসুস্থ কারও ছবি হয়ত! একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে ভুল ভাঙে। তার কথাগুলো শুনলে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মনে হয় পাঁজরের হাড়গুলো যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আকাশ-বাতাস কাঁপানো সেই আর্তনাদ।
‘গাড়ি তো লইয়া গেল। ৮০ আজার ট্যাহার কিস্তি কি কইরা দিমু? কি কইরা খামু...?’
এখন কি করবেন?
‘কি করমু, গলায় দড়ি দিমু।’
করোনায় লক্ষ বা কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। মে. ফজলুর রহমানও তাদের একজন। হয়ত ফজলুর রহমানেরও একটি সংসার আছে। আছেন বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান। কাজ নেই, আয় নেই। তারা থাকবেন কোথায়, খাবেন কী? বেঁচে থাকবেন, টিকে থাকবেন কী করে? ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ফজলুর রহমান একটি রিকশা কিনেছেন। ব্যাটারিচালিত রিকশা। ঘরে অভুক্ত পরিজনদের আশায় রেখে ফজলুর রহমান রিকশা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। রক্ত-ঘাম ঝরানো অর্থের বিনিময়ে চাল-তরকারি কিনে ঘরে ফিরবেন। হয়ত ক্ষুধার কষ্ট নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন তার স্ত্রী-সন্তান। তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটাতে পারেননি ফজলুর রহমান। জিগাতলা এলাকা থেকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্তারা তার রিকশা ট্রাকে তুলে নিয়ে গেছে। রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ। ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে, ঘোষণা সিটি করপোরেশন আগেই দিয়েছিল। ফজলুর রহমান সেই ঘোষণা জানতেন না বা জেনেও অমান্য করেছেন।
নিম্নবিত্ত দিনমজুর হয়ে সিটি করপোরেশনের আদেশ অমান্য! এত বড় সাহস! বীরদর্পে তার রিকশা তুলে নেওয়া হয়েছে। হয়ত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। কয়েকজন মানুষ, অভুক্ত সন্তান-স্ত্রী... এসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায়। এসব ভাবলে নগর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হবে কীভাবে? আইনের প্রয়োগ করতে হবে। সব জায়গায় না পারলেও, কোথাও না কোথাও থেকে তো শুরু করতে হবে! দেখাতে তো হবে যে ‘কাজ করছি’।
দেখানোর তালিকায় সব সময় ফজলুর রহমানরাই স্থান করে নেন। ফজলুর রহমানের ঋণ ৮০ হাজার টাকা। মাথাপিছু আয়ের হিসেবে ফজলুর রহমানেরও আয় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। সেখানে ৮০ হাজার টাকার ঋণ, গুরুত্বপূর্ণ হবে কেন। ৮০ লাখ বা ৮০ কোটি বা ৮০০ কোটি বা ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ হলেও না হয় বিবেচনার সুযোগ ছিল। মাত্র ৮০ হাজারকে তো আর বিবেচনায় আনা যায় না!
এই নগরে রিকশার সংখ্যা কত? পায়েচালিত রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যার হিসেব কারও কাছে নেই। নেই ফজলুর রহমানের রিকশা তুলে নিয়ে যাওয়া সিটি করপোরেশনের কর্তাদের কাছেও। কিন্তু রিকশা যারা তৈরি করে, বিক্রি করে তাদের সঙ্গে সংযোগ আছে এসব কর্তাদেরও।
এই নগরের পরিবহন এখন লেগুনা। লেগুনার সংখ্যা ১০ হাজার না ২০ হাজার, তা কেউ বলতে পারে না। দশ-বারো বছরের বালকও লেগুনার চালক। লেগুনার কোনো চালকের লাইসেন্স নেই, ফিটনেস নেই। যেসব রুটে লেগুনা চলে, একটি লেগুনারও সেসব রুটে চলার অনুমতি নেই। রোড পারমিট ছাড়া চলছে লেগুনা। পরিষ্কার করে বললে, লেগুনা পরিবহনটি শতভাগ অবৈধভাবে চলছে। এক একটি লেগুনাকে প্রতিদিন চাঁদা দিতে হয় কমপক্ষে ৭০০ টাকা। অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা ধরা যায়, লেগুনা ধরা যায় না? না, যায় না। সিটি করপোরেশন হয়ত বলবে, লেগুনা আমাদের আওতায় না। কিন্তু প্রকৃত কারণ এটি নয়।
প্রকৃত কারণ লেগুনার মালিক ৮০ হাজার টাকা ঋণ করে কান্নাকাটি করা ফজলুর রহমানরা না। লেগুনার মালিক ৮০ কোটি বা ৮০০ কোটি টাকার মালিক রাজনৈতিক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তারা। ফলে লেগুনার ক্ষেত্রে অকাঠ্য যুক্তি ‘মানুষ তাহলে চলাচল করবে কীভাবে?’ তাছাড়া ফজলুর রহমানরা তো আর প্রতিদিন ৭০০ টাকা চাঁদা দিতে পারেন না।
গণপরিবহন বলতে ছাল-বাকল ওঠা যে বাসগুলো রাস্তায় চলে, তার অধিকাংশেরই ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই। নেই রোড পারমিট। চালকদের নেই লাইসেন্স। আবার প্রায় অর্ধেক ভাঙাচোরা কিছু বাস-ট্রাকেরও ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে। কারণ এসব বাসের মালিকরাও ৮০ কোটি বা ৮০০ কোটি টাকার মালিক। ফজলুর রহমানরা সামনে থাকতে, তাদের বাস তো আর ধরা যায় না। তারা তো কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাস কিনেছেন। বাস ধরলে তো ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে!
রাস্তার অর্ধেক জায়গা দখল করে বাস দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তাগুলোকে তারা ‘বাস টার্মিনাল’ বানিয়ে নিয়েছে। এক্ষেত্রেও যুক্তি, বাসগুলো কোথাও না কোথাও তো রাখতে দিতে হবে। মানুষের উপকারের জন্যেই তো বাস। অবৈধভাবে রাস্তায় রাখলেও সমস্যা নেই। সমস্যা ফজলুর রহমানদের অবৈধ রিকশায়!
এই নগরে বৈধ কী আর অবৈধ কী? গবেষণার দরকার নেই। সাদা চোখেই বহু কিছু দেখা যায়। সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে আবাসিক এলাকায় শতশত বাণিজ্যিক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। আবাসিক এলাকার বাড়ি কিনে বা ভাড়া নিয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা আইন অনুযায়ী বৈধ নয়। তবুও সিটি করপোরেশন লাইসেন্স দিয়েছে। এখন এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলো কি তুলে দেওয়া হবে? ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হবে? না, কারণ এর সঙ্গে দেশের ভবিষ্যৎ শিক্ষা, অর্থনীতি জড়িত। ৮০০ বা ৮ হাজার কোটি টাকার মালিকদের ব্যাপার-স্যাপার। ৮০ হাজার টাকার ব্যাপার তো নয় যে, হুট করে একটা ব্যবস্থা নিয়ে নেওয়া যাবে।
এই নগরে এক সময় ৫৪ বা ৫৬টি খাল ছিল। এখনো সিটি করপোরেশনের কেতাবে ২৬টি খালের অস্তিত্ব আছে। সেসব খাল দখল করে বড় বড় ভবন তৈরি হয়েছে। ৮০০ বা ৮ হাজার কোটি টাকার মালিক রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ীরাই এসব ভবন গড়ে তুলেছে। কোনো কিছুই অজানা নয় সিটি করপোরেশনের। এসব খাল কি উদ্ধার করা হবে? অবৈধ ভবনগুলো গুড়িয়ে দেওয়া হবে? না, কী বলেন! এতে কত শত হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে, তা বিবেচনায় রাখতে হবে না!
বিবেচনায় রাখতে হয় না শুধু ফজলুর রহমানদের।
বি.দ্র. ফজলুর রহমানের রিকশাটি যেদিন তুলে নেওয়া হয়, সেদিনও হয়ত এ নগরে ১০, ২০, ৫০ বা ১০০টি নতুন রিকশা নেমেছে। নতুন রিকশা নামার নিয়ম নেই, তবুও নেমেছে। প্রতিদিন নামছে। একজন ইতোমধ্যে নিশ্চিতও করেছেন, ফজলুর রহমানকে একটি নতুন রিকশা কিনে দেওয়া হবে। হাসি ফুটেছে ফজলুর রহমানের মুখে। এই রিকশাটিও ফজলুর রহমান কতদিন চালাতে পারবেন, তা অনিশ্চিত। রিকশা যারা তুলে নিয়ে যায় তাদের সম্পৃক্ততার সিন্ডিকেট ছাড়া রিকশার মালিকানা টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব।
s.mortoza@gmail.com
Comments