তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া

ব্যক্তিগত গাড়ি ও ধনী-গরিবের ঈদ

আজ শুক্রবার সকাল থেকেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ও পাটুরিয়া ঘাটে ছিল ঘরমুখী মানুষের ভিড়। ছবি: স্টার

ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি বা মাইক্রোবাস নিয়ে গ্রামে ঈদ করতে যেতে পারবেন। গাড়ি বা মাইক্রোবাস না থাকলে যেতে পারবেন না। এ ঘোষণা দিয়েছেন র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যে কেউ গ্রামের বাড়িতে যেতে পারবেন। গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সম্ভব না। জনকল্যাণের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবো। যদি ব্যক্তিগত গাড়িতে কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভ্রমণ করেন, তাহলে তিনি পরিবারের সঙ্গেই থাকছেন।’

এই ঘোষণা ও যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু প্রসঙ্গ মাথায় ঘুরছে।

১. গাড়ির ভেতরে পরিবারের সদস্যরা থাকবেন, করোনা সংক্রমণের ভয় নেই— বুঝলাম। গত মাস দুয়েক ব্যক্তিগত গাড়ি প্রায় চলছে না বললেই চলে। চালকরা নিজেদের বাসায় অবস্থান করছিলেন। এখন সেই চালক গাড়ি চালিয়ে মালিক পরিবারকে গ্রামে নিয়ে যাবেন। এদেশে এখন বহুল আলোচিত শব্দ ‘স্বাস্থ্যবিধি’। চালকেরা কোন পরিবেশে থাকেন, সেখানে ‘স্বাস্থ্যবিধি‘ শব্দটির আদৌ যে কোনো উপস্থিতি নেই— তা কমবেশি সবাই জানি। গাড়ির মালিক বা চালক কারোরই করোনা পরীক্ষা হয়নি।

২. গাড়ি নিয়ে যারা যাবেন, তারা কি গাড়িতেই থাকবেন? পথে কোথাও থামবেন না? ফেরিঘাটে বা ফেরিতে নামতে হবে না? গ্রামের বাড়ি গিয়ে কোথায় থাকবেন? ‘স্বাস্থ্যবিধি‘ মেনে আলাদা ঘরে? ব্যবহার করবেন আলাদা আলাদা বাথরুম? এতে একেকজন মানুষের গ্রামের বাড়িতে কতগুলো ঘর ও বাথরুম থাকতে হবে? আমাদের কি একেবারেই কোনো ধারণা নেই? এখন না হয় আমরা শহুরে নাগরিক হয়েছি বা হওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু, এসেছি তো গ্রাম থেকেই। এই যে শহর থেকে যারা গ্রামে যাবেন, তারা করোনাভাইরাস সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন— না নিয়ে আসবেন, তা কি আমরা জানি? কেউ জানেন?

৩. আজ সকালে এই ঘোষণার পর থেকে ছোট গাড়ি ও মাইক্রোবাস ভাড়া করে গ্রামে যাওয়া শুরু হয়েছে। চালকসহ পাঁচ আসনের গাড়িতে ছয়-সাত জন, আটজনের গাড়িতে ১০-১২ জন, ১৪ আসনের গাড়িতে ১৮-১৯ জন যাচ্ছেন। ধারণা করা যায় আগামী কয়েকদিন এ ধারা অব্যাহত থাকবে। দুর্ঘটনার বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় কখনও থাকে না, এবারও নিশ্চয়ই নেই। তা ছাড়া, ‘স্বাস্থ্যবিধি‘ জিনিসটার অবস্থা কী হচ্ছে আর কী হওয়ার সম্ভাবনা আছে? কে কার পরিবারের সদস্য, কে বা কারা তা নিশ্চিত করবেন? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী? সম্ভব? সেই সামর্থ্য আমাদের আছে?

৪. এমন আরও বহু প্রশ্ন তোলার সুযোগ আছে। সেদিকে না যাই। দুই কোটিরও বেশি মানুষের এই নগরে পাঁচ লাখের মতো ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি ও মাইক্রোবাস আছে। তার মানে নগরের মোট জনসংখ্যার খুব ক্ষুদ্র অংশের গাড়ি আছে। এই ক্ষুদ্র অংশ যারা তুলনামূলক বিচারে বিত্তবান, তারা গ্রামে যেতে পারবেন। যাদের প্রায় সবাই পরিবার নিয়ে ঢাকায় একসঙ্গে থাকেন। আর নগরের মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ যারা ঢাকায় একা থাকেন। স্ত্রী-সন্তান থাকেন গ্রামে। ঈদে যেকোনো উপায়ে তারা গ্রামে চলে যান। তারা এবার যেতে পারছেন না। এ কথা বলছি না বা বলার কোনো সুযোগ নেই যে, তাদের গ্রামে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক। অবশ্যই করোনা মহামারিকালে তাদের গ্রামে যেতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু, বিত্তবান-গাড়িওয়ালাদের যেতে দিবেন কেন? একটি রাষ্ট্রের নীতি ধনী-গরিব ভেদে এতটা বৈষম্যমূলক হবে কেন?

যে মানুষটির হৃদয়ে আজ হাহাকার, একটি গাড়ি নেই বলে আমি গ্রামে যেতে পারলাম না! দেশটা তো তাদেরও। এমন একটি সিদ্ধান্তের আগে, তাদের কথা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি ছিল না? 

ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, ট্রাক কোনো পরিবহনেই বাংলাদেশের বাস্তবতায় ‘স্বাস্থ্যবিধি‘ মেনে যাতায়াত করা সম্ভব নয়। দৃশ্যমানভাবে হয়তো একটু কমবেশি পরিলক্ষিত হতে পারে, এ ছাড়া আর কিছু নয়।

৫. করোনা মহামারি মোকাবিলায় দূরদর্শী সিদ্ধান্ত এখনো অনুপস্থিত। পোশাক কারখানা বন্ধ-খোলা বিষয়ক সিদ্ধান্তহীনতার মতো, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে গ্রামে যাওয়া যাবে, আরও একটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত। যা হতে পারে ভয়ঙ্কর বিপদের কারণ, করোনাভাইরাস সংক্রমণের সহায়ক।

আমরা সবকিছু সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দায় এড়ানো সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। এত মানুষ কেন গ্রামে যায়, এক গাড়িতে কেন এতজন গেল, কেন স্বাস্থ্যবিধি মানল না— এসব দায় সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো খুব সহজ। এর অনেক কিছু হয়তো সত্যিও। কিন্তু, রাষ্ট্র ধনী আর গরিবের জন্যে আলাদা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যে সিদ্ধান্ত বৈষম্য তৈরি করে, যে সিদ্ধান্তে অধিকসংখ্যক মানুষ আঘাত পান-বেদনাহত হন, সেই সিদ্ধান্ত কী করে ‘জনকল্যাণে’ নেওয়া হয়? এ কেমন ‘জনকল্যাণ’? একটি ঈদে গরিবের মতো বিত্তবানদেরও গ্রামে যেতে না দিলে কোনো ক্ষতি ছিল না।

s.mortoza@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English
caretaker government proposal Bangladesh

Restoration of caretaker system to be proposed

The restoration of the caretaker government and the introduction of a bicameral system in parliament will be among the recommendations to be proposed by the Constitution Reform Commission.

7h ago