কার্পেটের নিচে ময়লা রাখা বিবস্ত্র সমাজ
রোগ নয়, আমাদের মনোজগতে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হয়েছে যে ‘রোগের উপসর্গ’-ই মূল সমস্যা। এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হয়েছে যে, আইনের শাসনে কিছু হয় না, সমস্যা সমাধানে বেআইনি ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বিচার বহির্ভূত হত্যা’-ই সমাধান। আমরা তা বিশ্বাস করে নিয়েছি। নোয়াখালীর এই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা কিশোর বাদল, দেলোয়ার, রহিমদের ক্রসফায়ার চাইছি। যেভাবে নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ারে খুশি হয়ে বাহবা দিয়েছিলাম। মূল রোগ বা অপরাধী যে নয়ন বন্ডদের প্রস্তুতকারকরা, তা আমাদের দাবিতে স্থান পায় না। নোয়াখালীর এই দেলোয়ারদের প্রস্তুতকারক কারা? কাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বাদলরূপী কিশোররা দানব হয়ে উঠেছে, তা অজানা কিছু নয়। যারা বাদলদের পৃষ্ঠপোষক যারা রহিমদের প্রস্তুতকারক তারা কারা? এখানে হয়ত কয়েকজন ব্যক্তির নাম আসবে। তারা রাজনীতিবিদ, তারা হয়ত ক্ষমতাসীন দলের নেতা। এই যে কয়েকজন নেতা, এরাও প্রকৃত ‘রোগ’ নয়। প্রকৃত রোগের নাম ‘পদ্ধতি’। নেতা হয়ে ওঠার ‘পদ্ধতি’ ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার ‘পদ্ধতি’।
এই ‘পদ্ধতি’তে জনভালোবাসা বা জনআস্থা দরকার হয় না। দরকার হয় নয়ন বন্ড বাহিনী, দেলোয়ার বাহিনী। বাহিনী পালনের জন্যে দরকার হয় অর্থ। অস্বচ্ছ-অবৈধ পথে আসে সেই অর্থ। দুর্নীতির শীর্ষে অবস্থান করেও কথা বলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কিভাবে একটা স্ববিরোধিতা সম্ভব? সব সম্ভবের দেশ, তাই?
জানি না।
শুধু দেখছি শুধু জানছি ‘ভণ্ডামি’ ‘অন্ধত্ব’ আর ‘দায়হীনতা’ আমাদের শিক্ষিত-ক্ষমতাবান শ্রেণির সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে।
ক্ষমতাবান বানানোর মঞ্চে যাদের অবস্থান, তাদের সর্বোচ্চ মূল্য একটি বিএমডব্লিউ। দিনের কাজ তাদেরকে দিয়ে রাতে করিয়ে নেওয়া যায়। বিনিময় মূল্যে বাড়িয়ে দিতে হয় শুধু ভাতার পরিমাণ।
বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যায় পৃথিবীতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের বড়কর্তারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ দিয়ে চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়। ধরা পড়ে, প্রমাণ হয়। শাস্তি হয় না, হয় পদোন্নতি। এরই নাম ‘রোগ’ এরই নাম ‘পদ্ধতি’।
এই ‘পদ্ধতি’র ফলশ্রুতিতে যিনি সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের শিক্ষক, তিনি টেলিভিশনের পর্দায় এসে অনর্গল অসত্য বলতে পারেন। শিক্ষার্থী দেখছেন তার শিক্ষক অসত্য বলছেন। অভিভাবক দেখছেন সন্তানকে যাদের কাছে পাঠিয়েছেন মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা নিতে, তারা কত অবলীলায় অসত্য বলছেন! অভিভাবক নিজে দেখেছেন কাজটি হয়েছে রাতে, কিন্তু ‘শিক্ষিত মাস্টার’ বলছেন ‘না দিনেই হইছে’! কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে পাটের আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে যে কৃষক বললেন, ‘বাবা, টিবিতে এহন তো কেউ সত্যি কতা কয় না।’
শিক্ষিত, ক্ষমতাবান শ্রেণির এখন এ কথা শুনতে হয় না। তাদের আর পাট ধোঁয়া কৃষকের কাছে যেতে হয় না।
যে মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে এ জাতি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল, সেই মধ্যবিত্তের নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত হয়ে গেছে আপোষকামিতার অংশীজন। কিন্তু সে ক্ষমতাবান হতে পারেনি। নৈতিকতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়েছে অধিকারবোধও। হারিয়েছে কথা বলার অধিকার। একাত্তরের মধ্যবিত্তের অতি ক্ষুদ্র অংশ স্বাধীন দেশে পরিণত হয়েছে উচ্চবিত্তে। মধ্যবিত্তের মূল শক্তি যে সাংস্কৃতিক জাগরণ, তার নেতৃত্বে স্থায়ী আসন নিয়ে বসে আছে এই গুটিকয়েক উচ্চবিত্ত। তারা মধ্যবিত্তের আবরণে ‘আলু-পটলের’ দামে মধ্যবিত্তের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা বিক্রি করে দিচ্ছে। অথচ জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার যুদ্ধে পরাজিত হতে থাকা মধ্যবিত্তের সঙ্গে এই উচ্চবিত্ত শ্রেণির কোনো সম্পর্ক নেই। যেভাবে সম্পর্ক নেই গণমাধ্যমের সঙ্গে সেই সব গণমাধ্যম নেতাদের। যারা সবচেয়ে বড় দুর্নীতি-অনৈতিকতার দায়ে অভিযুক্তের পাশে বসে তার মেয়াদ বাড়ানোয় ভূমিকা রাখে। শুধু গুটিকয়েক নেতাই নয়, সামগ্রিকভাবে গণমাধ্যম গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। যার প্রমাণ রিফাত হত্যার আগে পর্যন্ত নয়ন বন্ডদের স্থান হয় না গণমাধ্যমে। বর্বরতার মাস পেরিয়ে গেলেও, বাদল-দেলোয়াররা অজানা থেকে যায়। প্রদীপদের মাদক বাণিজ্য ও ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড গণমাধ্যম লিখতে পারে না, একজন মেজর সিনহা হত্যার আগে পর্যন্ত।
বরগুনা থেকে নোয়াখালী, কক্সবাজার-টেকনাফ থেকে সিলেট-সব রসুনের গোড়া অভিন্ন। কোথাও রোগ প্রতিকারে আলোচনা নেই, দাবিও নেই। নয়ন বন্ড বা বাদলদের প্রস্তুতকারকরা অবিনশ্বর। তাদের কোনো ক্ষয় নেই। টাকা না দিলে হত্যা, যার রাষ্ট্রীয় নাম ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ। পদ্ধতির নাম মাদক বিরোধী অভিযান। কখনো অর্থের বিনিময়ে হত্যা কখনো হত্যা অর্থ না দিলে। এই এত বড় অপরাধ করে বারবার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেলেন একজন ওসি প্রদীপ। তার অপরাধ না জেনে পুরস্কৃত করা হয়নি।
রোগ বাদ দিয়ে রোগের উপসর্গ নিয়ে এই যে ছোটাছুটি, তা এমনি এমনি তৈরি হয়নি। একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য ছিল।
আজ যারা নোয়াখালীর বর্বরতার ভিডিওচিত্র দেখে ঘুমাতে পারছেন না, হাহাকারে গলার রগ ছিঁড়ে রক্ত ঝরছে, আপনি আপনারা এদেশে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে জঘন্য প্রকৃতির অন্যায়-অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মের সমর্থক। বিবেককে প্রশ্ন করুন, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবিম্বকে প্রশ্ন করুন। এই সমাজ প্রতিষ্ঠায় আপনি আমিও একজন। নয়ন বন্ডদের পেছনের কাহিনী প্রকাশ না করে, বিচার ছাড়া হত্যাকে আমরা বলেছি ‘ঠিক হয়েছে’। বাদলদের হত্যার দাবি করছি, প্রস্তুতকারকদের কাহিনী জানতে চাইছি না। দেলোয়ারদেরও যদি হত্যা করা হয় বলব ‘ঠিক হয়েছে’। আমরা এমনই এক সমাজ নির্মাণ করেছি, যে সমাজে আপনার আমার বিবেক জাগ্রত হওয়ার জন্যে ভিডিওচিত্র অবশ্যক। অন্তত অডিও থাকতেই হবে। নোয়াখালীর সংঘবদ্ধ ধর্ষণ- নিপীড়ন বা বরগুনা হত্যার ভিডিও আছে, কাউন্সিলর একরাম হত্যার ‘আব্বু তুমি কান্না করতেছো যে’ অডিও ছিল। আমাদের গলার রগ ছিঁড়ে রক্তও ঝরেছিল। মাদক বাণিজ্যের টাকা না দেওয়ার বা টাকা দেওয়ার পরও প্রমাণ গায়েব কৌশলে ওসি প্রদীপরা কক্সবাজার-টেকনাফের যে যুবকদের হত্যা করল, তার কোনো ভিডিও বা অডিও নেই।টাকা না দেওয়ায় হত্যাকাণ্ডের শিকার প্রবাসীরও ভিডিও-অডিও নেই। ফলে কারও বিবেককেও নাড়া দিতে দেখা যায়নি।
পরিকল্পিতভাবে সামাজিক কাঠামো বা বিচার ব্যবস্থার উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস ধ্বংস করে দেওয়ার মত পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। আমরা যা বলি না বা বলতে পারি না, তা মাঝেমধ্যে বলেন সর্বোচ্চ আদালত। সম্প্রতি পরিত্যক্ত সম্পত্তি বিষয়ক একটি রিটের রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার সর্বশেষ জায়গা তথা শেষ আশ্রয় হলো বিচার বিভাগ। যখন এই শেষ আশ্রয়স্থলের বিচারকগণ দুর্নীতির মাধ্যমে রায় বিক্রি করেন, তখন সাধারণ মানুষের আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। তারা হতাশ হন, ক্ষুব্ধ হন, বিক্ষুব্ধ হন এবং বিকল্প খুঁজতে থাকেন। তখন জনগণ মাস্তান, সন্ত্রাসী এবং বিভিন্ন মাফিয়া নেতাদের আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং তাদের বিচার সেখানে চান।’ ( প্রথম আলো, ৫ অক্টোবর ২০২০)
দেশের মানুষকে কিভাবে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নামক হত্যাকাণ্ডের সমর্থকে পরিণত করা হয়েছে, তা বোঝার জন্যে বেশি বুদ্ধি না থাকলেও চলে।
বড় অন্যায়ের অংশীজন হয়ে ছোট অন্যায়ের প্রতিবাদ ভণ্ড সমাজ ব্যবস্থার দৃশ্যমান বাস্তবতা। কোনো কিছু এর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
আমাদের এই সমাজ প্রতিকারে বিশ্বাসী নয়, আড়াল বা আবডালে বিশ্বাসী। ধমক দিয়ে ভয় দেখিয়ে, কেটে-ছেঁটে ‘রোগ’ লুকিয়ে বা চাপা দিয়ে ‘উপসর্গ’ নিয়ে নাড়াচাড়ায় বিশ্বাসী। এই পদ্ধতিতে যে ‘রোগমুক্ত’ থাকা যায় না, চিরন্তন এই সত্যও আমরা অস্বীকার করতে চাই। পাবলো নেরুদার সেই উক্তি ‘ইউ ক্যান কাট অল দ্য ফ্লাউয়ারস বাট ইউ ক্যাননট কিপ স্প্রিং ফ্রম কামিং’। বাগানের ফুল ছিঁড়ে ফেললেই বসন্তের আগমন ঠেকানো যায় না। চাপা দিয়ে বাধা দিয়ে, ধ্বংস করে বা হত্যা করে পরিত্রাণ মিলে না। কার্পেটের নিচে ময়লা রেখে পরিচ্ছন্নতার ভান করা যায়, পরিচ্ছন্ন থাকা যায় না।
ক্ষমতাবানরা পরিচ্ছন্ন থাকতেও চান না। অথচ একটি পরিচ্ছন্ন সমাজ নির্মাণের সংকল্পেই দেশের মানুষ যুদ্ধ করেছিলেন ১৯৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন দেশের প্রায় সব মানুষ। সেই যুদ্ধের অগ্রভাগে ছিলেন গ্রামের দরিদ্র কৃষক, কৃষকের সন্তান। আজও সেই কৃষকই অগ্রভাগে। কৃষক উৎপাদন করে। কৃষকের ছেলেই মধ্যপ্রাচ্যের টাকার মেশিন প্রবাসী শ্রমিক। কৃষকের মেয়েই তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মী। সর্বত্রই সে বঞ্চিত নিপীড়িত। অথচ পচে যাওয়া এই সমাজ প্রতিষ্ঠায় তার কোনো দায় নেই। তাদের সংগ্রামের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে গেছে অল্প কিছু মানুষের। ক্ষমতার দম্ভ টিকিয়ে রাখার জন্যে তারা নয়ন বন্ড, বাদল, অর্জুনদের তৈরি করে। কখনো কখনো তাদের কার্পেটের নিচে চাপা দিয়ে পুত-পবিত্র-পরিচ্ছন্ন সাজে। আমরা হাততালি দেই।
অপরাধের প্রতিবাদকারীদের জন্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অপরাধের প্রতিবাদকারীদের ‘বিএনপি-রাজাকার-জামায়াত-শিবির’ ট্যাগ দেওয়া অপকৌশলে অন্ধকারের পথে ধাবিত এ সমাজ। গভীর অন্ধকারে বসে আমরা বিবস্ত্র শুধু একজন নারীকে দেখছি, পুরো সমাজকে দেখছি না!
Comments