ছোট ছোট দুঃখ, দুঃসহ সব স্মৃতি
‘আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। সেদিন দুপুরে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাবা আমাকে বলে গেলেন, ঠিকমতো লেখাপড়া করো। রাতে বাসায় ফিরে আমাদের দুই ভাইয়ের পড়া ধরবেন। কিন্তু বাবা আর পড়া ধরতে এলেন না। আর কোনো দিন বাবা আমাদের পড়া ধরবেন না। বাবা আমাদের কাছে এখন কেবলই ছবি। কেবলই স্মৃতি।’
সাত বছর আগে শোনা এই কথাগুলো এখনো কানে বাজে। কথাগুলো বলেছিলেন ২০ বছরের তরুণ আশিকুজ্জামান। তার বাবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্স করপোরাল মাহবুবুর রশীদ ছিলেন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত হন তিনি।
ক্যালেন্ডারে তারিখ ঘুরে প্রতিবছর ২১ আগস্ট আসে। সাংবাদিক হিসেবে অন্তত এক দশক আমার কাজ ছিল ২১ আগস্টের আগে নিহতদের স্বজন ও আহতদের সঙ্গে কথা বলা। ২১ আগস্টের কয়েকদিন আগে থেকে ঘুরে ঘুরে এসব সংবাদ সংগ্রহ করতে হতো। কয়েকটা দিন তখন ট্রমার মতো মনে হতো। আহতরা যখন তাদের শরীরের ক্ষতগুলো দেখাতো চমকে উঠতে হতো। কারো চোখ নেই। কারো হাতে ক্র্যাচ। স্বজনহারাদের কথা শুনতে গিয়ে প্রায়ই চোখের পানি মুছতে হতো। আর মাথার মধ্যে স্বজনহারাদের দুঃখগুলো গেঁথে যেতো।
এই যেমন শামীমা আক্তারের কথাগুলো আজও কানে বাজে। ২১ আগস্ট সে সময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার জনসমাবেশে চালানো হামলায় আওয়ামী লীগের ২৪ নেতা-কর্মী নিহত ও তিন শতাধিক আহত হন। নিহতদের একজন মাহবুব রশীদ শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মী ছিলেন।
শামীমা সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, ‘২১ আগস্ট সকালে সুধা সদনে যান মাহবুব। দুপুরে বাসায় ফেরেন। আমি তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার দিই তাকে। ইলিশ মাছ, বেগুন ভাজি আর ডাল ছিল। মাহবুব বলল, “মাছ রাতে খাব, এখন কাঁটা বাছার সময় নাই। সেই যে গেল আর ফিরে এলো না। মাছ খেতে গেলে এখনো প্রচণ্ড কষ্ট হয়।’
ওই হামলায় নিহত আরেকজন রতন শিকদার। তিনি যখন মারা যান, তখন তার বড় ছেলে নিয়াজুল হকের বয়স ছিল আট। আর মেয়ে আমেনা জাহান স্বপ্নার বয়স মাত্র তিন। এখন স্বপ্না বড় হয়েছে। বাবার কথা জানতে চাইলে স্বপ্না বলেছিল, ‘আব্বু আমার জন্য প্রায় প্রতিদিন দই নিয়ে আসতেন। আমি এখন আর দই খাই না।... আমার খুব মনে হয় আমার বাবা যদি আবার কোনোদিন দই নিয়ে আসতেন।’
স্বপ্নার সেই কথাগুলো কখনো ভুলবো না। বিবাহবার্ষিকীর দিন স্বামী মোস্তাক আহমেদের অপেক্ষায় ছিলেন আইরিন সুলতানা। কিন্তু, স্বামীর সঙ্গে তার আর কোনদিন দেখা হয়নি। তিনি সেই কষ্টের কথা কোনদিন কি ভুলতে পারবেন?
