অবহেলা আর নিষ্ক্রিয়তায় মৃতপ্রায় বরিশালের খেলাধুলা
নিন্দুকদের মতে, ক্রীড়াক্ষেত্রে উন্নয়ন বলতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণকে বুঝিয়ে থাকেন এবং বিদ্যমান অবকাঠামোগুলো সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।
বর্তমান ভেন্যুগুলোতে কোনো ক্রীড়া কার্যক্রম চলছে কিনা তা যেন খুব কম গুরুত্বই বহন করে; আমাদের দরকার আরও স্টেডিয়াম।
তারা এটাও বলে থাকেন যে, বাংলাদেশের খেলাধুলা মানেই ‘ঢাকার ভেতরের’ খেলাধুলা। দুঃখজনক হলেও নিন্দুকদের দর্শনের সঙ্গে বরিশালের বাস্তবতার বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কর্তৃপক্ষের নিস্ক্রিয়তা আর অবহেলার কারণে দেশের একসময়ের অন্যতম সমৃদ্ধ ক্রীড়া কেন্দ্রে নেমে এসেছে স্থবিরতা।
আর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের এই বিভাগীয় শহরটির খেলাধুলার মৃতপ্রায় অবস্থার প্রতিচ্ছবি যেন শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত স্টেডিয়ামের বর্তমান দশা।
২৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা বিশিষ্ট স্টেডিয়ামটি ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ২৯ একর জমির উপরে। তখন এর নাম ছিল বরিশাল স্টেডিয়াম। কয়েকজন সংগঠক আফসোসের সুরে বলেন যে, ২০০৬ সালে প্রায় ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে স্টেডিয়ামটি সংস্কার করা হলেও খেলাধুলা না হওয়ায় অলস পড়ে আছে।
প্রায় প্রত্যেকেই বরিশালের ক্রীড়াঙ্গনের দুর্দশার পেছনে স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতার অভাবকে দায়ী করেন এবং তারা আরও জানান যে, গত ১৭ বছর ধরে ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।
দ্য ডেইলি স্টারকে বরিশালের সবচেয়ে পুরনো ক্লাব ‘নবজাগরণ ক্লাব’- এর সদস্য শুভঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, ‘এখানে কোনো লিগ নেই, কোনো টুর্নামেন্ট নেই এবং রয়েছে সুযোগ-সুবিধা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। সুতরাং, খেলাধুলার বর্তমান জীর্ণশীর্ণ চিত্রটি প্রত্যাশিতই বটে। ১৯৭০ ও ১৯৮০- এর দশকে স্কুল ও ক্লাব পর্যায়ে প্রচুর প্রতিযোগিতা হতো এবং সেগুলো এখন সুখস্মৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। একটা সময় ছিল যখন ক্রীড়া ইভেন্টগুলোর কথা ছিল শহরের মানুষের মুখে মুখে। জাকারিয়া পিন্টু, আমিনুল ইসলাম, ‘ছোট কামাল’, ‘বড় কামাল’, বসু কর্মকার, নিজাম ভূঁইয়া, গাজী, বাবলুসহ আরও অনেকে এখানে বেড়ে উঠেছেন।’
ক্রিকেট কোচ তাসরিকুল ইসলাম প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, ‘২০১৮ সাল থেকে এখানে কোনো ক্রিকেট লিগ নেই। প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ সবশেষ ২০১৮ সালে আর দ্বিতীয় বিভাগ লিগ ২০১৩-১৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এখন আপনি কীভাবে ভালো খেলোয়াড় তৈরি করবেন? আর কীভাবে ছেলেদের খেলতে উৎসাহিত করবেন?’
‘দেখুন, লম্বা লম্বা ঘাস গজিয়েছে এবং আপনি এই স্টেডিয়ামে অনুশীলন করতে পারবেন না। প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ ও প্রথম লেভেল মিলিয়ে প্রায় ৫০০ ক্রিকেটার রয়েছে। তবে তাদের অনুশীলনের যথাযথ সুযোগ-সুবিধা নেই। কোনো প্রতিযোগিতা না থাকায় খেলোয়াড়রা হতাশ হয়ে পড়ছে,’ বলেন কোচ ইব্রাহিম খলিল।
প্রথম বিভাগে খেলা ১৯ বছর বয়সী ক্রিকেটার রাকিব হাওলাদার জানান, ‘নতুন খেলোয়াড়রা ক্ষুধার্ত হয়ে আছে খেলার জন্য। (ব্যাটসম্যান) ফজলে মাহমুদ রাব্বি ‘যুব সংঘ’- এর মাধ্যমে এই মাঠে খেলে প্রথমবারের মতো সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। পরে তিনি জাতীয় দলেও খেলেন। (জাতীয় দলের পেসার) কামরুল ইসলাম রাব্বিও এই মাঠ থেকে উঠে এসেছেন। এছাড়া, আরও কয়েকজন খেলোয়াড় আছে, যারা স্থানীয় লিগ খেলে উপকৃত হয়েছে। কিন্তু এখন এখানে কোনো ধরনের ক্রীড়া কার্যক্রম নেই।’
‘আমরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি,’ লিমন নামের আরেকজন খেলোয়াড় যোগ করেন।
ক্রিকেট কোচ এজাজ আল মাহমুদ সুজন বলেন, ‘লিগগুলো গত ছয়-সাত বছর ধরে স্থগিত রয়েছে। ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ম্যাচটি এই ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ ছিল। ক্রীড়াঙ্গনে স্থবিরতার মূল কারণগুলো হলো লিগ না হওয়া, দুর্বল অবকাঠামো, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও দীর্ঘদিন ধরে কোনো নির্বাচিত কমিটি না থাকা।’
একসময় প্রচুর উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল, কারণ নবজাগরণ ক্লাব, ফোর এইচ ক্লাব, নজরুল গ্রন্থাগার, কীর্তনখোলা একাডেমি, ভুট্টো স্মৃতি সংসদ, সীমানা কম্পাউন্ড সবুজ একাডেমি, জর্ডান সমাজ কল্যাণ কাউন্সিল, অরুণোদয় ক্লাব প্রভৃতি খুব সক্রিয় ছিল। তবে এসব এখন যেন শুধুই অতীত।
কোচ মাহামুদুল হায়দার তামিম বলেন, ২০০৮ সালে স্টেডিয়ামে ফ্লাডলাইট স্থাপন করা হয়, কিন্তু এটা কোনো কাজে লাগেনি।
জেলা ক্রীড়া সংস্থার অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব মোর্শেদ শামীম বলেন, এখানে ক্রিকেটের কিছু অনুশীলন কার্যক্রম চললেও লম্বা সময় ধরে অন্যান্য খেলাধুলার ক্ষেত্রে সেটাও হচ্ছে না। তিনি যোগ করেন, অন্তত ১৭ বছর ধরে এখানে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।
বরিশালের জেলা প্রশাসক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি এস এম অজিয়র রহমান জানান, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বর্তমানে কোনো ধরনের খেলাধুলা হচ্ছে না। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হলে লিগগুলো চালু করার চেষ্টা করবেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এস এম অজিয়র যোগ করেন, যদিও কোনো নির্বাচিত কমিটি নেই, তবে অ্যাড-হক কমিটির মাধ্যমে এই অঞ্চলের ক্রীড়াঙ্গনকে সক্রিয় রাখা হচ্ছে।
Comments