শাহাদত চৌধুরী, একজন সম্পাদক একজন মুক্তিযোদ্ধা
তিনি কাগজ ছিঁড়ছেন। হেলান দিয়ে চেয়ারে বসে নিউজ প্রিন্টের প্যাড থেকে একটির পর একটি কাগজ নিচ্ছেন, আর ছিঁড়ছেন। অনর্গল কথা বলছেন। কথায় হালকা রসিকতা আছে, আর আছে মুক্তিযুদ্ধ। প্রায় পুরোটা জুড়েই মুক্তিযুদ্ধ। জীবনটা জুড়েই ছিল ১৯৭১-রণাঙ্গন-মুক্তিযুদ্ধ।
২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ, গেরিলা কমান্ডার মেজর হায়দার বা মুক্তিযোদ্ধা ওহাব বা নজু ভাইয়ের বীরত্বের গল্প বলতেন, আর চোখ মুছতেন।
ছোট্ট রুমটিতে সামনে হয়ত বসে আছেন ফয়েজ আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক বা শওকত আলীর মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব, বা অফিসের কর্মীরা। তার আচরণ-ভঙ্গি একই রকম। সৈয়দ শামসুল হক বা শওকত আলী হয়তো বললেন, এভাবে কাগজ না ছিঁড়লে হয় না!
একান্ত নিজস্ব লজ্জিত ভঙ্গিতে হাতের কাগজ ফেলে দিয়ে নড়েচড়ে বসলেন। আর ছিঁড়বেন না, এমন একটি মনোভাব। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার কাগজ ছিঁড়তে শুরু করলেন। নিউজ প্রিন্টের একটি প্যাড শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই আরেকটি প্যাড সামনে দিয়ে গেলেন বিশ্বস্ত অফিস সহকারী মনির।
এভাবে গল্প আর কাগজ ছিঁড়তে ছিঁড়তেই বাংলাদেশের সমাজ-জীবন-নিজস্বতা-রুচিবোধ ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক কিছু দৃষ্টান্তের জন্ম দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সফল ও প্রভাবশালী সম্পাদক, মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরীর কথা বলছি। বলছি বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর কথা। এই মানুষটি জন্মেছিলেন আজকের এই দিনে, ২৮ জুলাই ১৯৪৩ সালে।
চারুকলা থেকে পাস করা চিত্রশিল্পী, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রিয় ছাত্র শাহাদত চৌধুরীর বর্ণাঢ্য অনুকরণীয়-অনুসরণীয় সাংবাদিকতা জীবনের আগে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে সামান্য আলোকপাত।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’র পাতায় পাতায় জীবন্ত হয়ে আছেন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী। একাত্তরের দুর্ধর্ষ গেরিলা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীকের ‘ব্রেভ অব হার্ট’ বইয়ে বর্ণনা আছে শাহাদত চৌধুরীর গেরিলা অপারেশন পরিকল্পনার। ১৯৭১ সালে ২ নম্বর সেক্টরের গেরিলারা ঢাকায় যে অপারেশন চালিয়েছিলেন, তার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন শাহাদত চৌধুরী। হাটখোলায় তাদের পারিবারিক বাড়িটি ছিল গেরিলাদের অন্যতম ঘাঁটি। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিতেন, অস্ত্র মজুদ রাখতেন। সহযোদ্ধা রুমী ধরা পড়ার পর ঢাকা শহরে যে দশ বারোটি বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনী অভিযান চালিয়ে অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার করেছিল, তারমধ্যে ছিল শাহাদত চৌধুরীদের হাটখোলার বাড়িটিও। শাহাদত চৌধুরী, ফতেহ চৌধুরী, ডা. মোরশেদ চৌধুরী তিন ভাই যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। খালেদ মোশাররফ ও মেজর হায়দারের অন্যতম কাছের মানুষ ছিলেন শাহাদত চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে প্রথম কিছু নির্দেশনার ঘোষণা দিয়েছিলেন ফতেহ চৌধুরী। তারপর সেদিনই বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর প্রতি নির্দেশনা দেন মেজর হায়দার। এসব কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন শাহাদত চৌধুরী।
স্বাধীন বাংলাদেশে চিত্রশিল্প নয়, সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকে নেশা ও পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে ২ নম্বর সেক্টর থেকে প্রকাশিত লিফলেট লিখতেন শাহাদত চৌধুরী, সম্পাদনা করতেন ১৯৫৫ সালের ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ। ‘সেক্টর কমান্ডার বানান-ভাষা ঠিক করছেন’- গেরিলাদের মধ্যে হাসাহাসির ঘটনা ঘটত। শাহাদত চৌধুরীর ব্যক্তিত্ব বোঝার জন্যে হাবিবুল আলম বীর প্রতীকের ‘ব্রেভ অব হার্ট’ বই থেকে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
‘খালেদ মোশাররফ শাহাদত ভাইকে ডেকে বললেন, শোনো শিল্পী আমি ঢাকাকে গোরস্তান বানাতে চাই। একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাই।’
শাহাদত ভাই বললেন, ‘কাদের দিয়ে মিশিয়ে দেবেন?’
