এই আগুনের আঁচ একদিন আমার গায়েও লাগবে
ধর্ষণ কিংবা যৌন নিপীড়নের খবর দেখে বা ঘটনার কথা জেনে আজকাল মনটা বিক্ষুব্ধ হয় ঠিকই, কিন্তু অবাক হই না। দেশে ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, পরিবারের ভেতর এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ক্রমাগত ঘটছেই। ভেবেছি আর লিখব না জঘন্য এই অপরাধ নিয়ে। যাদের টনক নড়া দরকার, তারা তো ঘুমিয়েই আছে। মাঝখান আমি মনকষ্টে ভুগছি। তাছাড়া আমাদের হাতে এমন কোনো ম্যাজিক নেই যে, রাতারাতি এই ধর্ষণ, নারী এবং শিশুর প্রতি যৌন হয়রানি বন্ধ করে দেব। কিন্তু যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া পাহাড়ের একটি গণধর্ষণের ঘটনা জানলাম, তখন আর চুপ থাকা গেল না।
খাগড়াছড়িতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এক মেয়েকে হাত-পা বেধে ধর্ষণ করা হয়েছে। কী এক অসহনীয় দৃশ্য। তাও আমরা চুপ। আমি একটি কন্যা সন্তানের মা, আমার সাত বছরের নাতনি রয়েছে বাসায়। আজ আমরা এতটাই নীরব হয়ে আছি যে, প্রতিরোধ করাই ভুলে গেছি। তাই আশংকা হয় এরকম ভয়াবহ বিপদ আমাদের সবার জীবনেই আসতে পারে। নয় জন ধর্ষক পুরুষ একটি আদিবাসী চাকমা পরিবারের ঘরে ঢুকে বাবা আর মাকে আটকে রেখে সারারাত ধর্ষণ করেছে মেয়েটিকে। মেয়েটি প্রতিবন্ধী। একইদিনে যশোরেও দুজন কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা দেখে দেখে মানুষের প্রতি বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। পারিবারিক পরিসরেও শিশুকে নিয়ে সুস্থির থাকতে পারি না। বাইরে গিয়ে কোনো শিশুকে যখন দেখি মায়ের হাত ধরে যাচ্ছে, কোনো কিশোরীকে দেখি পথে দাঁড়িয়ে ফুল বিক্রি করছে বা কোনো তরুণীকে দেখি বাসের জন্য অপেক্ষা করছে, তখনই বুকটা দুরু দুরু করে ওঠে অজানা আশংকায়। নারী প্রতিনিয়ত এত বেশি শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে যে, এইসব খবরের প্রতি সাধারণ মানুষ আর গুরুত্বও দেয় না। সরকার তো এসব ইস্যুকে রাষ্ট্র পরিচালনার তালিকায় কোনো ইস্যুই মনে করে না।
আরেকটি খবর দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। শেষ পর্যন্ত নিজ দলের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এনে আমরণ অনশনে বসতে হয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদককে। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, পার্টি অফিসে অনশনে বসলেও সিপিবি প্রধান কিছুই জানেন না বলে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। সিপিবি’র মতো একটি সুশীল রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকও শুধু নারী বলেই দলের লোক দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হলেন। আর এর চাইতেও বড় কথা দলের নেতাও তার দায় এড়িয়ে গেলেন।
সিপিবি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, এই বয়সে এসেও তাকে দলের লোক দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না যে, যারা ধর্ষণ বা যৌন হয়রানি করে, তাদের কাছে বয়স, সম্পর্ক, পোশাক, ধর্ম, বর্ণ কোনো ব্যাপার নয়। বার বার বলা হচ্ছে, এদের আক্রমণের হাত থেকে বয়স্ক নারী, দুধের শিশু কেউ রক্ষা পাচ্ছে না। ভারতে খুব সম্প্রতি ৮৬ বছরের এক বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করেছে ত্রিশ বছরের এক অমানুষ। দিল্লির নারী কমিশনের প্রধান বলেছেন, ‘আমি দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং শহরের লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে লিখব, যাতে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হয় এবং ছয় মাসের মধ্য অপরাধীকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়।’
ভারতের নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, কোনো বয়সের মেয়েরাই এখন নিরাপদ নন। ২০১২ সালে চলন্ত বাসে ধর্ষণের ঘটনার পর নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন, যোগ করা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড, দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার তারা বলছেন, তাতে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি।
বাংলাদেশের অবস্থাও কিন্তু এর চাইতে কোনো অংশে ভালো নয়। প্রতিদিন ধর্ষণের খবর আসছে গণমাধ্যমে। আরও অসংখ্য ঘটনা খবর হয়ে আসছে না। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮৮৯ জন নারী ও শিশু। এদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৯২ জন, আর মারা গেছেন ৪১ জন। আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। এ ছাড়াও, ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছিল আরও ১৯২ জনের ওপর।
এই ৮ মাসের মধ্যে কিন্তু ৬ মাস ছিল করোনাকাল। করোনার মতো মহামারি, লকডাউন, মানুষের মৃত্যু, অভাব, দারিদ্র, কর্মহীনতা কোনোকিছুই থামাতে পারেনি ধর্ষণকে, ধর্ষণের চেষ্টাকে। আইন ও শালিস কেন্দ্র থেকে পাওয়া এই যে ভয়াবহ সংখ্যাটা দেখা যাচ্ছে, সেটি কিন্তু মাত্র কয়েকটি পত্রিকা থেকে নেওয়া হয়েছে। বাকি অনেক ঘটনা খবর হয়ে আসেনি।
সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার এই মেয়েগুলোর মধ্যে ৫৯ জনের বয়স ৬ বছরের নীচে, ৭ থেকে ১২ বছরের শিশু ১২৭ জন আর ১৩ থেকে ১৮ বছরের শিশু ১২০ জন। গণধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধের শিকার হয়েছে ৭ থেকে ১২ বছরের ৬ জন শিশু, ১৩ থেকে ১৮ বছরের শিশু ৫০ জন। আরও অন্য বয়সীরাও হয়েছে এর ভিকটিম। মারা গেছে ১৭ জন।
একটি শিশু চোখ মেলে পৃথিবীকে দেখার আগেই যৌন পাশবিকতার শিকার হচ্ছে পরিবারে, স্বজনদের দ্বারা, পরিবারের বন্ধুদের দ্বারা, পাড়া-প্রতিবেশী, শিক্ষক, মৌলভি, অচেনা লোক কেউ বাদ যাচ্ছে না। এরপর যখন মেয়েটি বড় হতে থাকে, তার জন্য বেঁচে থাকার লড়াই আরও কঠিন হতে থাকে।
যে মেয়েটি বা ছেলেটি যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, সে বা তার পরিবার ছাড়া কেউ বিষয়টা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয় না। উদ্বিগ্ন হলেও, যতোটা হওয়া উচিৎ, ততোটা হন না। কথা বলে না, আওয়াজ তুলে না। নারী বা মানবাধিকার সংগঠনগুলো কিছু কথা বললেও এতে তেমন কোনো লাভ হয় না। সরকার এবং সাধারণ জনতা মনে করে, নারী বা শিশুর অব্যাহতভাবে যৌন হামলা ও ধর্ষণের শিকার হওয়ার বিষয়টি নিয়ে শুধু গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোই মাতামাতি করে। এটি তেমন বড় কোনো অপরাধ নয়।
সরকার মনে করে, আমরা তো ধর্ষণ, গণধর্ষণের জন্য আইন করেই দিয়েছি, তাহলে আর কী করতে পারি। কিন্তু আমরা দেখছি, ধর্ষণের জন্য এই প্রথাগত ও আইনি শাস্তি কোনো কাজেই আসছে না। কারণ লম্বা পথ পার হয়ে, বহু প্রতিকূল পরিস্থিতিকে পাশ কাটিয়ে, রক্ত চোখ উপেক্ষা করে এবং সমাজের কুৎসিত মতামতকে অগ্রাহ্য করে একজন ভিকটিম ও তার পরিবারকে বিচারকের দরজায় পৌঁছাতে হয়, যা অধিকাংশ পরিবার বা ব্যক্তির পক্ষে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। মাঝপথে এসে বন্ধ হয়ে যায় অনেক মামলা, সালিশ করে নিষ্পত্তি করা হয় আরও বেশি মামলার। অথচ এ কথা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে যে, ধর্ষণের মামলায় সালিশ হয় না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। শহরে, গ্রামে এই রেওয়াজ চলছেই। এমনকি মাঝে মাঝে স্থানীয় মতমোড়ল ও পুলিশও এই বিচারের পক্ষে থাকে।
আমরা মনে করি, আইন করার পাশাপাশি সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিৎ নারী ও শিশুদের সুরক্ষা দেওয়া। আইনের প্রয়োগ এমনই কঠিন হওয়া উচিৎ, যেন অপরাধী এই অপরাধ করার আগে ১০ বার চিন্তা করে। যেন ভাবে, কোনো নারীর অমর্যাদা করলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। ‘জিরো টলারেন্স’ কথাটি যেন শুধু কথার কথা হয়ে আছে বলেই চারিদিকে ধর্ষণকারীদের এত প্রতাপ। আমরা মনে করি, পরিবার, সমাজ ও দেশে একটি বড় পরিবর্তন দরকার। নারী আক্রান্ত হলে যেন-তেন প্রকরণে নারীকেই দায়ী করা হয়। নারীর আচরণ, পোশাক, চলাফেরা এসবকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দেয় না যে, ৮৪ বছরের বুড়ি মানুষ অথবা ৪ মাসের শিশু কেন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে? এদের দোষ কোথায়?
আমাদের সমাজ খুব অদ্ভুত। কোনো মেয়ে যদি ধর্ষণের বা যৌন হয়রানির শিকার হয়, তাহলে সবাই চুপ করে থাকি। খুব বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রতিবাদ হয়, কিছু নিন্দাজ্ঞাপন করা হয়। সবাই ঘরে বসে ভাবি, যাদের মেয়ে এই পৈশাচিকতার শিকার হয়েছে, মাথাব্যথা তাদের। আর তাই তো এ দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে বড় কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। করোনাকাল এসে তো আরও সব চুপ হয়ে গেল। এই সুযোগে বাড়ল পারিবারিক নির্যাতনের হার।
এই যে তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, প্রতিবন্ধী মেয়েরা ধর্ষিত হচ্ছেন, কিন্তু আমাদের কারও টনক কি নড়ছে? সরকারের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ আছে তা নিয়ন্ত্রণের? নেই। কারণ এই সমাজ এবং রাষ্ট্র এদের করুণার চোখে দেখে। সত্যি কথা বলতে গেলে নারীদেরই করুণার চোখে দেখে।
একজন নারী যখন ধর্ষণের শিকার হয়ে থানায় যান বা আইনের দ্বারস্থ হন, তখন তাকে ভয়াবহ রকম ট্রমার মধ্য দিয়ে যেত হয়, হেনস্থার কোনো শেষ থাকে না। পারলে তাকে পোশাক খুলে প্রমাণ করতে হয় যে, সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই পুরো ব্যবস্থার মধ্যে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে।
আর তা শুরু করতে হবে পরিবার থেকে। আমাদের পরিবারগুলোতে সবসময় মেয়েকে ভালো হয়ে চলতে শেখানো হয়। ধর্ম-কর্ম, পর্দা-পুসিদা, আচার-আচরণ মেয়েদের যেভাবে শেখানো হয়, ছেলেদের এর ১০ শতাংশও শেখানো হয় না। ছেলেদের এতকিছু না শিখিয়ে শুধু যদি শেখানো যায় নারীকে সম্মান করবে, যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ নয়। সংসারে ছেলে সন্তানকে শেখাতে হবে, অন্য নারীকে তুমি যদি কটুক্তি বা ধর্ষণ করো, তাহলে তা তোমার মাকেই আঘাত করা হবে। আমি তো মনে করি, পড়াশোনা শেখানোর চাইতেও এই শিক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সম্প্রতি নাইজেরিয়ায় ধর্ষণের ঘটনা খুব বেড়ে গিয়েছিল। জনগণ এর বিরুদ্ধে এতোটাই সোচ্চার হয়ে উঠেছিল যে, কোনো কোনো জায়গায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপরও অবস্থা বেগতিক হওয়ায় কাদুনা স্টেটের সংসদ একটি আইন পাশ করে যে, কেউ যদি ১৪ বছরের কমবয়সী কোনো শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে অপারেশন করে তাকে খোজা করে দেওয়া হবে। জনগণ সোচ্চার হলে সরকার দাবি মানতে বাধ্য।
এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ধর্ষকদের এবং শিশুকে যৌন হয়রানি করবে যারা, তাদের কেমিক্যাল দিয়ে খোজা করে দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, ধর্ষককে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিৎ। তবে প্রকাশ্যে ফাঁসি কায়েম করলে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে ঝামেলায় পড়তে হবে। তাই এই খোজা করে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।’
এরকম একটি আইন বাংলাদেশে পাশ করার মতো সময় এসে গেছে। অনেকেই হয়ত মানবাধিকারের কথা বলবেন। বলবেন এরকম একটি অঙ্গ বাদ দিলে লোকটি বাঁচবে কীভাবে? কিন্তু এইসব পিশাচদের জন্য মানবাধিকারের কথা বলার কোনো মানে হয় না। যৌন হয়রানির শিকার নারীর যদি সুযোগ থাকত, তার প্রতি নিপীড়নকারীর শাস্তি দেওয়ার, তাহলে হয়ত এ ধরণের অপরাধ অনেক কমে যেত। অম্লানবদনে এখন যে আগুনকে আমরা জ্বলতে দিচ্ছি, সেই আগুন যে একদিন আমার সন্তানকেই পুড়িয়ে মারবে না, এর নিশ্চয়তা কোথায়?
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
ranjana@manusher.org
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments