নারীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ-ছড়ানো কোন পর্যায়ের অপরাধ?
বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের রায় হয়েছে। এই রায়ে আদালত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, মামলার ভিকটিম রিফাত শরীফকে হত্যা করার দায়ে আসামিরা সমানভাবে দায়ী। এর মধ্য দিয়ে রিফাতের বাবা-মা পুত্রহারা হয়েছেন। তাই মিন্নির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে তাকে অনুসরণ করে তার মতো মেয়েদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তাই মিন্নির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।
রায়ে মহামান্য আদালত সবাইকে সমানভাবে দায়ী করলেও এদেশের মানুষজন কিন্তু মনে মনে এবং ভাবপ্রকাশের মাধ্যমে শুধু মিন্নিকেই দায়ী করছে। শুধু দায়ী করা নয়, পত্রিকায় প্রকাশিত মিন্নির রায়ের খবরের নিচে এত অশ্লীল ও অশ্রাব্য ভাষায় মন্তব্য করেছে যে, এখানে তা লেখা যাচ্ছে না।
এই ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত অন্য আসামি এমনকি বরগুনার ত্রাস নয়ন বন্ডকে নিয়েও আমজনতার কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের যত মাথাব্যথা তা যেন মিন্নিকে নিয়েই। তারা মিন্নিকে পাপিষ্ঠা, নোংরাসহ এমন আরও অনেক অশ্লীল বিশেষণে বিশেষায়িত করছে। মিন্নি নারী বলেই তাকে নিয়ে এত কথা। অথচ অন্যরাওতো সমান অপরাধী, সমান সাজা পেয়েছে। কিন্তু, এই মানসিক বিকারগ্রস্ত সমাজ পুরুষের অপরাধটাকে সহজভাবে নিয়ে মিন্নিকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই বলছে। নারী অপরাধের শিকার হলে যতটা না আলোচনায় আসে, এরচেয়েও অনেক বেশি আলোচনায় আসে অপরাধী হলে। নারী যে অপরাধেই অপরাধী হোক না কেন, সমাজ তাকে যৌনতার প্রতীক করে তুলবেই।
এই রায়ের একদিন পরেই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেছে স্থানীয় একদল তরুণ। ওই নারীকে বিবস্ত্র করে তারা সেই ভিডিও ধারণ করেছে। ঘটনার ৩২ দিন পর ৪ অক্টোবর বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। এদিন সকাল থেকে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। যারা ভিডিওটি পেয়েছেন, তারা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। একজন নারীকে এইভাবে অবমাননা করার ধৃষ্টতা দেখায় কারা এবং কীভাবে?
রিফাত হত্যার রায়ে বিচারক বলেছেন, রিফাত হত্যাকাণ্ড ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও’ হার মানায়, তাই অপরাধীদের কোনো অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ ছিল না। আমরা বিচারকের রায়ের ওপর আস্থাশীল হয়ে শুধু বলতে চাই, এই সমাজের বহু অপরাধ এখন ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও’ হার মানাচ্ছে। এই যে নারীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ ও তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া, এটা কোন পর্যায়ের অপরাধ? যেখানে নির্যাতনের শিকার নারী কুলাঙ্গারগুলোর হাত-পা ধরে ও তাদের বাবা ডেকেও রেহাই পাননি।
এরপর আসি গত ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ এলাকায় স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে একজন তরুণী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনায়। খাগড়াছড়িতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন কিশোরীকে বাবা-মায়ের সামনেই সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়েছে। অথচ সমাজে সাধারণত যেসব অন্যায় অপকর্ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে, এর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য হচ্ছে ধর্ষণ।
খুব আশঙ্কাজনকভাবে লক্ষ্য করছি সমাজে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। বাঙালি এক সঙ্গে ব্যবসা করতে না পারলেও সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করতে বেশ পারঙ্গম। আর তাই আইন ও শালিস কেন্দ্রের (আসক) হিসাব মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত যে ৮৮৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে ১৯২টিই সংঘবদ্ধ ধর্ষণ। যারা এই সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, তাদের মধ্যে শিশুর হারই বেশি। ভাবা যায় একজন নারী বা শিশুর ওপর যখন পালাক্রমে সাত থেকে আটটি পিশাচ ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন সেটা কতটা ভয়ংকর হতে পারে? ধর্ষণের শিকার সেই মেয়েটি, তার পরিবার কতটা ক্ষতির মুখে পড়েন? সারাজীবন কতটা ট্রমা নিয়ে তাদের বেঁচে থাকতে হয়? যে সমাজের মানুষ মেয়েটিকে ধর্ষণ করে, সেই সমাজই মেয়েটির দিকেই আঙুল তোলে।
যতবার এরকম ঘটনা দেখছি, ততবার মনে হয়েছে এদের এমন শাস্তি হওয়া দরকার, যা দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। আবারও রিফাত হত্যার রায়ে বিচারপতির কথা তুলে ধরি। ধারার ব্যাখ্যা দিয়ে বিচারক বলেন, ‘কতিপয় ব্যক্তি মিলিয়া তাহাদের অভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কোনো অপরাধজনক কাজ করিলে যেভাবে দায় ঠিক হইত, ঠিক সেইভাবেই দায়ী হইবে। তদানুসারে এই মামলার ভিকটিম রিফাত শরীফকে খুন করিবার দায়ে উক্ত আসামিগণ সমভাবে দায়ী।’
সংঘবদ্ধ ধর্ষণ যারা করে, তারা দলবদ্ধভাবেই এই অপরাধ করে। তাই বাংলাদেশের দণ্ডবিধিতে বলা হয়েছে, ‘যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের পরে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহা হইলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’
সমাজে ধর্ষণের মতো যে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তাও কিন্তু ভয়াবহভাবে নির্মম। পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের চেয়ে তা কোনো অংশে কম নয়। এবং এই যে ধর্ষণ করে বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা, তাও কিন্তু কোনো সভ্য সমাজের কাজ নয়। এও মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানায়। তাই রিফাত হত্যা মামলায় আদালতের রায়কে উল্লেখ করে বলতে চাই— ‘এমতাবস্থায় তাহাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হইলে তাহাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া যুবসমাজ ভুল পথে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা থাকিবে। তাই আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।’
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
ranjana@manusher.org
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments