তাদের গল্পগুলো যেন সব হারানোর গল্প
অনেক আগে আমরা ট্রেনে করে যখন রংপুর যেতাম, তখন বাহাদুরাবাদ ঘাটে নেমে লঞ্চে করে পার হয়ে অন্য ঘাটে গিয়ে আবার ট্রেনে উঠতে হতো। সেরকমই একবার লঞ্চ আসেনি বলে আমি আর আব্বা ঘাটে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ চারিদিকে বিরাট শোরগোল। আমি কিছু বোঝার আগেই আব্বা আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে দৌঁড় দিয়েছিলেন। থামার পর পেছনে ফিরে দেখলাম ঠিক আমরা যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেই পাড়টি ভেঙে পড়ল নদীতে। মানে আর একটু হলে আব্বা আর আমিও নদীতে হারিয়ে যেতাম। সেই দৃশ্য দেখে আমি এতই বিস্মিত হয়েছিলাম সেদিন যে, নদীভাঙন কথাটা না বুঝলেও ভয়ে আমার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এরপর আরেকবার আরিচাঘাটে শেষ ফেরি মিস করে আমরা রাতে থেকে গেলাম। সেইসময়ে ঘাট ছিল খুবই অব্যবস্থাপূর্ণ। এরমধ্যেই দেখলাম রাতের অন্ধকারে লোকজনের ছোটাছুটি, হইচই। শুনলাম আশেপাশে কোথাও পাড় ভেঙে বাড়িঘর, রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। ভোরে যখন ফেরিতে করে যাচ্ছিলাম, তখন দেখলাম পাড়ে অসংখ্য মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। কারো মুখে কোনো কথা ছিলনা সেদিন। নদীগর্ভে সবকিছু বিলীন হতে দেখে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। হয়তো সারারাত কেঁদেছেন, আর কাঁদতে পারছেন না।
এরপর নদীভাঙনের অনেক খবর ও ছবি দেখেছি। নদীভাঙনের শিকার মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু, কয়েকমাস আগে প্রবল জলস্রোতে যখন দেখলাম মাদারীপুরের একটি দোতলা স্কুল ভবন ভেঙে পড়ে পানিতে ভেসে যাচ্ছে, সেদিন আবার নতুন করে আমার ভেতরে একটা হাহাকার তৈরি হলো। শুধু শিক্ষার্থীগুলোর কথা মনে হতে থাকল। এদেশে একটি স্কুল ভবন হওয়া স্বপ্নের মতো বিষয়। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলো। ভবনের সঙ্গে সঙ্গে ভেসে গেল দুই শ শিক্ষার্থীর স্বপ্ন। আবার কবে, কীভাবে একটি পাকা ভবন তারা পাবে, আমরা জানি না।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে দেখলাম, ১৯১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পদ্মার ভাঙনে পড়েছে মোট এক হাজার ৭৪৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা। দুর্বল ও অপরিণত মাটির কারণে সবচেয়ে বেশি ভেঙেছে মাওয়া, শরীয়তপুর ও চাঁদপুর। এ বছর তো বটেই, ১০৫ বছর ধরে পদ্মাপারের মানুষ সবচেয়ে বেশি ভাঙনের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ-বিষয়ক সংস্থা নাসা এক গবেষণায় জানিয়েছিল, ১৯৬৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ৬৬ হাজার হেক্টরের বেশি এলাকা পদ্মার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় আড়াই গুণের সমান। প্রতিবেদনে পদ্মাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাঙন-প্রবণ নদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
শুধু কি পদ্মা? না। প্রতিবছর এভাবে হাজারো হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, ব্যবসাপাতি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় লাখো মানুষ। নদীভাঙন এমন জিনিস যে, আজ যে রাজা, কাল সে পথে নেমে যেতে পারে। ঢাকাতে দুই জন ও কক্সবাজারে একজন রিকশাচালকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল, যারা গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম থেকে এসেছে নদীর ভাঙনে সব খুইয়ে। কক্সবাজারে যে লোকটি রিকশা চালাচ্ছেন, তার ঘরবাড়ি, আবাদি জমি সব ছিল। দুই ছেলে-মেয়ে স্কুলে পড়ত। কিন্তু, নদীভাঙনে সব খুইয়ে এখন রিকশা চালান বাড়ি থেকে আরেক প্রান্তে কক্সবাজারে এসে। যেন কেউ তাকে চিনতে না পারে।
আমাদের দেশে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা প্রধান নদ-নদী ছাড়াও কুশিয়ারা, ধরলা, তিস্তা, পায়রা, ডাকাতিয়া, করতোয়া, বড়াল, আড়িয়াল খাঁ, কর্ণফুলী, শঙ্খ নদীতেও বলতে গেলে সারা বছর ধরেই ভাঙন চলতে থাকে। কি যে ভয়ংকর সে অভিজ্ঞতা, সেটা যার গেছে, শুধু সেই জানে। উজান থেকে নেমে আসা পানির তীব্র স্রোতে মিলিয়ে যাচ্ছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, দোকান-পাট, বাজার, মসজিদ-মন্দির, স্কুল-মাদ্রাসা, থানা, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে প্রচুর মানুষ বাস করে যারা নদী সিকস্তি মানুষ। নদী সবকিছু ভেঙে নিয়ে গেছে তাদের। আমাদের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন গিয়াসউদ্দীন ও মিয়ানউদ্দীনের মা। তাদের একসময় সব ছিল। বাড়ি ছিল মুন্সিগঞ্জে। একরাতে তাদের পুরো গ্রাম নদীর নিচে চলে গেল। কোনোভাবে বাচ্চা দুটি নিয়ে তিনি চলে আসতে পেরেছেন। মিয়ানের মা আর কখনো তার গ্রামে ফিরে যেতে পারেনি।
কুড়িগ্রামের যে চালক সব হারিয়ে ঢাকায় রিকশা চালাতেন, সেই কবিরুল মিয়া যা বলেছিল তা আমি কোনোদিনও ভুলবো না। বলেছিলেন, ‘তোমরা কোনোদিনও বুইঝবার পাবেন না যে ভিটামাটি গাঙের পানিত তলি গেলে কেমন লাগে। মোরতো শুধু ভিটামাটি যায় নাই, মোর দুই ছাওয়ালও তলি গেইছে। বানের পানির এমন টান যে ওমাক সামলাবার পারো নাই। সেই থাকি মোর বউয়ের মাথা নষ্ট।’ এর মানে কবিরুল তার দুই সন্তান, ভিটেমাটি সব হারিয়েছে, পথে নেমেছে, বউ পাগল হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ বলেই এর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নদীভাঙনের ইতিহাস। যুগের পর যুগ ধরে পাড় ভাঙছে। নদীগর্ভে সব হারিয়ে অসহায় মানুষ শুধু ছুটতেই থাকে৷ আশির দশকের শেষে ফিচার সার্ভিস সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের হয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছিলাম বন্যা, অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢলসহ বিভিন্ন কারণে অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে ঢাকার বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। মানুষ বারবার এই পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদী ভাঙনের মুখোমুখি হয়ে গৃহস্থ থেকে শ্রমিকে পরিণত হয়েছে। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি নদীভাঙা এলাকার হাজারো অসহায় মানুষ সহায়-সম্বলহীন হয়ে জীবিকার তাগিদে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন৷ তাদের সেই লড়াই কিন্তু আজও থামেনি। লোক আসছেই বানের মতো, বানের কারণে ঘরছাড়া হয়ে। পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) তথ্য মতে, প্রতিবছর ভাঙনে নদীতে চলে যায় প্রায় চার হাজার হেক্টর জমি৷ আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় লাখখানেক পরিবার৷
কিন্তু, কেন আমাদের নদীগুলোর পাড় যুগ যুগ ধরে ভাঙছে। এর কি কোনো সমাধান নেই? নাকি আমরা সঠিক সমাধান জানি না? নাকি ইচ্ছা করে কোনো গোষ্ঠী এই সমস্যা টিকিয়ে রেখেছে? নদী বিশেষজ্ঞরা বলেন, নদীর দুই পাশের ভূখণ্ড অপরিণত ও দুর্বল মাটি দিয়ে গঠিত হলে বর্ষার সময় পানিপ্রবাহ বেড়ে গেলে, তখন ভাঙনও বেড়ে যায়। আর এ ধরনের একটি নদীর ভাঙন সামলাতে প্রতিবছর যেভাবে বিভিন্নস্থানে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেটাও সঠিক পদ্ধতি নয়। সামগ্রিকভাবে পুরো নদীর পানি ও পলির প্রবাহের ধরন এবং দুই পাড়ের মাটির গঠনকে বিবেচনায় নিয়ে ভাঙন-রোধে উদ্যোগ নিতে হবে। নদী-বিষয়ক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে মূলত বন্যা ও বন্যার সঙ্গে আসা বিপুল পরিমাণ পলিমাটিকে এই ভাঙনের জন্য দায়ী করা হয়েছে। নদী শাসন করতে গিয়ে নদীর দু’পাশে যে বাঁধ দেওয়া হয়েছে, সেটিও একটি কারণ। এ ছাড়া, আছে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবও।
গণমাধ্যমে নদীভাঙন নিয়ে প্রকাশিত প্রায় প্রতিটি প্রতিবেদনে বারবার বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে যে, আমাদের নদী শাসন পদ্ধতি ঠিক নেই, অস্থায়ীভাবে ভাঙন-রোধের ব্যবস্থাও ঠিক নেই, নদীর দুই পাশে অবকাঠামো তৈরির পদ্ধতিতেও ঝামেলা আছে। এ ছাড়া, রয়েছে দুর্নীতি, নিম্নমানের কাজ, জবাবদিহিতা ও মনিটরিংয়ের অভাব। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেছেন, এই নদী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা দরকার। একই সঙ্গে নদীটির চরগুলোতে ও দুই তীরে অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে আরও সাবধান হতে হবে।
বেশ কয়েকবছর আগে ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল ভাঙন-রোধে দুর্নীতির কারণ এবং সুযোগের বিষয়টি। তারা কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে জানিয়েছিল যে, বর্ষাকালে নদীর ভাঙন শুরু হলে তড়িঘড়ি করে কাজ শুরু হয়৷ এ ছাড়া, তীব্র স্রোতের সময় ভাঙন-রোধে নদীতে বালুর বস্তা ফেলাই একমাত্র পদ্ধতি বাংলাদেশে৷ যেহেতু বন্যা বা অতিবৃষ্টি হলে খুব দ্রুত কাজ শুরু হয়, তখন টেন্ডার ডাকারও সময় থাকে না। মোটা বালুর বদলে চিকন বালু দেওয়া হয়, ১০০ বস্তার বদলে ৮০ বস্তা দেওয়া হয়, প্রতিটি বস্তায় পাঁচ কেজি বালু থাকার কথা থাকলেও, থাকে তিন কেজি করে। কিন্তু, সাধারণত তখন আর মাপামাপির কোনো সুযোগ থাকেনা। এ ছাড়া, থাকে ঠিকাদারদের দৌরাত্ম্য, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাসহ নানান বিষয়।
তাহলে সমাধানটা কী? সমাধানটা খুব সহজ না এবং সময়ের ব্যাপার। স্থায়ী বাঁধ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া, অস্থায়ী আবাসন ব্যবস্থা, ড্রেজিং করে নদীর স্বাভাবিক নাব্যতা ধরে রাখার কথা বহুজন, বহুবছর ধরে বলেই যাচ্ছেন। সবচেয়ে বড় কথা নদীভাঙন ঠেকানোর জন্য সব মহলের একটা সদিচ্ছা থাকতে হবে। এই সদিচ্ছার অভাবেই জন্ম হয় নানা ধরনের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির।
এ প্রসঙ্গে আমার আবার মনে পড়ল নদী ভাঙনের শিকার সুলতান মিয়ার কথা। তিনি ঘর রং করার কাজ করতেন। নিরক্ষর একজন মানুষ এত জরুরি একটি কথা বলেছিলেন সেই আশির দশকের শেষে, যা ভাবলে আমার এখনো অবাক লাগে। তিনি সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় বলেছিলেন, ‘সেই ছোটকাল থেকেই শুনতেছি নদীর ভাঙন ঠেকানোর জন্য এই করতে হবে, সেই করতে হবে। যমুনা নদীতে ড্রেজিং হবে। কিন্তু, আমি এখন সব হারাইয়া বুড়া, কিন্তু এখনো কিছু হয় নাই। আমার বাপে নতুন চর জাগলে সেখানে জায়গা পাবে, এই আশায় থেকে থেকে মারাই গেছে। তার কবরও তলায় গেছে। যতই সবাই আশা দেখায়, কিন্তু সেইসব কিছু হয় না।’
অনেকে ভুলেই গেছেন তাদের আদি ঠিকানা। তারা কেউ জানেন না কবে আবার ফিরে যেতে পারবেন নিজের আলয়ে। এই গৃহহীন উদ্বাস্তু মানুষগুলোর অভিজ্ঞতা সব একইরকম। তাদের গল্পগুলো যেন সব হারানোর গল্প।
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
ranjana@manusher.org
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments