দিন শেষে ডাক্তার তুমি কি পেলে?

এমন কি কেউ আছেন যিনি পুরো জীবনে একবারও চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেননি? নিজে, পরিবারের যেকোনো সদস্য, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-স্বজন? মধ্যরাতে কাছের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে কার কাছে ছুটেছেন? হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনায়? শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতীসহ অসুস্থ অবস্থায় যন্ত্রণায় ছটফট করা প্রিয়জনের কষ্ট লাঘবের জন্য কে হয়েছেন সবচেয়ে আপনজন? জরুরি ঝড়, বৃষ্টি, প্রচণ্ড রোদ, যানজট সব উপেক্ষা করে ছুটে যেতে হয়েছে চিকিৎসকের কাছে। রোগীর জীবনের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে একজন ডাক্তার কী মহৎ ভূমিকা পালন করতে পারেন তা ভাষায় বর্ণনাতীত সেটি ভুক্তভোগী মাত্রই উপলব্ধি করতে পারেন।
ছবি: আমরান হোসেন

এমন কি কেউ আছেন যিনি পুরো জীবনে একবারও চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেননি? নিজে, পরিবারের যেকোনো সদস্য, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-স্বজন? মধ্যরাতে কাছের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে কার কাছে ছুটেছেন? হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনায়? শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতীসহ অসুস্থ অবস্থায় যন্ত্রণায় ছটফট করা প্রিয়জনের কষ্ট লাঘবের জন্য কে হয়েছেন সবচেয়ে আপনজন? জরুরি ঝড়, বৃষ্টি, প্রচণ্ড রোদ, যানজট সব উপেক্ষা করে ছুটে যেতে হয়েছে চিকিৎসকের কাছে। রোগীর জীবনের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে একজন ডাক্তার কী মহৎ ভূমিকা পালন করতে পারেন তা ভাষায় বর্ণনাতীত সেটি ভুক্তভোগী মাত্রই উপলব্ধি করতে পারেন।

এই যে এখন মহামারির সময়, সচেতন ব্যক্তি মাত্রই সচেতন হয়ে বাইরে যাচ্ছেন, ঘরে ফিরছেন একরাশ আতঙ্ক নিয়ে, শত সাবধানতা সত্ত্বেও যেকোনো সময় আক্রান্ত হচ্ছেন করোনা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ছাড়াও সাধারণ ফ্লুতে। এছাড়া অন্য রোগবালাই ত রইলই! অসুখ শব্দটি থেকে অ কেটে বাদ দিয়ে সুখ খোঁজার জন্য সেই তো যেতে হয় ডাক্তারের কাছেই। বহুজনের বহু টোটকা, পরামর্শ পেলেও স্বস্তি ও মুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় শুধুই তাদের কথাতেই।

সারা দেশেই যখন করোনা রোগী বেড়েই চলেছে, একের পর হাসপাতাল, ক্লিনিক যখন রোগী ফিরিয়ে দিচ্ছে, তখনও  ডাক্তাররা নিজের প্রাণের মায়া না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আপনাকে-আমাকে সুস্থ করার প্রত্যয়ে। তাদেরই মতো একজন খুলনা শহরে ‘রাইসা ক্লিনিক’ নামের এক বেসরকারি ক্লিনিকের মালিক ডা. রকিব খান। গণমাধ্যমের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৪ জুন নগরের গল্লামারী এলাকার ক্লিনিকটিতে  এক নারীর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করানো হয়। প্রথম দিকে সন্তান ও মায়ের শরীর ভালো থাকলেও রাতে রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। সকালে ওই ক্লিনিকের চিকিৎসক ও পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন স্বজনেরা। পথিমধ্যেই রোগী মারা যান। ১৫ জুন রাতে রোগীর ক্ষুব্ধ স্বজনেরা রাইসা ক্লিনিকের মালিক চিকিৎসক আবদুর রকিব খানকে ব্যাপক মারধর করেন। এক পর্যায়ে মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়। ঘটনার পর কয়েকবার বমি করেন ডাক্তার। পরে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে খুলনার শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রকিব খান।

 এই প্রবীণ ডাক্তার তো এই মহামারির সময়ে সেবা না দিলেও পারতেন। পারতেন রোগী ফিরিয়ে দিতে। আমরা ধরেই নিচ্ছি, উনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন, রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য অন্য প্রায় সব মানবিক ডাক্তারদের মতোই। কিন্তু সব কিছু তো চাইলেই সম্ভব নয়, এই সময়ে চিকিৎসাকাজে প্রয়োজনীয় অনেক যন্ত্রপাতির ঘাটতি, প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকট। কথায় কথায় ডাক্তারদের মারধর, জিম্মি করা, আটকে রাখা এ দেশে আগেও ঘটেছে। কিন্তু সব ঘটনা ছাড়িয়ে গিয়েছে ডা. রকিব খানের মৃত্যু। এর থেকে ন্যাক্কারজনক, লজ্জাকর, ঘৃণিত কাজ হতেই পারে না। মানছি, উনার চিকিৎসায় ভুল হতেই পারে, মানুষ মাত্রেই সেটি হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু তাই বলে হাজার হাজার রোগীকে সুস্থ করে তোলা ডাক্তারকে মাথায় আঘাত করে মেরে ফেলা? এ কেমন বর্বরতা?

ভালো খারাপ ব্যক্তি প্রতিটি পেশাতেই আছেন। এ দেশে যেমন বিনা টাকায় বা নাম মাত্র ফিতে সেবা করা অভিজ্ঞ, মানবিক ও প্রবীণ ডাক্তার আছেন আবার তাদের বিপরীতে গজ ফিতা শরীরে রেখেই অপারেশন শেষ করা, বিনা কারণে নানান ধরনের টেস্টের ফাঁদে ফেলা, অতিরিক্ত ফি, ভুল চিকিৎসা করা অমানবিক ডাক্তারও আছেন।

 কিছু কিছু ব্যবসায়ী মনোভাবাপন্ন ডাক্তারের কারণে সব ডাক্তারকে এক কাতারে ফেলে গালিগালাজ করাটা কতটুকু যৌক্তিক?

চিকিৎসা একটি মহৎ পেশা। যখন যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন তাদের প্রথম কাজই হচ্ছে রোগীর সেবা দেওয়া এবং সেটা করতে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সমাজে চিকিৎসকরা একটি শিক্ষিত ও সম্মানিত পেশাজীবী মহল। তাদের অমানবিকতা অথবা উদাসীনতার কারণে হারিয়ে যেতে পারে অনেক প্রাণ। ডাক্তার না থাকলে রোগীরা যে কত অসহায় সেটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ডাক্তার না থাকলে কারা চিকিৎসা দেবেন রোগীদের? ডাক্তাররা যখন পিপিই পাননি তখন প্রশাসন, ব্যাংকার, ব্যবসায়ীরা পিপিই পরে ফটো সেশন করেছেন। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে প্রায় প্রত্যেকে সেটি দেখেছি। জেনেছি, আক্রান্ত ডাক্তারদের চিকিৎসা না পাওয়া, যে হাসপাতালে ডাক্তার চেম্বার করেন, সেই হাসপাতালেও চিকিৎসা না পাওয়ার ঘটনা। ডাক্তাররা কর্মস্থলে যেতে আসতে বাধার সম্মুখীন হলে, অসম্মানিত হলে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করবেন কী করে ভেবেছি কখনো? রোগীর অনুপাতে ডাক্তারদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হওয়ায় চিকিৎসকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে আর সেটাই স্বাভাবিকভাবে হবারই কথা। সহকর্মীদের মৃত্যুতেও তারা থেকেছেন অটল। রোগ সারাতে গিয়ে ডাক্তার যদি রোগী হয়ে যান তাহলে তো চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে পুরোপুরি। এখনকার পরিস্থিতিতেই ডাক্তাররা দলে দলে অসুস্থ। রোগীরা সেবা কার কাছ থেকে নেবেন? ডাক্তারদেরই বা  এমন অবস্থায় কী করার আছে? তবুও আক্রান্ত ডাক্তারও সুস্থ ডাক্তারদের পাশাপাশি সেবা দিয়ে চলেছেন মুঠোফোনের সাহায্যে, ম্যাসেঞ্জারে, বিভিন্ন অ্যাপসে।

কিন্তু সেই ভরসার, আস্থার, রুগ্ন ব্যক্তির সেবা করে সুস্থ করে তোলা ডাক্তারদের কি ব্যক্তিসাধারণ, রোগী ও রোগীর স্বজনের কাছ থেকে মানবিক আচরণ পাওয়া উচিত নয়? ডাক্তারের পক্ষে কথা বলতে গেলেই যে কথাটি সবচেয়ে বেশি শুনতে হয়, জনগণের টাকায় লেখাপড়া শিখেছে যেহেতু কাজেই তারা সেবা দিতে বাধ্য। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় একবার ভেবে দেখুন, যারাই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন প্রত্যেকেই কি আপনার আমার টাকায় লেখাপড়া করেননি? কিন্তু ডাক্তারি ছাড়া অন্য কোন পেশা কি আছে যেখানে নিজের জীবন বাজি রেখে সেবা দিতেই হয়? প্রশ্নটা প্রত্যেকের কাছে রেখে গেলাম।

চিকিৎসকদের এসব ত্যাগ, কর্ম, সেবা আমরা কিছুটা মনে রাখি। মানবিক হই আমরাও তাদের প্রতি। আমাদের সুস্থ করে তোলার গুরুদায়িত্ব যে শ্রেণির কাঁধে তাদের যেমন ভালো ব্যবহার করা দায়িত্ব, একই দায়িত্ব আমাদেরও। আমরা করোনা পজিটিভ রোগীর তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিয়ে ডাক্তারকে আক্রান্ত করে ফেলে হাজারো রোগীর জীবন বিপন্ন করে তুলছি না? শুধুই ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করতে? রোগের তথ্য গোপন না করা, এক চিকিৎসকের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র অন্য ডাক্তারের কাছে ক্রস চেক না করা, চিকিৎসকের উপর আস্থা রাখা, চিকিৎসা সামগ্রীর অপ্রতুলতাসহ বিভিন্ন কারণে ডাক্তারের অসহায়ত্ব রোগী ও তার স্বজনদের উপলব্ধি করা উচিত আমাদের প্রত্যেকের। ডাক্তারদের পাশে সহমর্মিতার, বন্ধুত্বের হাত বাড়ালে তারা সেটির অমর্যাদা করবেন না সেটি উপলব্ধি করুন। আসুন, আমরা সবাই চিকিৎসকদের পাশে বন্ধু হয়েই থাকি।

তানজিনা আকতারী: সংবাদ পাঠক, বাংলাদেশ বেতার

tanzinaduaa25@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Won’t silence my voice and conscience, ZI Panna says after securing HC bail

The High Court today granted anticipatory bail to eminent Supreme Court lawyer and human rights activist ZI Khan Panna till submission of the probe report by police over an attempted murder case

1h ago