প্রবাসীদের প্রতি এই অনাচার বন্ধ হোক
বিদেশে গেলে ভাগ্য বদলাবে, আয় হবে লাখ লাখ টাকা- এমন সব স্বপ্নে তারা ভিয়েতনামে গিয়েছিলেন। বিদেশে যাওয়ার জন্য যত নিয়ম-কানুন আছে সব প্রক্রিয়া শেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) ছাড়পত্র নিয়ে তারা গিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরেই শুরু হলো স্বপ্নভঙ্গ।
কাঙ্ক্ষিত চাকরি পেলেন না। বেতন নেই। বিক্রি করে দেওয়া হলো দালালদের কাছে। চলল নিপীড়ন। প্রতিকারের আশায় গেলেন বাংলাদেশ দূতাবাসে। সেখানে প্রথমে জুটল লাঞ্ছনা। অভিযোগ উঠল দূতাবাস দখল করতে এসেছেন। কিন্তু সেই অভিযোগের কোনো প্রমাণ মিলল না। মাসখানেকেরও বেশি সময় মানবেতর জীবনযাপনের পর দেশে ফিরে ঠাঁই হলো কোয়ারেন্টিন সেন্টারে। ১৪ দিন সেখানে অবস্থানের পর যখন বাড়ি ফেরার স্বপ্ন দেখছিলেন তখন ঠাঁই হলো জেলে।
আদালতের মাধ্যমে গতকাল এই ৮১ জন ও দুই জন কাতারফেরতসহ মোট ৮৩ জনকে জেলে পাঠানো হয়। গৎবাঁধা সেই পুরনো অভিযোগ এনেছে পুলিশ- ‘এরা বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। ভবিষ্যতে তাদের বাংলাদেশে অপরাধে জড়ানোর সম্ভাবনা রহিয়াছে। জনগণের জানমালরে নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক।’
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এর আগে কুয়েত, কাতার ও বাহরাইন থেকে আসা ২১৯ জনকে দিয়াবাড়ি থেকে জেলে নেওয়ার সময় যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, এবারও সেই একই অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিটি শব্দ, বাক্য, একই। সেই একই অভিযোগ, কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য সলাপরামর্শ করছিলেন। পুলিশ গোপন সূত্রে ওই সলাপরামর্শের খবর জানতে পেরেছে।
ভিয়েতনাম ফেরতদের বেলাতেও সেই একই কথা- ‘দিয়াবাড়ির কোয়ারেন্টিন সেন্টারে থাকাকালে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত থাকার উদ্দেশ্যে তারা সলাপরামর্শ করিত। পুলিশ এসে জিজ্ঞাসা করলে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। ধর্তব্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে সন্দেহে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হলো। তারা জামিনে মুক্তি পেলে পালিয়ে যেতে পারে। তাই জেলখানায় রাখা দরকার। প্রয়োজনে রিমান্ডে ব্যাপকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন হতে পারে।’
অভিযোগগুলো পড়লে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। কেউ কি এতটুকুও তদন্ত করার প্রয়োজন বোধ করে না? এমনকি শব্দও বদলানোর প্রয়োজন বোধ করে না। কেউ যদি আগের ৪ জুলাইয়ের মামলা আর ১ সেপ্টেম্বরের আজকের মামলার অভিযোগে পড়ে থাকেন, দেখবেন কপি-পেস্ট করতে গিয়ে তথ্যও ভুল লিখেছে।
এর আগে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যারা ফেরত এসেছিলেন তারা ছোটখাটো অপরাধে সেখানে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ভিয়েতনামের এরা কেউ জেলে ছিলেন না। বরং নিজেরাই দূতাবাসে অভিযোগ দিয়ে দেশে ফিরেছেন। কিন্তু ভিয়েতনাম ফেরতদের বেলাতেও সেই একই লাইন রাখা হয়েছে, এই ৮১ জন আগে জেলে ছিলেন এবং নানা অপরাধে যুক্ত ছিলেন। অথচ এই বাংলাদেশিরা নিজেরাই ভিয়েতনামের বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে অভিযোগ করেছিলেন দালালদের বিরুদ্ধে।
এই ৮১ জনের মধ্যে ২৭ জন প্রথমে বাংলাদেশ দূতাবাসে যান। তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এই ২৭ জন বাংলাদেশি ভিয়েতনামের বাংলাদেশ মিশনটি দখল করে ফেলে। কিন্তু পরে জানা যায়, তারা প্রতিকার চাইতে গিয়েছিলেন।
তারপরেও যদি ধরে নেওয়া যায়, আসলেই ওই ২৭ বাংলাদেশি দূতাবাস দখল করতে গিয়েছিলেন, আসলে যদি তারা অপরাধী হন, তাহলে যারা তাদের ভিয়েতনামে পাঠিয়েছেন, যারা তাদের ছাড়পত্র দিয়েছিলেন, নিশ্চয়ই তারাও দূতাবাস দখলের সহযোগী। তাহলে সেই রিক্রুটিং এজেন্সি যারা তাদের পাঠাল কিংবা যে সরকারি কর্মকর্তারা ছাড়পত্র দিলো, তাদের বিচার কেন হবে না?
আচ্ছা কাউকে দায়মুক্ত করতেই কি এই প্রবাসীদের জেলে পাঠানো হল? হয়ত ছয় মাস বা এক বছর পর এই প্রবাসীরা ঠিকই মুক্তি পাবে, কিন্তু ততদিনে তারা দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সব সাহস হারিয়ে ফেলবে। এই কি তবে উদ্দেশ্য? একেই বুঝি বলে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে।
ভিয়েতনামের বিষয়টা আলোচনায় আসে এ বছরের জুলাই মাসে। ৩ জুলাই ভিয়েতনামের বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় ১১ জন বাংলাদেশি ঢাকায় ফেরেন। ফিরে আসারা জানান, গত বছরের নভেম্বরে তারা ভিয়েতনামে যান। কিন্তু কেউই প্রতিশ্রুত কাজ কিংবা বেতন পাননি। পাচারকারী চক্র তাদের বেতন থেকে টাকা কেটে রাখত। দেশে টাকা পাঠাতে চাইলে টাকা নিত। সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়া লোকজন দেশে ফিরতে বাধ্য হন।
এই ১১ জন ফেরত আসার পরই জানা যায়, আরও অন্তত ২৭ বাংলাদেশি একই অভিযোগ নিয়ে দূতাবাসে। ক্রমেই সেই সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং প্রায় একশ হয়ে যায়। এই প্রবাসীরা দূতাবাসে জানান, ভিয়েতনামে ভালো চাকরি মিথ্যা প্রলোভন ও উচ্চ বেতনের হাতছানি দেখিয়ে কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সি ও ট্রাভেল এজেন্সি একজোট হয়ে জনপ্রতি ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নেয়। এরপর এমইটির ছাড়পত্র নিয়ে ২০২০ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের বিভিন্ন সময়ে তাদের ভিয়েতনাম পাঠায়। কিন্তু সেখানে তাদের ঠিকমতো কাজ দেওয়া হয়নি। বরং নানাভাবে অত্যাচার করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জীবন বাঁচানোর তাগিদে ও দেশে ফেরার জন্য তারা দূতাবাসে হাজির হয়ে লিখিত অভিযোগ দেন।
কী বিস্ময়কর ঘটনা! বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইন ২০১৩ আইন অনুযায়ী, বিদেশে কোনো সমস্যা হলে প্রবাসীরা নিজ দেশের দূতাবাসে যাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। অথচ বলা হলো, এরা দূতাবাস দখল করতে গেছে।
অবশ্য গণমাধ্যমে বার বার খবর এবং এসব প্রবাসীর অনড় অবস্থানের কারণে পরে তাদের দেশে আনতে রাজি হয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাস। সর্বস্ব খোয়ানো এই শ্রমিকেরা গত ১৮ আগস্ট ভিয়েতনাম থেকে দেশে ফেরেন। বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরার পর থেকে দফায় দফায় তারা জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হন। উঠে আসে প্রত্যেকের করুণ কাহিনী। এরপর তাদের কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়।
কিন্তু কোয়ারেন্টিন শেষ হওয়ার দিন দুয়েক আগে থেকে তারা যেখানে ছিলেন, সেখানে পুলিশের তৎপরতা বাড়ে। দুদিন আগেই শোনা যায় তাদের জেলে পাঠানো হবে। কিন্তু তাদের অপরাধটা কী? প্রতারিত হয়ে দূতাবাসে যাওয়া কি অপরাধ? পাচারকারীদের শাস্তি চাওয়া অপরাধ? নাকি মিথ্যা মামলা বা ভুল তথ্য দিয়ে অভিযোগ বানানো অপরাধ?
