বহুরূপী সাহেদ
পরিচয় ও ছবি— দুটোরই কোনো শেষ নেই মোহাম্মদ সাহেদের। কখনো তিনি অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, কখনো আওয়ামী লীগ নেতা, কখনো সম্পাদক-প্রকাশক, কখনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক, আবার কখনো প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
আর ছবি? রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, বিএনপির নেতা এবং তৎকালীন বিএনপির মন্ত্রী— সবার সঙ্গেই তার ছবি আছে।
তবে, এখন তার বড় পরিচয় রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান, যে হাসাপাতলে রোগী চিকিৎসার জন্য সরকার টাকা দিলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর কাছ থেকে টাকা আদায় করেছে এবং পরীক্ষা না করেই করোনার ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে।
শুধু নাম আর ছবি নয়, সাহেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং মামলারও শেষ নেই! পুলিশের হিসাবে তার বিরুদ্ধে মামলা আছে ৩২টি। এর মধ্যে ব্যাংকের চেক জালিয়াতি, বিদেশে টাকা পাচার, হত্যা ও মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি খুলে মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। জেলও খেটেছেন টাকা আত্মসাতের মামলায়।
নামের সঙ্গে সঙ্গে সাহেদের জাতীয় পরিচয়পত্রও একাধিক বলেও জানা গেছে।
র্যাবের প্রাথমিক তদন্তে বিরাট অঙ্কের টাকা তিনি বিদেশে পাচার করেছেন বলেও বেরিয়ে এসেছে। এ তথ্য র্যাব সূত্রে জানা গেছে। বিনা পরীক্ষায় করোনার সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে মর্মে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবদেনের পরিপ্রেক্ষিতে এই অভিযান চালানো হয় বলেও র্যাব সূত্র জানিয়েছে।
সাহেদের এই বিভিন্ন পরিচয় প্রদানের কথা সরকারি নথিতেও উল্লেখ আছে। ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পুলিশপ্রধানকে পাঠানো এক চিঠিতে সাহেদকে ভয়ংকর প্রতারক প্রকৃতির লোক হিসেবে উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালের রাজনৈতিক অধিশাখা-২’র উপসচিব নায়েব আলীর সই করা সেই চিঠিতে বলা হয়েছে, মোহাম্মদ সাহেদ বিভিন্ন সময়ে নিজেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর/লেফট্যানেন্ট কর্নেল এবং ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ও সেনাবাহিনীর ১৪তম বিএমএ লং কোর্সের অফিসার হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করে আসছে।
পাশাপাশি তিনি ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এডিসি ছিলেন বলেও পরিচয় দিয়ে থাকেন।
চিঠিতে সাহেদকে একজন ভয়ংকর প্রতারক প্রকৃতির লোক উল্লেখ করে নানা ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে তার জড়িত থাকার কথাও জানানো হয় পুলিশপ্রধানকে।
সাহেদের সম্পর্কে আরও কিছু ধারণা পাওয়া যায় লেফট্যানেন্ট জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর (বীর বিক্রম) দেওয়া ফেসবুক পোস্ট থেকে।
অবসরের আগে সারওয়ার্দী নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি, আনসার ও ভিডিপি এবং এসএসএফের মহাপরিচালক এবং সেনা গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।
পোস্টের ব্যাপারে ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে যোগযোগ করা হলে তিনি জানান, জেনে বুঝেই তিনি এই তথ্য দিয়েছেন এবং এই তথ্যের সত্যতা সর্ম্পকেও তিনি নিশ্চিত করেছেন। তবে, পত্রিকাকে নিজস্ব অনুসন্ধানের পরামর্শও দেন তিনি।
নিজের ফেসবুকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লেখার কারণে তার ফেসবুক মাঝে মাঝে বন্ধ করে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ করেন সারওয়ার্দী।
সারওয়ার্দীর লেখা থেকে জানা যায়, সাহেদ নিজেকে মেজর ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী, কর্নেল ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী, কখনো মেজর সাহেদ করিম হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু, তার আসল নাম জাতীয় পরিচয়পত্রে সাহেদ করিম।
কিন্তু, বর্তমানে তিনি (সাহেদ) মো. সাহেদ নামে আরেকটি জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করছেন। তিনি (সারওয়ার্দী) সাহেদের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর উল্লেখ করেছেন ২৬৯২৬১৮১৪৫৮৮৫।
দ্য ডেইলি স্টারের কাছে সাহেদের তথ্য অধিদপ্তরের দেওয়া অস্থায়ী এক্রিডিটেশন কার্ডের একটা কপি এসেছে। কার্ড নম্বর ৬৮৪৫ এবং এই কার্ড অনুযায়ী সাহেদ দৈনিক নতুন কাগজের প্রকাশক ও সম্পাদক। সেখানে তার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দেওয়া আছে ৮৬৫০৪০৬১৮৭।
সারওয়ার্দীর পোস্টে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বরের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা হয়। পত্রিকাটির ওই দিনের আর্কাইভে দেখা গেছে— ‘ভুয়া কলেজের প্রতারণায় শতাধিক পরীক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত’ শিরোনামে অনুমোদনহীন রিজেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের কারণে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারা শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।
র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লেফট্যানেন্ট কর্নেল সরোয়ার বিন-কাসেম বুধবার এক ব্রিফিংয়ে জানান, সাহেদের উত্থান মিথ্যা ও প্রতারণাকে কেন্দ্র করেই।
সাহেদ বহু নামে নিজের পরিচয় দিতেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতারণা সাহেদের মূল ব্যবসা এবং লোকজনের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ আত্মসাত করেছেন সাহেদ।’
র্যাবের অনুসন্ধানে সাহেদের ব্যক্তিগত অনেক কিছুই বেরিয়ে এসেছে। উত্তরাতে রিজেন্টের হেড কোয়ার্টারে তার জন্য সব রকম সুবিধাসম্বলিত নিজস্ব রুম ছিল এবং সেই রুমের দরজা ছিল অটোমেটেড। পাসওয়ার্ড ছাড়া খুলে না সেই দরজা।
তার গাড়িতে ছিল ভিআইপি হর্ন এবং ফ্লাগ স্ট্যান্ড। তার নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক একাধিক গানম্যান ছিল এবং ব্যবহৃত হতো ওয়াকিটকি। যদিও এসবের কোনোটারই অনুমোদন নেই।
তবে এ ব্যাপারে সাহেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যানের পাশাপাশি তিনি তার প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন পরিচয় ব্যবহার করতেন।
অবশ্য সারওয়ার্দী তার ফেসবুকে বলেছেন, তার সঙ্গে পরিচিতি পর্বে সাহেদ নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর এসডিজি সংক্রান্ত প্রধান হিসেবে উপস্থাপন করেন।
কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চুক্তি হয় গত ২১ মার্চ। অথচ এই হাসপাতালের অনুমোদনের মেয়াদ ২০১৪ সালেই শেষ হয়ে গেছে এবং নতুন করে এই অনুমোদনের মেয়াদ নবায়ন করা হয়নি।
র্যাবের অভিযানে দুটি বড় অভিযোগ ওঠে হাসপালটির বিরুদ্ধে। একটি নমুনা পরীক্ষা না করে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করত রিজেন্ট এবং অন্যটি হাসপাতালের সঙ্গে সরকারের চুক্তি অনুযায়ী তারা ভর্তি রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেবে এবং সরকার এই ব্যয় বহন করবে।
কিন্তু, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীপ্রতি লাখের বেশি টাকা বিল আদায় করেছে এবং পাশাপাশি এই চিকিৎসা বাবদ সরকারের কাছে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার বেশি বিল জমা দিয়েছে।
র্যাবের অভিযানের পর প্রশ্ন উঠেছে, কেন নবায়ন নেই এমন হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সাহেদের সঙ্গে ক্ষমাসীন দলের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের ও মন্ত্রীদের পরিচয় ও সুপারিশের কারণে তার হাসপাতালের কাগজপত্র পরীক্ষা করা হয়নি।
পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের সঙ্গেও সাহেদের ভালো সম্পর্ক এবং স্বাচিপের শক্ত অবস্থান ছিল রিজেন্টের পক্ষে। আওয়ামী লীগ এবং মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ওপরের নির্দেশে এই চুক্তি হয়েছে বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল সম্পর্কিত বিভাগের পরিচালক আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশ আসার পর এই চুক্তি করা হয়েছে। আমরা নির্দেশ পালন করেছি মাত্র।’
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য পদটাও তার এসব কাজে সহায়তা করেছে।
যদিও এখন আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করছেন, উপ-কমিটিতে তার নাম থাকলেও সেটা খসড়া কমিটি এবং এখনো সেই কমিটি অনুমোদন পায়নি।
তবে, দ্য ডেইলি স্টারের কাছে সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমিরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের আন্তজার্তিক বিষয়ক উপ-কমিটির একটি তালিকা আছে। সেখানে ২৪ নম্বরে সাহেদের নাম উল্লেখ করা আছে।
তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ অবশ্য সাহেদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন।
মন্ত্রণলয়ে এক সংবাদ সন্মেলনে সাহেদের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সে দাবি করছে, সে আওয়ামী লীগের কোনো একটা উপ-কমিটিতে ছিল। কিন্তু, আমাদের দলীয় কার্যালয়ে তো আমি প্রতিদিন যাই। সে আওয়ামী লীগের কোনো উপ-কমিটির সদস্য ছিল বলে আমার জানা নেই।’
অবশ্য হাছান মাহমুদ মনে করেন, এ ধরনের একটা হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করার আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল।
যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং বিএমএ প্রেসিডেন্ট ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এটাকে লজ্জাজনক বলে অভিহিত করেন।
‘এটা নৈতিকতা বিরোধী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এটা করতে পারে না’, উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এসব কর্মকাণ্ডে দল ও সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
চুক্তি সইয়ের সময় স্বাচিপ নেতাদের উপস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘স্বাচিব নেতারা এটার দায় এড়াতে পারেন না।’
আওয়ামী লীগের সাবেক স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ড. বদিউজ্জামান ভুইয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘চুক্তি সম্পাদনের আগে সেই হাসপাতালের কাগজপত্র ঠিক আছে কি না, সেটা পরীক্ষা করে চুক্তি করার দরকার ছিল।’
‘এ রকম একটা সেনসিটিভ বিষয়ে কোনো কিছু না জেনে কেন চুক্তি করা হলো আমি জানি না। করোনা নিয়ন্ত্রণে পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা সবচাইতে বেশি। যেখানে পরীক্ষা না করেই সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে, সেখানে কীভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ হবে?’ প্রশ্ন রাখেন তিনি।
কারো নাম উল্লেখ না করে বদিউজ্জামান বলেন, ‘সরকারি কোনো চুক্তির সময় তৃতীয় পক্ষের লোকের উপস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয় এবং সেটা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।’
দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘সাহেদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কোনো পর্যায়ের কোনো নির্বাহী পদে নেই সাহেদ।’
আমাদের সাতক্ষীরা প্রতিনিধির কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে সাহেদের জন্ম সাতক্ষীরা শহরের কামান নগর এলাকায়। তার বাবা সিরাজুল করিম এবং মা সাফিয়া করিম।
সাফিয়া করিম সাতক্ষীরা জেলা মহিলা লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। নবম শ্রেণি পর্যন্ত সাতক্ষীরাতে লেখাপড়া করেন সাহেদ এবং এরপর ঢাকার রাইফেলস পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাশ করেন।
সাহেদের বাবা তেমন কিছুই করতেন না। তবে, তাদের পারিবারিক জমি ছিল। তার মায়ের মৃত্যুর পর জমি বিক্রি করে পাকাপাকিভাবে তার বাবা ঢাকায় চলে আসেন।
Comments