দাও ফিরে সে অরণ্য
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রথাগত, ঐতিহ্যগত, পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক স্বতন্ত্র অঞ্চল। দীর্ঘ যুগ ধরে পার্বত্য বনে বসবাস করা পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে বনের সম্পর্ক শুধু ঘনিষ্ঠ নয়, পারস্পরিক ও আধ্যাত্মিকও বটে।
বন ও বন পরিবেশের চারপাশকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে জুম্মদের জীবন ও সংস্কৃতি। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা জুম্ম জাতিরাই নিজেদের বনের সন্তান বলে দাবি করতে পারেন। তাদের কাছে সভ্যতা মানে হলো— ভূমি, প্রকৃতি আর পরিবেশের এক নিদারুণ সম্পৃক্ততা। তবে, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত উন্নয়নের নামে বন ও বনের সন্তানদের ওপর বারবার আঘাত করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের বান্দরবান চ্যাপ্টার প্রধান জুয়ামলিয়ান আমলাই বলেন, ‘ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের যুগ থেকেই বন সংরক্ষণের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ভূমি ও বনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’
‘ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় এক চতুর্থাংশ “সংরক্ষিত বন” হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ফলে সেখানে বসবাসরত অনেকেই তাদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিলেন। আজও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক’, বলেন জুয়ামলিয়ান।
তিনি বলেন, ‘১৯৯৯ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমি ব্যাপকভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, এই সময়টাতে মোট বনের প্রায় ৭০ ভাগ শেষ করে দেওয়া হয়েছিল।’ বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড়ের ভূমিধসের অন্যতম প্রধান কারণ— নির্বিচারে গাছ ও পাহাড় কাটা।’
২০১৮ সালে ভূমিধসে রাঙ্গামাটিতে ১১ জন ও বান্দরবানে সাত জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিল। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে পাহাড়ধসের ঘটনায় রাঙ্গামাটিতেই মারা গিয়েছিলেন ১২০ জন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বিচারে বন উজাড়, পাথর উত্তোলন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও আইন রয়েছে, তবে প্রভাবশালী ব্যক্তি, বন বিভাগের ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশের সহায়তায় প্রতিদিন পরিবেশের এই নিষ্ঠুর ধ্বংসযজ্ঞ চলছে।
ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে আমাদের ভবিষ্যৎ অবিচ্ছিন্নভাবে বনের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। বন যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়, তা টেকসই শতাব্দী উপলব্ধি করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ২০১৬ সালে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১১ দশমিক ২ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। যেখানে ৯২ দশমিক ১ শতাংশ বনভূমি নিয়ে লাওস এশিয়ার শীর্ষে রয়েছে।
বর্তমানে দেশের বনভূমি ১০ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আতিকুর রহমান।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অধিক তীব্রতা-বিশিষ্ট বৃষ্টিপাত ও ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি বলে মনে করছেন এই বিশেষজ্ঞ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমি মূলত চিরহরিৎ প্রকৃতির, যা বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন ড. মো. আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ব্যাপকভাবে বন উজাড় পাহাড়ধসের অন্যতম কারণ। আর বন হলো— জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য “প্রাকৃতিক কার্বন স্টোরেজ সিস্টেম”।’
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাল্পউড, রাবার ও তামাক চাষের কারণে সেখানে বসবাসরত পাহাড়ি সম্প্রদায়ের অনেকেই তাদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন। তামাক চাষ, রাবার বাগান ও জনসাধারণের বনভূমিতে তথাকথিত সামাজিক বনায়ন প্রকল্প পার্বত্য চট্টগ্রামের জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন ড. আতিকুর।
তিনি বলেন, ‘পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা বরাবরেই প্রকৃতির একটা অংশ হিসেবে সেখানে ছিলেন। কিন্তু, পরবর্তীতে সমতল ভূমি থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় যাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হলো, তারাই মূলত সভ্যতার নামে প্রকৃতিকে শাসন-শোষণ করল।’
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি অনুসারে, ১ দশমিক ৬ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ তাদের জীবিকার জন্য বনের ওপর নির্ভর করে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, ‘ষাটের দশকে শুরুর দিকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রায় এক লাখ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিলেন। এই বাঁধের ফলে সেখানকার জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছিল। বন্যপ্রাণী ও তাদের বসবাস-উপযোগী আবাসস্থল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।’
এই বাঁধ পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশের জন্য ধ্বংসযজ্ঞ ছিল বলে মনে করেন গৌতম দেওয়ান।
আমরা দেখেছি, পরিবেশ ধ্বংস না করার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে বারবার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্যি, স্থানীয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সেই নির্দেশ পালনে বরাবরেই উদাসীন ছিল এবং এখনো আছে। ইতোমধ্যে, পাহাড়ের অসংখ্য ঝিরি, ঝরনা শুকিয়ে গেছে। তীব্র পানি সংকটের কারণে অনেক পাহাড়ি জনগোষ্ঠী তাদের পাড়া ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
ড. আতিকুর রহমানের মতে, ব্যাপকভাবে বন উজাড়, পাথর উত্তোলন ও তামাক চাষের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে পানির উৎসগুলো মারাত্মকভাবে ধ্বংস হচ্ছে। যার ফলে সংকট আরও তীব্র হচ্ছে।
তাৎক্ষণিক লাভের আশায় অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো নেওয়া হয়েছিল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলো সেখানকার জনজীবন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে দিয়েছে। পাহাড়ে উন্নয়নের নামে প্রকৃতির ওপর নিষ্ঠুর এই ধ্বংসযজ্ঞ এখনই থামানো উচিত। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার আগামীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো নেবে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই সেখানকার জুম্ম জনগোষ্ঠী, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে নিরাপদ রেখেই অতীতের ভুল শোধরাবে।
‘সভ্যতার প্রতি’ আহ্বান জানিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুরে আমাদেরও আবেদন—
‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর,
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি’
Comments