কেউ কেউ বলতে পারেন, প্রবাসীরা কি অপরাধ করলে সাজা পাবেন না? অবশ্যই পাবেন। রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে যদি আসলেই অভিযোগ থাকে, যদি আসলেই অপরাধের প্রমাণ থাকে, রাষ্ট্র অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু তাই বলে যারা ভুক্তভোগী, যারা বিচার চাইতে গেলেন, তাদের জেলে নিতে হবে?
ভিয়েতনাম ফেরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা বার বার বলেছেন, ভিয়েতনামে ১০ বাংলাদেশির একটি দালাল চক্র গড়ে উঠেছে, যাদের সঙ্গে দূতাবাসেরও ভালো সম্পর্ক আছে। এই দালালেরা বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করে। কম টাকায় দুর্গম এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে অমানবিক কাজ করতে বাধ্য করে। এ দালাল চক্রের মূল হচ্ছেন মোস্তফা। তার সঙ্গে কাজ করেন আতিকুর রহমান, সাইফুল ইসলাম, জাব্বার, মিলন, আকরাম, নাসির, মাসুদ, ইফতেখার ও রায়হান। এর মধ্যে মোস্তফা, সাইফুল ও আতিক সেখানে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বাস করছেন। এই দালালদের কারো বিরুদ্ধেই কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি দায়ী এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধেও। বরং যারা ভুক্তভোগী তাদেরই জেলে পাঠানো হলো।
এর আগে, ভিয়েতনামে মানবপাচারে জড়িত অভিযোগে তিন জনকে আটক করে র্যাব-৩। তারা কিন্তু প্রবাসীদের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছিল। রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থাও ঘটনার তদন্ত করেছিল। তাতে ভিয়েতনামের দালালচক্রের তথ্য উঠে এসেছিল।
এই যে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কমপক্ষে ১২০০ বাংলাদেশি কাজের আশায় ভিয়েতনাম গেলেন, কী করে রাষ্ট্র তাদের অনুমতি দিলো? আমাদের দূতাবাস কেন ঢাকায় এই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে বলল না? বিএমইটি কেন ছাড়পত্র দিলো?
বিস্ময়কর কাণ্ড হলো, এসবের তদন্ত না করে যারা বিচার চাইতে গেলেন, তারাই আজ জেলে। অথচ যারা বিদেশে পাঠিয়েছিলেন, দেশে-বিদেশের সেই দালাল ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো আছে বহাল তবিয়তেই। প্রশ্ন হলো, যাদের দায়িত্বে অবহেলায় এই প্রবাসীদের করুণ পরিণতি, তাদের কি বিচার হবে না? দেশের ভাবমূর্তি যদি আসলেই ধরে রাখতে হয়, তাহলে তো এসব ঘটনার তদন্ত হওয়া জরুরি। কিন্তু সেসব দিকে না গিয়ে প্রবাসীদেরই কেন বারবার হয়রানি করা হচ্ছে?
রাষ্ট্রকে বলব, অপরাধীদের বিচার করুন। কিন্তু বিনা অপরাধে কেউ যেন সাজা না পায়। কারও অপরাধ ঢাকতে নিরীহ কাউকে যেন সাজা না দেওয়া হয়। রাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ, ভিয়েতনামের এই ঘটনাটি নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করুন। এখানে দালাল থেকে শুরু করে এজেন্সি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিএমইটি, দূতাবাস, বিমানবন্দর কার কী ভূমিকা তদন্ত করুন। যে চিত্র উঠে আসবে সেখান থেকে করণীয় ঠিক করতে পারলে দেশের ভাবমূর্তিটা অন্তত নষ্ট হবে না।
আরেকটা কথা, আজ ১ সেপ্টেম্বর দিনের শুরুতেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। খুব আনন্দ নিয়ে আমরা বলছি, দেশে প্রথমবারের মত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়াচ্ছে। করোনার এই সংকটকালীন সময়েও প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন। তার বিনিময়ে কী জুটছে? প্রবাসীদের আমরা যথাযথ সম্মান দিতে তো পারছি না, তাই বলে কি এখন তাদের এভাবে জেলেও পাঠাতে হবে? এই অনাচার বন্ধ হোক।
শরিফুল হাসান, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
shariful06du@gmail.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments