আরও ২ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ, কোন প্রক্রিয়ায়?
করোনা সংকট মোকাবিলায় নতুন করে আরও দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই নিয়োগের চাহিদা জানিয়ে জনপ্রশাসনে চিঠি দিয়েছে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় নিয়োগ হবে সেটি স্পষ্ট না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছেন চিকিৎসকরা। এ নিয়ে এখনো কিছু চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকারি কর্ম-কমিশন (পিএসসি)। সাংবিধানিকভাবে সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানটি বলছে, জনপ্রশাসন থেকে চাহিদাপত্র আসার পরেই কমিশন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এর আগে কিছুই বলা সম্ভব নয়।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় মে মাসেই নতুন করে দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তারা কাজেও যোগ দিয়েছেন। নতুন কোনো পরীক্ষা না নিয়ে ৩৯তম বিশেষ বিসিএসের অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে তাদের নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন বলছে, ৩৯তম বিসিএসের নন ক্যাডারের অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে তারা আর প্রার্থী চান না। এর বদলে নতুন করে বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগ হোক।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আব্দুল মান্নান মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘করোনার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও চিকিৎসক প্রয়োজন। নতুন করে দুই হাজার সহকারী সার্জন নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আমরা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। আমরা চাই দ্রুত তাদের নিয়োগ হোক। তবে আমরা বলেছি ৩৯তম বিশেষ বিসিএসের তলানিনে থাকা নন ক্যাডার থেকে আমরা চিকিৎসক চাই না। নতুন করে নিয়োগ হোক।’
করোনার এই সময়ে কী করে ফের একটি বিসিএস পরীক্ষার নিয়োগ সম্পন্ন করা হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় প্রার্থীরা। কারণ এর আগে স্বাভাবিক সময়ে লিখিত পরীক্ষার বদলে শুধুমাত্র প্রিলিমিনারি ও মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে ডাক্তারদের জন্য ৩৯তম বিশেষ বিসিএস সম্পন্ন করতেও প্রায় দেড় বছর লেগে গিয়েছিল।
৩৯তম বিশেষ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল। গত বছরের ৩০ এপ্রিল চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে চার হাজার ৭৯২ জন চিকিৎসককে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। এরপর নভেম্বর মাসে তাদের মধ্যে থেকে ৪ হাজার ৪৪৩ জনকে স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগ দিয়ে আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে এই বিসিএসে উত্তীর্ণ আরও আট হাজার ৩৬০ জনকে নন ক্যাডারেরে জন্য রাখা হয়। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেখান থেকে ২ হাজার ডাক্তার নিয়োগ করা হয়। আরও ছয় হাজার চিকিৎসক নন ক্যাডারের তালিকায় আছেন।
এই বিসিএসে উত্তীর্ণ অন্তত ৫০ জন প্রার্থী ডেইলি স্টারকে বলছেন, শুধুমাত্র ডাক্তারদের জন্যই ৩৯তম বিশেষ বিসিএস নেওয়া হয়েছিল। কয়েকদিন আগে এই বিসিএসের অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে দুই হাজার ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কাজেই আবার বিশেষ বিসিএস না নিয়ে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকেই ডাক্তারদের নিয়োগ হোক।
অন্যদিকে সদ্য ফল প্রকাশ হওয়া ৩৮তম বিসিএসের নন ক্যাডারের তালিকায় থাকা অর্ধশত ডাক্তাররা বলছেন, ৩৯তম বিশেষ বিসিএস শুধু প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ও ভাইভা দিয়েই সাড়ে ছয় হাজার ডাক্তার স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন। আর ৩৮তম বিসিএসের প্রার্থীরা লিখিত পরীক্ষাসহ দীর্ঘ যাচাইয়ের মধ্যে দিয়ে গেছেন। তারা এখন জ্যেষ্ঠ। কাজেই ৩৮ বিসিএসের নন ক্যাডারের তালিকায় থাকা ডাক্তারদের এখন ৩৯তম বিসিএসের সঙ্গে নেওয়া উচিত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পিএসসিতে তারা এ ব্যাপারে আবেদনও দিয়েছেন।
কোন বিসিএস থেকে নিয়োগ হবে তা নিয়ে ভিন্নতা থাকলেও ৩৮তম ও ৩৯তম দুই বিসিএসের উত্তীর্ণরা বলছেন, একটা বিশেষ বিসিএস নিতে গেলে পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া, আবেদন, পরীক্ষা, ভাইভা এসবে দীর্ঘ সময় চলে যাবে। আর করোনার এই সময়ে কীভাবে পরীক্ষা নেওয়া হবে, কোথায় কেন্দ্র পাওয়া যাবে, হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কীভাবে পরীক্ষা দেবে?
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে ৩৯তম বিশেষ বিসিএসের অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকা একজন প্রার্থী বলেন, ‘এমন যেন না হয় নতুন করে বিশেষ বিসিএস নিতে গিয়ে এক বছরে লেগে গেল। করোনাও শেষ হয়ে গেল। কিন্তু ডাক্তার আর নিয়োগ দেওয়া হলো না।’
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ এপ্রিল দুই হাজার ডাক্তার নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। দ্রুততম সময়ে গেজেট প্রকাশ করার পর ১৩ মে তারা যোগদান করেন। কিন্তু মহামারি পরিস্থিতিতে ৭০ জন চিকিৎসকের মৃত্যু ও হাজার দেড়েক আক্রান্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে চাহিদার কারণে সরকার আরও দুই হাজার ডাক্তার নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
এ সংক্রান্ত নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা প্রদানের জন্য দুই হাজার পদ সৃজনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৬ জুন অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠালে ১০ জুন অর্থ বিভাগ অনুমোদন দেন। বাড়তি চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সারসংক্ষেপ পাঠালে ১৮ জুন প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দেন। ১ জুলাই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাব ও অর্থ কর্মকর্তার অনুমোদনের পর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে নতুন চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে চিঠি পাঠানো হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় করোনা চিকিৎসার পৃথক ইউনিট প্রস্তুত করা হলেও সে তুলনায় চিকিৎসক নেই। সরকার তাই জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা সংযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন ‘কোভিড হাসপাতালে’ পদায়িত হবেন। করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম শেষ হয়ে গেলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ক্যাডার পদে তাদের পদায়ন করা হবে।
তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নতুন করে পরীক্ষা নিয়ে চিকিৎসক নিয়োগ চাইছেন। এর ফলে নতুন পাস করা চিকিৎসকরা পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবেন। যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাবে। তবে নিয়োগের দীর্ঘসূত্রতা লেগে গেলে কী হবে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আব্দুল মান্নান বলেন, ‘এটা তো জরুরি প্রয়োজনের সময়। আমরা চাই না প্রিলিমিনারি বা লিখিত পরীক্ষা নিয়ে সময় নষ্ট হোক। দীর্ঘ সময় যেন না লাগে। নিশ্চয়ই পিএসসি একটা উপায় বের করবে।’
তবে সদ্য ৩৯তম বিসিএস শেষ হওয়ার পর আবার একটি বিশেষ বিসিএসের নিয়োগ কীভাবে সম্পন্ন হবে তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি পিএসসি। জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি জাতীয় সঙ্কট তৈরি করেছে। এর আগে চাহিদা পাওয়ার পর দ্রুততম সময় আমরা নিয়োগের সুপারিশ করার উদ্যোগ নেই। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, আবার পরীক্ষা এগুলো দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমাদের যেহেতু ৩৯তম বিসিএসে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ আট হাজার চিকিৎসকের একটা অপেক্ষমাণ তালিকা ছিল সেখান থেকেই দুই হাজার চিকিৎসককে সুপারিশ করেছিলাম। এখন নতুন করে দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগের প্রক্রিয়া কী হবে এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে চাহিদা এলে কমিশন বৈঠকে বসে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে।’
Comments