‘কেন তোমাদের দিয়ে, ছাত্রদের দিয়ে।’
শাহাদত ভাই বললেন, ‘ছাত্ররা কি এখানে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছেন, তাদের বাবা-মাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে? তারা কি তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করতে এখানে এসেছেন? আপনি কি আপনার মা-মেয়েকে হত্যা করতে চান? আপনি এটি করতে পারেন না।’
খালেদ মোশাররফ থমকে দাঁড়ালেন। প্রথমবারের মতো কোনো সিভিলিয়ান খালেদ মোশাররফের সঙ্গে যুদ্ধের তর্কে জড়ালেন।
এই তর্কের মধ্য দিয়ে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে শাহাদত চৌধুরীর সখ্যতা তৈরি হলো। বদলে গেল যুদ্ধের পুরো পরিকল্পনা। সিদ্ধান্ত হলো, গোরস্তান নয়, ঢাকায় যারা আছেন তারা যেন ঢাকাতেই থাকেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। শাহাদত চৌধুরী লিফলেট লিখলেন। দশ বারোটি পয়েন্ট লেখা লিফলেট খালেদ মোশাররফ সম্পাদনা করলেন। যা ছড়িয়ে দেওয়া হলো ঢাকা শহরে।
এই লিফলেট বিলির প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল? হাবিবুল আলম বীর প্রতীক দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন, ‘ঢাকা শহরে অবস্থানরতদের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এলো। ঢাকা শহরে থাকা মানুষের উপলব্ধিতে এলো যে, পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাল্টা কিছু একটা হতে যাচ্ছে।’
এবার শাহাদত চৌধুরীর সাংবাদিকতায় অবদান বা জীবন সম্পর্কে দু-একটি কথা। স্বাধীন দেশে সাংবাদিকতাও ছিল তার মুক্তিযুদ্ধেরই অংশ। সবকিছুতেই ছিল বাংলাদেশ, দেশের মানুষ, নিজস্বতা-স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। প্লেবয় থেকে শুরু করে নিউজ উইক, টাইম, ভোগ...যাবতীয় ম্যাগাজিনের পাঠক ছিলেন। বর্ণাঢ্য বিষয়বস্তুর বইয়ের পাঠক ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের আগে জাতীয় দৈনিকে গল্প লিখেছেন। গল্পের ইলাস্ট্রেশন করেছেন।
‘হ্যালো সোহানা’র দুই পর্বসহ কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানার ছয়-সাতটি বই তার লেখা। অনেকগুলো মাসুদ রানার প্রচ্ছদ এঁকেছেন। ছবির কোলাজে বাংলাদেশে প্রচ্ছদের ধারণা শাহাদত চৌধুরীই প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের প্রচ্ছদ শিল্পের রাজপুত্র ধ্রুব এষ যার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
স্বাধীন দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ বিচিত্রা, শাহাদত চৌধুরী। সাপ্তাহিক ২০০০ এও সেই ধারা অব্যাহত ছিল। পরবর্তীতে দেশের গণমাধ্যমে তা আরও বিস্তৃত হয়েছে। বহু বিচিত্র বিষয় অভিনব ঢঙে বিচিত্রার প্রচ্ছদে এনেছিলেন শাহাদত চৌধুরী। ১৯৭৮ সালে অ্যাবর্শনের পক্ষে প্রচ্ছদ করেছিল বিচিত্রা। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থেকে বিচিত্রা নারীর ছবি দিয়ে প্রচ্ছদ করেছে ‘বিয়ে একটি সনাতন প্রথা’। স্বাধীনতার পর প্রথম গণপিটুনিতে নিহত যুবককে নিয়ে বিচিত্রা প্রচ্ছদ করে। সেই সংখ্যায় গণপিটুনির প্রত্যক্ষদর্শী মাসুদ রানার লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন বিচিত্রাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়েছে, প্রাণের মূল্যই কি শুধু কম থাকবে?’
বিষয় বৈচিত্র্য ও আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ পরিকল্পনা বিচিত্রাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। বিমানবালা, ছেলেদের চোখে মেয়েরা, মেয়েদের চোখে ছেলেরা, বেদের জীবন, শিশু পাচার, বেলী ফুলের বিয়ে, হাসি নিয়েও প্রচ্ছদ করেছে বিচিত্রা।
১৯৭৩ সালে বিচিত্রার বছরের আলোচিত চরিত্র ছিল ‘আততায়ী’। ১৯৭৪ সালের আলোচিত চরিত্র ছিল ‘স্মাগলার’।
সেই সময় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কম্বোডিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভিয়েতনাম, ইরান ঘুরে রিপোর্ট করেছে বিচিত্রা।
সজীব সচল বাংলাদেশের স্থির প্রতিকৃতি শিরোনামে ‘বর্ষপঞ্জী’ প্রকাশ করেছে প্রতি বছর।
চিঠিপত্র, ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনও ছিল বিচিত্রার আলোচিত বিষয়। তসলিমা নাসরিন বিচিত্রায় চিঠি ও ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন দিয়েই প্রথম পরিচিতি পেয়েছিলেন।
ঈদ উপলক্ষে বা নতুন পোশাকের বাজার ছিল ভারতীয় পোশাকের দখলে। নিজস্ব পোশাক বা দেশীয় বুটিক শিল্প গড়ে তোলা ও বিকাশের উদ্যোগ নেন শাহাদত চৌধুরী। আয়োজন করতে শুরু করেন ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা। যার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে দেশীয় বুটিক শিল্প। নির্বাচিত পোশাক মডেলদের পরিয়ে, ছবি তুলে অ্যালবাম প্রকাশ করতে শুরু করে বিচিত্রা। বিচিত্রার অ্যালবাম দেখে পোশাক কিনতে শুরু করে মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তের রুচি তৈরিতে ভূমিকা রাখে বিচিত্রা, শাহাদত চৌধুরী।
বলে রাখা দরকার সেই সময় দেশে এখনকার মতো মডেল ছিল না। নিজের ও বন্ধু-পরিচিতজনের সন্তানদের মডেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বিশেষ করে নারী মডেল পাওয়া দুষ্কর ছিল।
শাহাদত চৌধুরী উদ্যোগ নিলেন ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতার। চিত্র নায়িকা মৌসুমী-পপি থেকে মডেল মৌ-অপি করিমরা ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতার সুফল। মডেল-নায়িকা তৈরি তো বটেই, তার চেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক অচলায়তন ভেঙে নারীদের সামনে নিয়ে আসা। বহু প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তা তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
সাহিত্য নির্ভর পূজা সংখ্যা প্রকাশিত হতো পশ্চিমবঙ্গ থেকে। শাহাদত চৌধুরী উদ্যোগ নিলেন বিচিত্রার ঈদ সংখ্যা প্রকাশের। যা প্রকাশিত হতে থাকল বাংলাদেশের লেখকদের লেখা দিয়ে। বাংলাদেশের লেখকদের লেখা দিয়ে মোটা ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হতে পারে, শাহাদত চৌধুরীর আগে এ কথা কেউ ভাবেননি। শুধু লেখকদের থেকে উপন্যাস, গল্প বা প্রবন্ধ এনে ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করত না বিচিত্রা। লেখকদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করতেন। শাহাদত চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা থেকে জন্ম হয়েছে বহু গুরুত্বপূর্ণ লেখার। লেখার ক্রিয়া-কৌশল নিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বই ‘মার্জিনে মন্তব্য’। এই লেখার ধারণা তিনি পেয়েছিলেন শাহাদত চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনা থেকে। সৈয়দ শামসুল হক বহু সম্পাদকের পত্রিকায় লিখেছেন। কিন্তু তিনি তার সম্পাদক মনে করতেন শাহাদত চৌধুরীকে। সৈয়দ হক ‘আমার সম্পাদক’ শিরোনামে তা লিখে গেছেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের দিক নির্দেশনামূলক প্রবন্ধগুলো প্রকাশ করেছেন শাহাদত চৌধুরী। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, ‘শাহাদতের কাছে ঋণী হয়ে আমরা ধনী হয়েছি।’
স্বনামধন্য সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের বিখ্যাত বই ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’। রাতের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র অফিস যে লেখার বিষয়-বস্তু। বইটির নাম শাহাদত চৌধুরীর দেওয়া। বাংলা ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায়। হুমায়ূন আহমদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ ও মুহাম্মদ জাফর ইকবালের প্রথম সায়েন্স ফিকশন ‘কপোট্রনিক ভালোবাসা’ প্রকাশিত হয়েছিল বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায়। পরবর্তীতে ‘কপোট্রনিক সুখ দুঃখ’ নামে বই প্রকাশিত হয়।
শাহাদত চৌধুরী বিশ্বাস করতেন স্বাধীন দেশ বিনির্মাণে স্বপ্নবান, সৎ-দক্ষ সংগঠক প্রয়োজন। সেই দক্ষ সংগঠকদের সন্ধান করেছেন তিনি। ১৯৭৪ সালে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে নিয়ে বিচিত্রার প্রচ্ছদ করেছেন ‘একটি স্বপ্ন একটি প্রকল্প’ শিরোনামে। ‘মাটি ও মানুষ’ খ্যাত তরুণ শাইখ সিরাজকে বিচিত্রার প্রচ্ছদে তুলে ধরেছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস, স্যার ফজলে হাসান আবেদের সুখ্যাতি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ার আগেই বারবার তাদেরকে বিচিত্রার প্রচ্ছদে এনেছেন।
১৯৮২ সালের যে ‘ওষুধ নীতি’ তারই সুফলে দেশীয় ওষুধ শিল্পের বিকাশ। এই ওষুধ নীতির কৃতিত্বের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সেই সময় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পাশে থেকে, সঙ্গে থেকে সর্বতোভাবে সহায়তা করেছে বিচিত্রা ও শাহাদত চৌধুরী।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠনের অন্যতম রূপকার শাহাদত চৌধুরী। জাহানারা ইমাম যে সবার আম্মা হয়ে উঠলেন, সেটাও শাহাদত চৌধুরীর কারণেই। বিচিত্রার সাংবাদিকরাই প্রথম সরেজমিন ঘুরে ঘুরে যুদ্ধাপরাধীদের তথ্য সংগ্রহ করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-আলামত হিসেবে যা কাজে লাগে।
সাত বীরশ্রেষ্ঠ’র তথ্য ও ছবি সংগ্রহ, শিল্পী সমন্বয়ে অংকন ও প্রকাশ করে বিচিত্রা। শাহাদত চৌধুরীকে এ কাজে সর্বতোভাবে সেই সময় সহায়তা করেছিলেন বর্তমানে প্রয়াত মেজর জেনারেল (অব:) আমিন আহমেদ চৌধুরী।
পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা, তারও নেপথ্যের অন্যতম কারিগর শাহাদত চৌধুরী। ২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর তার চলে যাওয়ার দিন।
শেষ করবো দুটি ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ দিয়ে।
১৯৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বিচিত্রা বন্ধ করে দেয়। বিচিত্রা বন্ধ হয়ে যাওয়ার দু-তিন দিন আগের ঘটনা। সকালে বিচিত্রা অফিসে ঢুকতেই নিজস্ব ভঙ্গির হাতের ইশারায় ডাকলেন। রুমে ঢুকে বসলাম। বিশ্বস্ত মনির ভাই ছেঁড়ার জন্যে নিউজ প্রিন্টের প্যাড শাহাদত চৌধুরীর টেবিলে রেখে গেলেন। নিজে চেয়ার থেকে উঠে রুমের দরজা বন্ধ করলেন। টেবিলে রাখা একটি কাঁচি হাতে দিয়ে ড্রয়ার থেকে অনেকগুলো ছবি ও ফিল্ম বের করলেন। বললেন, এগুলো টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলো। বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত নায়িকা ও একজন সঙ্গীত শিল্পীর ছবি। যে প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীর কয়েকটি গ্লামারাস ছবি এখনও মাঝে মধ্যে প্রকাশিত হয়। এই ছবিগুলো তার চেয়ে আলাদা।
ছবি ও ফিল্মগুলো কাটতে কাটতে বললাম, ছবিগুলো নষ্ট না করলে হয় না? রেখে দেওয়া যায় না?
আমার দিকে তাকিয়ে শাহাদত চৌধুরী বললেন, জীবনে বিশ্বস্ততার মূল্য রাখবে। তারা বিশ্বাস করে এই ছবিগুলো আমাকে তুলতে দিয়েছিলেন, প্রকাশ করার জন্য নয়। এই ছবিগুলো অন্য কারও হাতে পড়ুক, তা চাই না। কেটে ফেলো।
উল্লেখ্য, শাহাদত চৌধুরী খুব ভালো ছবি তুলতেন।
বিচিত্রার খুব সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি ছিল। এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে শুরু করে পৃথিবীর বহু গুরুত্বপূর্ণ বই ছিল বিচিত্রা-শাহাদত চৌধুরীর সংগ্রহে। বইগুলোর প্রতি আগ্রহ-লোভ ছিল। বিচিত্রা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগের দিন বললাম, শাহাদত ভাই কিছু বই নিয়ে যেতে চাই।
শাহাদত ভাই বললেন, না নিও না। বইগুলো নিতে চাই না। এরপরে যারা আসবেন, তারা এসে দেখবেন আমরা কীভাবে ছিলাম!
‘সংস্কারমুক্ত না হলে বিচিত্রা পড়বেন না’- এমন সাহসী শ্লোগান ধারণ করত শাহাদত চৌধুরীর বিচিত্রা।
স্বাধীন বাংলাদেশের একটি প্রজন্মের চিন্তার জগতকে বদলে দিয়েছিল বিচিত্রা। মধ্যবিত্তের রুচিবোধ ও সাংস্কৃতিক জাগরণে, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন একজন সম্পাদক, একজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরী।
Comments