পুরান ঢাকার ওলিগলি খুঁজে কলেজছাত্র মামুন মৃধার বাসা বের করেছিলাম। পটুয়াখালী থেকে মাধ্যমিক পাস করে উচ্চমাধ্যমিকে পড়তে ঢাকায় এসেছিলেন মামুন মৃধা। ভর্তি হয়েছিলেন পুরান ঢাকার কবি নজরুল কলেজে। থাকতেন বাগদাসা লেনে চাচার বাসায়। তার চাচা আনোয়ার মৃধা বলেছিলেন, ‘সেদিন দুপুরের খাবার তাড়াতাড়ি খেল। আমাকে বলল, ওর খুব ইচ্ছা নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) খুব কাছ থেকে দেখবে। সেজন্য অনেক আগেই সমাবেশ গিয়েছিল সে এবং সামনের দিকে বসেছিল। বিকেলে গ্রেনেড হামলার সংবাদ শুনে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। খোঁজাখুঁজি করে জানলাম, ঢাকা মেডিকেলে লাশ পড়ে আছে।’
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার মেয়ে সুফিয়া বেগম হাজারীবাগের মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ২১ আগস্টের সমাবেশে নিহত হন তিনিও। সেদিনের স্মৃতিচারণা করে সুফিয়া বেগমের ছেলে সোহেল মুন্সি বলেছিলেন, ‘২১ আগস্টের সমাবেশের দিন মা দুপুরের আগেই বাসা থেকে চলে যান। বলেন, “শোন, আমি দুপুরে রান্না করতে পারব না। তোরা রান্না করে খেয়ে নিস। আমি রাতে এসে রান্না করে খাওয়াব। আমার মা আর কোনদিন আসেনি।’
পুরান ঢাকার খুঁজে পেয়েছিলাম নিহত যুবলীগের কর্মী বেলাল হোসেনের মা রোকেয়া বেগমকে। তিনি বলেছিলেন, ‘সেদিন বেলালের শরীরটা ভালো ছিল না। ঠাণ্ডা লেগেছিল। দুপুরের ভাত খায়নি। আমাকে বলল, “মা, নেত্রীর সমাবেশে যাব।” আমি বললাম, “খাবি না?” আমাকে বলল, “মা, বেশি করে ঝাল দিয়ে ভর্তা বানিয়ে রাখো। বিকেলে এসেই খাব।” কিন্তু, আমার ছেলে তো আর ফিরল না। আর কোনদিন ওকে খাওয়াতে পারলাম না।’
বেলাল হোসেনের সঙ্গে একই মহল্লায় বেড়ে উঠেছিলেন হারুন-অর-রশিদ। সে দিনের স্মৃতিচারণা করে হারুন বললেন, ‘আপার (শেখ হাসিনার) বক্তব্য শেষে প্রচণ্ড শব্দ। দেখি চারপাশে সাদা ধোঁয়া। কী হয়েছে কিছু বোঝার আগেই মাটিতে পড়ে গেলাম। মহল্লার দুই ছেলে আমাকে টেনে তোলে। পাশেই দেখি ছোটবেলার বন্ধু বেলাল পড়ে আছে। পুলিশ আমাদের দিকে বন্দুক নিয়ে তেড়ে আসছে। আমার দুই হাত থেকে তখন ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমি বললাম, বন্ধু বিদায়।’
এই হামলায় আহতদের কথা শুনতে শুনতে আমি নিজেও ফিরে যেতাম ঘটনার দিনে। ঢাকা বিশ্ববদ্যিালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ ফাইনাল দিয়েছি তখন। কাজ করি একটা পত্রিকায়। সেদিন দুপুরে পুরান ঢাকার বাংলাবাজারে ছিলাম। হামলার সংবাদ শুনে দ্রুত গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারের কাছাকাছি এসে মনে হলো কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। চারপাশে মানুষের আহাজারি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। স্যান্ডেল পড়ে আছে হাজার হাজার। যে যেভাবে পারছে ছুটছে। একটা ভয়াবহ আতঙ্ক। দৃশ্যগুলোর কথা ভুলতে পারিনি আজও।
পৃথিবীর আর কোনো দেশে একটা রাজনৈতিক দলের ওপর কিংবা একজন নেত্রীকে হত্যার জন্য এমন বর্বর হামলা হয়েছে বলে শুনিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। আর শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ২১ আগস্টের হামলা। নেতাকর্মীরা সেদিন মানববর্ম তৈরি করে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেন। দুঃখের বিষয় হামলার বিচার করার বদলে তখন ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজানো হয়। ১৫ আগস্টের পর ২১ আগস্টের এই ঘটনায় বদলে যায় বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ।
ওই হামলায় নিহতদের স্বজনদের আছে নানা সব বেদনা। আর বেঁচে থাকাদের এখনো ভয়াবহ যন্ত্রণা নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। প্রায় সবার শরীরের বিভিন্ন অংশে এখনো রয়েছে অনেকগুলো স্প্লিন্টার। আহত একজন রাশিদা আক্তার বলেছিলেন, ‘সমাবেশের দিন আইভি (আইভি রহমান) আপা আমার ডান পাশে ছিলেন। নেত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ বিকট আওয়াজ। আমি উড়ে গিয়ে কোথায় যেন পড়লাম! সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারাই। আমার দুই পা ভেঙে যায়। এক সময় কানে ভেসে আসে কান্না, আর্তনাদ আর চিৎকার। কিছু লোক আমাকে তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তবে চিকিৎসকেরা আমাকে মৃত মনে করে লাশের সঙ্গে ফেলে রাখেন। সাদা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দেওয়া হয়। পরে শুনেছি, আমি নাকি যন্ত্রণার চোটে আওয়াজ করলে আমাকে সেখান থেকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ভারতে চিকিৎসা নেওয়ার সময় আমার পা থেকে শত শত স্প্লিন্টার বের করা হয়। তিন বছর পর্যন্ত হুইলচেয়ার ব্যবহার করেছি। এখন ক্রাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করি। কিন্তু অসহ্য যন্ত্রণা...।’
ওই হামলায় আহত নাজমুল হাসানকে মৃত মনে করে লাশের সঙ্গে ফেলে রাখা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে লাশ সরাতে গিয়ে দেখা যায়, তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। একজন চিকিৎসক তখনই তাকে রক্ত দিলেন। রাতেই তাকে নেওয়া হয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে। এরপর ভারতে।
নাজমুল হাসান আমাকে বলেছিলেন, ‘একটি সভ্য-স্বাধীন দেশে কি এমন ঘটনা কখনো ঘটতে পারে?’ শুধু নাজমুল নয় শত শত স্প্লিন্টার বয়ে বেড়ানো আহত সবারই একই প্রশ্ন। হত্যার এমন নোংরা রাজনীতি বন্ধ ও হামলার ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চান তারা। তবে তাদের স্বান্তনা একটাই। শেখ হাসিনা বেঁচে আছেন। এ প্রসঙ্গে গ্রেনেড হামলায় চোখ হারানো দেলোয়ারের কথাগুলো আজও কানে বাজে।
মাদারীপুরের দেলওয়ার হোসেন ঢাকায় বাস চালাতেন। আওয়ামী লীগের মিরপুর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সেদিনের স্মৃতিচারণ করে আমাকে বলেছিলেন, ‘বিস্ফোরণের পর আমার মনে হলো চোখ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। চোখে হাত দিয়ে দেখি ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। পরিচিত এক বাসশ্রমিক আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। ডাক্তাররা আমাকে দেখে জানান, “চোখের মণি গলে গেছে গ্রেনেডে।” চব্বিশ দিন চক্ষু হাসপাতালে ছিলাম। বাম চোখে আর দেখতে পাই না। আমি খুব গরিব। সংসার চালাতে পারি না। সান্ত্বনা এই যে আমার চোখ গেছে, কিন্তু নেত্রী তো বেঁচে আছেন।’
শরিফুল হাসান, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
Comments