ছাত্রলীগের কপালে কেন কলঙ্কের তিলক?
‘অপরাধী যেই হোক...’, ‘ধর্ষকের কোনো দল নেই’, ‘নিজের দলের হলেও অপরাধীকে ছাড়া হবে না’, ‘অপরাধীরা ছাত্রলীগের কেউ না’, ‘সেখানে কোনো কমিটি নেই’, ‘অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে’, ‘সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে’ ‘তারা অনুপ্রবেশকারী’ ‘তারা শিবির-ছাত্রদল থেকে ছাত্রলীগে এসেছে’— ছাত্রলীগ, সাবেক ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ নেতারা গত আট-দশ বছরে শত শতবার এসব কথা বলেছেন।
‘ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড’ লিখে গুগলে সন্ধান করলে কয়েক হাজার শিরোনাম ও ছবি আসে। হত্যার শিরোনাম আছে। রামদা-চাপাতি-কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত করার শিরোনাম আছে। হাতুড়ি-রড-লাঠি দিয়ে পেটানোর শিরোনাম আছে। স্কুলছাত্রদের পেটানো হেলমেট বাহিনীর শিরোনাম আছে। ছয় তলার ছাদ থেকে প্রতিপক্ষকে ফেলে দেওয়ার শিরোনাম আছে। শিরোনাম আছে চলন্ত ট্রেন থেকে প্রতিপক্ষকে ফেলে দিয়ে হত্যার। অধ্যক্ষকে লাথি দিয়ে কলেজ থেকে বের করে দেওয়ার, অধ্যক্ষকে পুকুরে ফেলে দেওয়ার শিরোনাম আছে। শিক্ষকের বুকে ধাক্কা দেওয়ার, শার্টের পকেট ছিঁড়ে ফেলার, প্রতিবাদী শিক্ষকদের ওপর হামলা করার শিরোনাম আছে। ছাত্রী নিপীড়ন, ধর্ষণের শিরোনাম আছে। চাপাতি-রামদা-পিস্তল হাতে প্রতিপক্ষকে হামলার ছবি আছে। কমপক্ষে দুই জন উপাচার্য শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ঠেকানোর জন্যে ছাত্রলীগকে ডেকে এনেছেন। ছাত্রলীগ এসে ছাত্র-ছাত্রীদের পিটিয়ে আহত করেছে। ভিসিদ্বয় ছাত্রলীগকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এসব ছবি-সংবাদ সংরক্ষণ করে রেখেছে গুগল।
শিক্ষাঙ্গনে ধর্ষণের প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আসে। ১৯৯৮-৯৯ সালে ধর্ষণ ঘটনায় দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সময়কালটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে একইসঙ্গে কলঙ্কের ও গৌরবের।
তৎকালীন জাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জসিমউদ্দিন মানিক ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সে ধর্ষণের সেঞ্চুরি উৎসব করে পালন করেছিল। প্রথমদিকে ধর্ষণের অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্বীকারই করতে চায়নি। ‘তথ্য নেই’, ‘প্রমাণ নেই’, ‘গুজব’ আখ্যা দিয়ে ধর্ষণের ঘটনা চাপা দেওয়ার মতো কলঙ্কজনক নজির তৈরি করে জাবি প্রশাসন। সেই কলঙ্কের ইতিহাস চাপা দিয়ে গৌরবের সূচনাপর্ব রচনা করেন জাবি শিক্ষার্থীরা। বাম ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিদ্রাহীন অবিরাম আন্দোলনের কাছে পরাজিত হয় জাবি প্রশাসন। ছাত্রলীগ নেতা জসিমউদ্দিন মানিকসহ ১৩ জনকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয় জাবি প্রশাসন।
তারও আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সীমান্ত নামে এক ছাত্রদল নেতা-ক্যাডারের বিরুদ্ধে একজন ছাত্রীকে ‘লাঞ্ছিত ও অপহরণ’ চেষ্টার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থাকে নির্বিকার। সেই ছাত্রী পড়াশোনা শেষ না করে জাবি ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু, ছাত্রদল নেতা সীমান্ত ঠিকই ডিগ্রি নিয়ে বের হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা রাষ্ট্রীয় আইন সীমান্তদের শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায়ই নেয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্দোলনের কারণে বাধ্য হয়ে মানিকদের শাস্তি দিলেও, রাষ্ট্রীয় আইনে তাদের বিচার হয়নি। মানিককে নিরাপদে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। মানিক বিদেশে চলে গেছে, রেখে গেছে তার সিম্পটম। দশক দুয়েক ধরে তা ধারণ করে যাচ্ছে ছাত্রলীগ। সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে ছয় জন সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণের ঘটনায় ছাত্রলীগ আবার আলোচনায়। আবারও ছাত্রলীগের সেই বক্তব্য, অভিযুক্তরা আমাদের সংগঠনের কেউ না। তারা শিবির, তারা ছাত্রদল। আমরাও চাই অপরাধীদের বিচার হোক।
ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসের গৌরবময় ঐতিহ্য আছে, আছে সন্ত্রাসের কলঙ্কও। আইয়ুব খানের সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন এনএসএফ’র বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে ছাত্র সমাজ। বাংলাদেশ জন্মের সকল ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল ছাত্রনেতা তথা ছাত্রলীগ নেতাদের। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া তারা প্রভাবিত করেছেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে আইয়ুব খানের ভূত ছাত্র সংগঠনে ঢুকে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে আওয়ামী ছাত্রলীগের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সাত জন শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা করে। স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে যা অন্যতম কলঙ্কের ইতিহাস। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার-শাস্তি হয়েছিল। এ ছাড়াও, আওয়ামী ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেশের মানুষ দেখেছেন। তারপর দেখা গেছে আওয়ামী ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠা জাসদ ছাত্রলীগের সন্ত্রাস। সন্ত্রাস, গুলি বিনিময়, আহত-নিহতের ঘটনা ঘটেছে। এরপর সাহস আর সন্ত্রাসকে ভিন্নমাত্রা দিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল। ছাত্রদলের সন্ত্রাসী ক্যাডারদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বারবার সংবাদ শিরোনাম হয়ে দেশজুড়ে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
কখনো কখনো দুই ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের ত্রিমুখী গুলি বিনিময়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। প্রাণ দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। জামায়াত-শিবির নারকীয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে শিক্ষাঙ্গনে। প্রতিপক্ষ বাম ছাত্র সংগঠন ও আওয়ামী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কুপিয়ে হত্যা, হাতের কবজি কেটে নেওয়া, হাত-পায়ের রগ কেটে পঙ্গু করে দেওয়ার মতো নজিরবিহীন অপরাধ করেছে শিবির। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে তারা নরকক্ষেত্রে পরিণত করেছিল।
আবার বহু সন্ত্রাসী ভাড়া করে, অস্ত্রের যোগান দিয়েও ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন স্বৈরাচার এরশাদ। তিনি ব্যর্থ হয়েছেন ছাত্র সমাজের সম্মিলিত প্রতিরোধে। এরশাদের পতনেও অন্যতম প্রধান ভূমিকা রেখেছে ছাত্র সমাজ।
বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে সন্ত্রাসের প্রবল উপস্থিতি ছিল। ছিল না ছাত্রী বা নারী নিপীড়নের ইতিহাস। ছাত্রলীগের আওরঙ্গ-লিয়াকত-হান্নানের বহু সন্ত্রাস-গল্প-কাহিনি আছে। কিন্তু, সাধারণ শিক্ষার্থী বা ছাত্রী নিপীড়নের কাহিনি নেই। জাসদ ছাত্রলীগের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জিন্না-মুরাদ-শিপন-আকরামদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ তো দূরের কথা কোনো ছাত্রীকে কটূক্তি করার অভিযোগও ছিল না। তারপর আওয়ামী ছাত্রলীগের চুন্নু-টোকন-মাসুমদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেখা গেছে।
ছাত্রদলের বাবলু-নিরু-অভি-ইলিয়াসের বহু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কাহিনি আছে। গণমাধ্যমের কল্যাণে তাদের সন্ত্রাসী হিরোইজমের গল্প জেনেছে দেশের মানুষ। এদের মধ্যে ঢাবি থেকে বহিষ্কারের অনেক বছর পর অভি একবার এমপি নির্বাচিত হয়। সেই সময় তার একটি অনৈতিক সম্পর্কের ভিডিও প্রকাশিত হয়। তারপর মডেল তিন্নী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু ছাত্র বা সন্ত্রাসী জীবনে কোনো ছাত্রী নিপীড়ন করেছে, এমন তথ্য বা অভিযোগ নেই।
যদিও ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাছে পরাজিত হয়ে ছাত্রদল ছাত্রীদের ওপর আক্রমণ করে কলঙ্কের ইতিহাসের সূচনা করেছিল। পরবর্তী ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল আবার বিপুল ভোটে বিজয়ীও হয়েছিল। ছাত্রদলের নেতৃত্বে শামসুন্নাহার হলে আক্রমণ আরও একটি কলঙ্কজনক ঘটনা।
কিন্তু, এসব ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী বা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা ধর্ষণ করেছে, এমন নজির পাওয়া যায় না। এককভাবে মূলত এই অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম অভিযোগ।
একটি যুক্তি দেওয়া হয় এবং তা অসত্য নয় যে, সমাজের সর্বক্ষেত্রে অধঃপতন ঘটেছে। নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষক-শিক্ষার্থী তথা শিক্ষাঙ্গন থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শিবির-ছাত্রদল-ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী ক্যাডারদেরও কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছে। যার প্রভাব ছাত্রলীগের ওপরও পড়েছে। এই যুক্তি দিয়ে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি-ঠিকাদারি, সন্ত্রাস-মাস্তানি, প্রতিপক্ষ সংগঠনের ওপর আক্রমণ-ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়ন জাতীয় কর্মকাণ্ডগুলোকে হয়তো কিছুটা জাস্টিফাই করা যায়। এমন যুক্তিও হয়তো দেওয়া যায় যে, দল ক্ষমতায় থাকলে ছাত্র সংগঠন কিছুটা বাড়াবাড়ি করে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন ছাত্রদলও বাড়াবাড়ি করতো। এমন দাবিও হয়তো মেনে নেওয়া যায়।
কিন্তু, ধর্ষণের মতো অপরাধ কোনো যুক্তি দিয়ে জাস্টিফাই করা যায় না। সে কারণেই হয়তো ভয়-ভীতি দেখানো বা হুমকি দিয়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করার ধারাবাহিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ গত দুই দশক ধরে এমন নীতিতে অটল আছে। ফলে তারা ঘটনাক্রম থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।
ছাত্রলীগের ধারাবাহিক দুর্বল নেতৃত্ব, সম্ভবত এর একটি বড় কারণ। দায় এড়ানোর সুযোগ নেই মূল দল আওয়ামী লীগ নেতাদেরও। বিশেষ করে যেসব নেতারা ছাত্রলীগ দেখে রাখার দায়িত্ব পালন করেছেন।
এই পরিচিতি থেকে ছাত্রলীগের বের হয়ে আসা বা বের করে আনা অসম্ভব নয়। সামগ্রিকভাবে দেশের যে পরিস্থিতি, আর দশটি সেক্টরে যে পরিস্থিতি বিরাজমান, জাতীয় রাজনীতির যে বৈশিষ্ট্য, তারচেয়ে ছাত্রলীগ সম্পূর্ণ আলাদা কিছু হবে, সেটা ভাবা যায় না। এমন ইউটোপিয়ান কল্পনা করা গেলেও, বাস্তবে অসম্ভব। যেটা সম্ভব সেটা হলো, নারী নিপীড়ন বা ধর্ষণের ঘটনা থেকে ছাত্রলীগকে বের করে আনা। এরজন্যে আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বকে কঠিন-কঠোর কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ছাত্রলীগের যারা নেতৃত্ব পাবেন, তারা টেন্ডারবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবেন না। নামে বা বেনামে ঠিকাদারি ব্যবসা করতে পারবেন না। ঠিকাদারির কাজ পাইয়ে দেওয়া ও উপাচার্যদের লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবেন না। একক আধিপত্য নয়, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী ছাড়া সব ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে দিতে হবে। প্রতি বছর নিয়ম করে দৃশ্যমান সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। এতে শুধু ছাত্রলীগের কলঙ্ক মোচন হবে না, ছাত্র রাজনীতিতে সেই গৌরবময় ইতিবাচক ধারাও ক্রমান্বয়ে ফিরে আসতে শুরু করবে।
s.mortoza@gmail.com
Comments