কোনটা জরুরি: দুষ্টের দমন নাকি কুকুর নিধন?
একের পর এক ঘটনা দেখে আমরা হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি। একটার চেয়ে আরেকটা বেশি মারাত্মক, পাশবিক, কষ্টের। ক্ষোভ প্রকাশের কোনো ভাষা আমাদের জানা নেই। শুধু বুঝতে পারছি, ক্রমশ হতাশা গ্রাস করছে দেশের একটা বড় অংশকে। যেদেশে সরকারি কর্মকর্তার জীবনেরই কোনো নিরাপত্তা নেই, সেদেশে সাধারণ মানুষ যে নিশ্বাস বন্ধ করে আছে, তা সহজেই অনুমেয়।
ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সরকার ইউএনওদের নিরাপত্তায় বাসভবনে আনসার, পুলিশ বা সেনাবাহিনী দিলে কি কাজ হবে? হাতুড়ি দিয়ে ওয়াহিদা খানমের খুলি ভেঙে মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে অপরাধী, তিনি রাজনৈতিক দলের নেতা বলে জানা গেছে। আর ইউএনওদের ওপর অনেক ধরনের চাপ থাকে, সেটাও আমরা জানি। যেমন: ধান, চাল ও গমের ভাগাভাগির চাপ, ঢেউ টিনের চাপ, টিআর-কাবিখার চাপ, টেন্ডারের চাপ এবং এরকম আরও নানা ধরনের চাপ। মাঠপর্যায়ে তারাই এই কাজগুলো বাস্তবায়ন করেন। সেখানে মাঠপর্যায়ে এসব কাজের ভাগাভাগি নেওয়ার জন্য নানা সেক্টর সক্রিয় থাকে। সরকারি কর্মকর্তা অসৎ হলে সুবিধা বেশি। কোনো সমস্যাই সেক্ষেত্রে সমস্যা হয় না। অন্যকে অত্যাচার করার পরেও এরা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াতে পারে। এমনকি শাস্তিস্বরূপ তাদের প্রমোশনও হয়। আর যারা সৎ, তারা মারামারি ও বদলির মুখে পড়েন।
আমি অতীতের কথায় যাচ্ছি না। সাম্প্রতিককালে ঘটা বিভিন্ন ঘটনা দেখে দেখে দেশবাসী অবাক হয়ে যাচ্ছে। নিজেরা নিজেদের মধ্যে, সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা করছে, কিন্তু কোথাও কোনো আর্জি জানাতে পারছে না। সবচেয়ে কষ্ট পাচ্ছেন সেই মানুষগুলো, যারা চান যে শেখ হাসিনার সরকার তাদের কাজ দক্ষতার সঙ্গে পালন করুক।
পত্রিকায় দেখলাম কারা কর্তৃপক্ষের নাকের ডগা দিয়ে ফাঁসির আসামি জেলে বসে মই বানিয়ে পালিয়ে গেল। এখনো তার কোনো খোঁজ নেই। কীভাবে এটা সম্ভব? তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে বলেছে, পুরো ঘটনায় কারাবিধি ও সরকারি চাকরি বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয়েছে। এ ঘটনার জন্য কাশিমপুর কারাগারের মোট ২৫ জনকে দায়ী করা হয়েছে। দোষীদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করা হয়েছে। কাশিমপুর কারাগারে মারাত্মক সব অপরাধীদের বাস। এরা যদি এইভাবে পালিয়ে যেতে পারে, তাহলে ভীষণ বিপদের কথা। বহুবার, বহু অপরাধ ঘটে যাওয়ার পর কমিশন গঠন করে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও, দায়িত্বপালনে দুর্নীতি ও অবহেলার কারণে আমরা দেখছি ফলাফল শূন্য।
তা না হলে এর কয়েকদিন পরেই ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে কয়েদি মিন্টু মিয়া কীভাবে সটকে পড়েন। কারাধ্যক্ষ মাহবুবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, আসামি গাজীপুরে শ্বশুরবাড়িতে গেছেন। এটা কী একটা ফাজলামি নাকি? কারা কর্তৃপক্ষ অবশ্য একদম নিশ্চিন্ত ছিল যে মাদকদ্রব্য বিষয়ক মামলার আসামি মিন্টু মিয়া ধরা পড়বে। ধরা যে পড়বেই এই বিষয়টি তারা এতটা নিশ্চিত ছিল, এ কারণে যে, আসামির সঙ্গে তিন জন কারারক্ষীও বেড়াতে বের হয়েছিল। এসবই পত্রিকায় প্রকাশিত খবর।
ঘটনার পর ঘটনা। প্রতিটি ঘটনাই একেকটি ব্যর্থতার সাক্ষ্য বহন করে। কোন ব্যর্থতা প্রশাসনের, কোনটা নাগরিক সমাজের, কোনটাই বা রাজনৈতিকদের বা নীতি নির্ধারকদের। আমাদের ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী হচ্ছে, পক্ষান্তরে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অর্জন। করোনা এসে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, করোনা পরীক্ষা, হাসপাতালের লাইসেন্স, হাসপাতালের প্রয়োজনীয় বরাদ্দ, মাস্ক, স্যানিটাইজার, পিপিই নিয়ে কতটা ভয়ংকর অপরাধ আমরা করেছি এবং এখনো করছি। করোনায় মানুষের মৃত্যু অব্যাহত রয়েছে। দারিদ্র্য বাড়ছে। কিন্তু, এই ভয়াবহ মহামারি ধর্ষক, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ কাউকেই থামাতে পারেনি। সবকিছুই আগের মতো চলছে। কারণ, মূর্খ মানুষের মতো আমাদের কেউ কেউ গায়ের জোরে প্রমাণ করতে চেয়েছি যে, আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী জাতি।
দেশে বছরের পর বছর ধরে কত মানুষ বিনা বিচারে কারাগারে পচে মরছে। কত মানুষ গুম, খুন হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। বুকটা ভেঙে যায়, যখন দেখি সাংবাদিক কাজলের ছেলে পলক প্ল্যাকার্ড হাতে একা দাঁড়িয়ে বাবার মুক্তির দাবি করছে। যখন দেখি রিফাত নামের ছোট্ট একটি ছেলে জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তার গুম হওয়া বাবার খোঁজ জানতে চাইছে। কত মা, কত বাবা, কত স্ত্রী, কত সন্তান শুধু খোঁজ করছে তাদের হারানো স্বজনের।
এসব খবর বা ছবি যখন দেখি, খুব আশঙ্কা তৈরি হয় সবার মধ্যে। কেউ জানেন না কে, কবে এর ভিকটিম হবেন। কেউ বলতে পারবেন না এই হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো কোথায় আছেন, কেমন আছেন? তারা আদৌ কোনোদিন ফিরে আসবেন কি না?
একদিকে রিফাত, পলক তাদের বাবাদের মুক্তি চেয়ে, খোঁজ চেয়ে পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছে, অন্যদিকে জামিন পেল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। যাদের বিরুদ্ধে প্রজেক্টের বালিশ কেনা ও ভবনে বালিশ তোলা মামলায় ৩১ কোটি ২৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে। এরকম আরও অনেক মামলার অভিযুক্ত দাগি আসামি হাসপাতালের বিছানায় দিব্যি আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন।
পত্রিকায় প্রকাশিত আরেক খবরে দেখলাম নির্মাণকাজে রডের বদলে বাঁশ দিয়ে কাজ করানোর পরও সরকারের শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী। যদিও তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। এরও আগে দেখেছি— করোনার মধ্যে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের চোখে ধুলা দিয়ে প্রভাবশালী দুই জন অপরাধী ভাই চার্টার্ড প্লেনে চেপে ব্যাংককে পালিয়ে গেল। শুধু তাই নয়, তারা সেখান থেকে ভার্চুয়ালি জামিনের আবেদনও জানাল। এরকম বৈসাদৃশ্যপূর্ণ আরও ঘটনা দিয়ে এদেশের সংবাদমাধ্যম ঠাসা। চারিদিকে এত দুর্নীতির ঘটনা, ধর্ষণ পৈশাচিকতা, নিপীড়ন, বৈষম্য ও নির্যাতনের খবর যে মানুষ এখন আর অবাক হতেও ভুলে যাচ্ছেন।
চারিদিকে এতসব অব্যবস্থা ও নেতিবাচক ঘটনার মধ্যেও লক্ষ্য করলাম, সিটি করপোরেশন হঠাৎ কুকুরদের মেরে রাজধানী থেকে বের করে দেওয়ার কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা বোধকরি রাজধানীকে পবিত্র নগরী বানাতে চায়। ইতোমধ্যেই কুকুর নিধনের দাবিতে ক্ষেপে উঠেছে কিছু লোক। এই বিশেষ ধরনের মানুষগুলোকে মানবিক কোনো দাবির পক্ষে কখনো দেখা যায়না রাস্তায় প্ল্যাকার্ড ধরে দাঁড়াতে, তারাই এবার দাঁড়িয়েছে। কুকুর খেদানেওয়ালা একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কুকুর যত্রতত্র প্রস্রাব করে রাস্তাঘাট অপবিত্র করছে। তাই এদের তাড়ানো উচিত।’ অথচ ঢাকায় যারা থাকেন, তারা জানেন কুকুরের নয়, যেখানে-সেখানে মানুষের প্রস্রাবের দুর্গন্ধে নগরবাসী বেশি নাকাল হচ্ছেন। কুকুর তাড়ানোর পক্ষে ব্যানার নিয়ে যে লোকগুলো দাঁড়িয়েছে, তাদের ব্যানারে লেখা আছে, ‘জনগণের টাকায় তৈরি রাস্তা কি বেওয়ারিশ কুকুরের দখলে থাকবে?’
এ প্রশ্নের জবাবে আমরা বলব, না, অবশ্যই এই রাস্তা কুকুরের দখলে থাকবে না। থাকবে দুর্নীতিবাজ, সুযোগসন্ধানী, প্রতারক, ঠগ, দখলদার, অসভ্য, ধর্ষক, নারী নিপীড়নকারী, মাস্তান, মৌলবাদী, উগ্রপন্থিদের দখলে। এখানে থাকবে
তারা, যারা দুর্নীতি করে সরকারের সকল অর্জনকে ম্রিয়মাণ করে দিচ্ছে। এখানে শুধু কুকুর কেন বিড়াল, পাখি, খেলার জায়গা, নদী, পার্ক, ঘাস, লতাপাতা কিচ্ছু থাকবে না। এখানে থাকবে সেই দুর্বৃত্তরা, যারা ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের মাথার খুলি ভেঙে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। যারা তার বাবাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে জখম করেছে। যারা একের পর এক পৈশাচিকতা চালিয়ে যাচ্ছে দেশজুড়ে। আমরা বলতে চাই মানুষের অসভ্যতা আর নোংরামির কারণে কুকুরদের থাকার জায়গা নোংরা হচ্ছে। দেশ থেকে, শহর থেকে নোংরা-অসৎ মানুষ সরান, কুকুর না।
একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই। ১৫/১৬ বছর আগে আমাদের ফ্ল্যাটের মিটিংয়ে আমাকে বলা হলো, ‘আপনাদের বাসায়তো ফেরেশতা আসবে না। কারণ, আপনারা কুকুর পালন করেন।’ তারা এও বললেন, ‘জানেন, একটি বাড়িতে কুকুর থাকলে পুরো বিল্ডিংয়ে ফেরেশতা আসবে না? তা ছাড়া, কুকুর সিঁড়ি বা লিফট দিয়ে ওঠানামা করে, তাহলেতো সেখান দিয়েও ফেরেশতা আসবেনা।’ কতগুলো তথাকথিত শিক্ষিত লোকের মুখে এইসব অদ্ভুত কথা শুনে আমি থ বনে গেলাম।
অবাক হয়ে বোকার মতো জানতে চাইলাম, ‘আচ্ছা ফেরেশতারা কি লিফট বা সিঁড়ি ব্যবহার করেন? তা ছাড়া, আমরা তো কুকুরটিকে বাইরে বের হতেই দেই না। এমনকি অন্যদের অসুবিধা হতে পারে বলে ওকে আমরা গলা ছেড়ে ঘেউ ঘেউ করতেও দেই না। তাহলে অসুবিধাটা কোথায়?’
আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বেগুনি রংয়ের সিল্কের শার্ট ও প্রচুর সোনার গহনা পরা একজন বললেন, ‘আপনারা কুকুর পালতে পারবেন না। এটা গুনাহ, বরং কবুতর রাখুন। নবীজি কবুতর পালতেন, আমিও কবুতর পালি।’ এরপর আর কী কথা থাকতে পারে?
পাপ্পির ভাগ্য নিয়ে দফারফা কী হতো, আমি জানিনা। তবে, যা ঘটলো তা বেশ ইন্টারেস্টিং। হঠাৎ একদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে দেখি আমাদের পুরো বিল্ডিংটি পুলিশ ঘিরে আছে। পুলিশ জানালো আমাদের বিল্ডিংয়ের সাত তলায় একজন অভিযুক্ত খুনি বসবাস করেন, তাকে গ্রেপ্তার করতেই পুলিশ এসেছে। আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম গ্রেপ্তারকৃত সেই খুনিটি আর কেউ নয়, সেই বেগুনি শার্ট পরা ব্যক্তি, যিনি আমাকে কবুতর পালনের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
অগত্যা পাপ্পির কপাল খুলে গেল। কেন যেন ফ্ল্যাটবাসীরা কুকুর নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। হয়তো তারা বুঝতে পেরেছিলেন, একটি ফ্ল্যাটে কুকুর থাকলে যদি পুরো বিল্ডিংয়ে ফেরেশতা না আসে, তাহলেতো একটি ফ্ল্যাটে খুনি থাকলে পুরো বিল্ডিংয়ের অবস্থা আরও শোচনীয় হবে। লোকটির খুনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল।
নীতি-নৈতিকতা আমাদের শেখায় অসৎ, মুনাফিক, ঘুষখোর, চরিত্রহীন, অত্যাচারী মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা উচিত। আদর্শলিপি আমাদের শিখিয়েছে, ‘অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে তৃণসম দহে।’ এই হিতোপদেশ শুনে, আমাদের উচিত দুর্নীতিবাজ মানুষকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা। তাতে মানুষ বাঁচবে, দেশ বাঁচবে।
কুকুর যদি শহরে ঘুরে বেড়িয়ে, আর প্রস্রাব করে শহর নোংরা করে, তাহলে অধার্মিক, দুর্নীতিপরায়ণ, অসৎ ও ধর্ষক লোকগুলো দেশের কতটা ক্ষতি করে, তা সহজেই অনুমেয়। তবে, আমরা এটা বুঝেছি যে বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষ অপরাধ, অসততা ও পাশবিকতাকে যতটা না ঘৃণা করে, এর চেয়ে অনেক বেশি ঘৃণা করে প্রভুভক্ত, সাহসী, বুদ্ধিমান ও সাহায্যকারী প্রাণী কুকুরকে।
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
ranjana@manusher.org
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments