করোনা পরীক্ষায় কতটুকু নির্ভুল আরটি-পিসিআর?

প্রতীকি ছবি। আরটি-পিসিআর মেশিন। ছবি: সংগৃহীত

মানব সভ্যতার চরম উৎকর্ষের এ যুগে করোনা মহামারির আগমন যেন এক দমকা হাওয়ার মতো। হঠাৎ করেই যেন এক একটা জায়গায় হামলে পড়ছে আর সমাজ-সংসারের সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। বিশ্বময় থমকে দাঁড়িয়েছে সব ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এ এক হতবিহ্বল অবস্থা। কেউই বুঝে উঠতে পারছে না কোথায় এর শেষ। কখন ফের ফিরে আসবে সভ্যতার প্রাণস্পন্দন।

শত্রু যখন দৃশ্যমান, সে যত শক্তিশালীই হোক, আপনি আপনার পরিকল্পনার ছক আঁটতে পারেন। চিন্তা করতে পারেন আগাবেন না পেছাবেন। কিন্তু, এই রহস্যময় অদৃশ্য দানব আপনাকে সর্বক্ষণ ধেয়ে বেড়াচ্ছে। এ যেন কোথাও নেই, অথচ সবখানেই আছে। আপনার ভাই, বন্ধু, পড়শি, সহকর্মী বা নিছক চলার পথের ক্ষণিকের সহযাত্রী কাউকেই আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। সবাইকেই সন্দেহের তালিকায় রাখতে হচ্ছে। আপনি জানেন না, কে বয়ে বেড়াচ্ছে এ মরণ জীব আর কখন কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে ছড়িয়ে দেবে আপনার শরীরে।

ভীষণ ছোঁয়াচে এ রোগের জন্য তাই আপাত পরিকল্পনা হচ্ছে- জনসমাগম পরিহার করুন, অন্যের কাছ থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলুন, করোনা বহন করছে এমন প্রতিটি ব্যক্তিকে খুঁজে বের করুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষায়, ‘পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষা’- এটাই এই মুহূর্তে করোনা মোকাবিলার দাওয়াই। কারণ, কেবল এভাবেই ব্যাপক পরিসরে রোগটির ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যেতে পারে। এই পরিকল্পনার আলোকে দক্ষিণ কোরিয়ার মত কিছু দেশ সংক্রমণ দেখা দেওয়ার শুরুতেই আগ্রাসীভাবে ব্যাপক হারে পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় এবং এর ফলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ভালো সাফল্য অর্জন করে। অন্যদিকে ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মত দেশগুলো শনাক্তকরণ কার্যক্রম ঢিলে ভাবে শুরু করায় রোগটি সমাজে ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায় এবং পরবর্তীতে শনাক্তকরণের হার বিপুলভাবে বাড়িয়েও রোগটির সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরা কঠিন হয়ে পড়ে।

দ্রুত শনাক্তকরণের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা করোনা শনাক্তকরণের সহজ, সাশ্রয়ী ও কার্যকর টেস্ট কিট উদ্ভাবনের জন্য ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শনাক্তকরণের জন্য অনুসৃত পরীক্ষা পদ্ধতিগুলোকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমার্স চেইন রিয়েকশন (আরটি-পিসিআর) এবং অপরটি সিরোলজিক্যাল অর এন্টিজেন-এন্টিবডি বেইজড টেস্ট। প্রথম পদ্ধতিতে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে সংগৃহীত নমুনায় করোনাভাইরাসের রিবোনিউক্লিক এসিড (আরএনএ) আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে দেখা হয় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো এন্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা। কেউ যখন একটি জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হন, তখন স্বাভাবিক শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা এর বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করে। এটাই এই পরীক্ষা পদ্ধতির ভিত্তি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২০ সালের ২ মার্চ অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনায় করোনা সংক্রমণের রুটিন ডায়াগনোসিসে নিউক্লিক এসিড এমপ্লিফিকেশন টেস্ট (এনএএটি) ব্যবহারের পরামর্শ দেয় এবং উদাহরণ হিসেবে আরটি-পিসিআরের কথা উল্লেখ করে। এখন পর্যন্ত এটিই সারা বিশ্বে করোনা শনাক্তকরণে বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি। তাহলে, আসুন, পদ্ধতিটি কিভাবে কাজ করে তার উপর সংক্ষেপে একবার চোখ বুলিয়ে নেই।

এ পদ্ধতিতে রোগীর নাসারন্ধ্রের পেছন (nasopharynx) থেকে মিউকাস (nasopharyngeal swab) সংগ্রহ করে নমুনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে, বিকল্প হিসেবে কখনও মুখবিবরের পেছন থেকেও নমুনা (oropharyneal swab) নেওয়া হয়ে থাকে। পরীক্ষাগারে প্রথমে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সংগৃহীত নমুনা থেকে ভাইরাসটির আরএনএ পৃথক করে ফেলা হয়।  আরটি-পিসিআর পৃথক করা আরএনএকে রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়ায়  ডিএনএতে রূপান্তরিত করে। এরপর ডিএনএর অংশ বিশেষকে পলিমার্স চেইন রিয়েকশনের সাহায্যে বহুগুণে বর্ধিত (amplify) করে এর মাত্রা এমন একটি পর্যায়ে উন্নীত করে যা মেশিন শনাক্ত করতে সক্ষম। রোগীর কাছ থেকে সংগৃহীত নমুনায় যদি করোনাভাইরাস থাকে তাহলে এই বিক্রিয়া সংঘটিত হয় এবং পজিটিভ সংকেত পাওয়া যায়। অন্যথায় এসবের কিছুই ঘটে না এবং কোনো সংকেতও পাওয়া যায় না।

করোনা শনাক্তকরণে আরটি-পিসিআর পদ্ধতিটি গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ পদ্ধতির উপর এই যে সবিশেষ আস্থা ও নির্ভরতা তার ভিত্তি কি এবং তা কতটুকু প্রণিধানযোগ্য? গণমাধ্যমে আপনি এমন অনেক রিপোর্ট দেখে থাকবেন, একই ব্যক্তি একবার নেগেটিভ, আবার পজিটিভ হচ্ছেন। তবে, এমনটি কেবল যে আমাদের দেশেই হচ্ছে তা নয়। সারা বিশ্বেই চিকিৎসকদের জন্য করোনা পরীক্ষার ফলাফলে এ ধরণের বিভ্রাট একটি জটিল সমস্যা রূপে আবির্ভূত হয়েছে। স্বয়ং চীনা ডা. লি ওয়েনলিয়াং, যিনি সর্বপ্রথম বিশ্বকে এ রোগটির বিষয়ে জানান দেন এবং নিজেও আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তিনি শনাক্ত হওয়ার পূর্বে বেশ কয়েক বার তার করোনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসে। জাপানিজ জার্নাল অব রেডিওলোজীর ২০২০ সারের মে মাসের সংখ্যায় প্রকাশিত এক কেস স্টাডিতে দেখা যায়, ৩৪ বছর বয়সি এক ব্যক্তি আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ প্রমাণিত হওয়ার আগে পর পর চার বার তার ফলাফল নেগেটিভ আসে। আসলে যে কোনো পরীক্ষার ক্ষেত্রেই ফলাফলে অল্প-বিস্তর বিভ্রাট ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কোনো পরীক্ষার কার্যকারিতা বিচারে দুটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। একটি নির্দিষ্টতা এবং অপরটি সংবেদনশীলতা।

দেখা যাক, করোনা শনাক্তকরণে আরটি-পিসিআর এ দুটি মানদণ্ডে কতটুকু উত্তীর্ণ। নির্দিষ্টতা বলতে বুঝায়, পরীক্ষাটি কতটুকু সুনির্দিষ্টভাবে ঐ রোগটি নির্দেশ করতে সক্ষম। আলোচ্য ক্ষেত্রে এর অর্থ দাঁড়ায় সমগোত্রীয় অন্য কোনো ভাইরাসের সংক্রমণকে ভুলক্রমে কোভিড-১৯ হিসেবে নির্দেশ করার সম্ভাবনা কতটুকু। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় এটাকে বলা হয় ‘ফলস পজিটিভ’। এই মানদণ্ডে করোনা শনাক্তকরণে আরটি-পিসিআর পদ্ধতির সক্ষমতা প্রায় শতভাগ। অর্থাৎ পরীক্ষায় কোনো রোগী যদি পজিটিভ প্রমাণিত হন, তাহলে আপনি শতভাগ নিশ্চিত থাকতে পারেন যে তার করোনা হয়েছে। এটা ‘ফলস পজিটিভ’ হওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. হারলান এম ক্রোমহোলজের ভাষায়, ‘আনন্দের বিষয়, এই পরীক্ষাগুলো খুবই সুনির্দিষ্ট। পরীক্ষায় আপনার রেজাল্ট যদি পজিটিভ আসে, এটা প্রায় নিশ্চিত যে আপনার সংক্রমণ হয়েছে।’ (দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ১ এপ্রিল ২০২০)

করোনা শনাক্তকরণে আরটি-পিসিআর পরীক্ষা নিয়ে যে উন্মাদনা তার ভিত্তিমূল এখানেই। পরীক্ষায় কেবল তখনই ‘ফলস পজিটিভ’ আসতে পারে, যদি ভুলক্রমে কোনোভাবে অসংক্রমিত ব্যক্তির নমুনার সঙ্গে সংক্রমিত ব্যক্তির নমুনা মিশে যায়।

সংবেদনশীলতা বলতে বুঝায়, একটি নমুনায় যদি আসলেই ভাইরাস থাকে, তাহলে তা নির্ণয়ে এ পরীক্ষার সামর্থ্য কতটুকু। অন্যভাবে বলা চলে, নমুনায় ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয়ে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা কত শতাংশ। এ ধরণের ভুল ফলাফলকে ‘ফলস নেগেটিভ’ রূপে অভিহিত করা হয়। এই মানদণ্ডে  আরটি-পিসিআর পরীক্ষা ততটা উত্তীর্ণ নয়। এ যাবত বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় ১৫-৩০ শতাংশ ‘ফলস নেগেটিভ’ রিপোর্ট দিতে পারে। সুতরাং, আপনি পরীক্ষায় নেগেটিভ প্রমাণিত হলেই আপনার করোনা সংক্রমণ হয়নি এমনটি নিশ্চিত রূপে ধরে নেওয়ার সুযোগ নাই। করোনা সনাক্তকরণে এ ধরণের ‘ফলস নেগেটিভ’ মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। একদিকে এর ফলে সংক্রমিত ব্যক্তি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন, অপরদিকে তিনি নিজেকে সংক্রমণমুক্ত জেনে অন্যদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশে তাদেরও সংক্রমিত করতে পারেন। এখন এ ধরণের ‘ফলস নেগেটিভ’ আসাটা যদি একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে করণীয় কি? যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের কনজেনিয়াল হেলথ নামক সংস্থার প্রধান ডা. অ্যালাইন চাউই দ্য বোস্টন গ্লোবকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার অনেক রোগী, যাদের লক্ষণাদি দেখে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত বলে মনে হয়, পরীক্ষায় তাদের নেগেটিভ আসছে।’ এ কারণে তার যেসব রোগী পরীক্ষায় নেগেটিভ প্রমাণিত হচ্ছেন, তিনি তাদের সবাইকে, পরীক্ষার ফল যাই হোক, নিজেদের পজিটিভ বিবেচনা করার এবং অন্তত ৭২ ঘণ্টা উপসর্গমুক্ত না থাকলে কোয়ারেন্টিনে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। ডা. ক্রোমহোলজও নিউইয়র্ক টাইমসে একই রকম মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান সময়ের জন্য আমাদের মনে করতে হবে, যে কেউই ভাইরাসটি বহন করতে পারেন। যদি আপনি ভাইরাসটির সংস্পর্শে এসেছেন বলে মনে হয় এবং আপনার লক্ষণাদি কোভিড-১৯ সংক্রমণের সম্ভাবনা নির্দেশ করে, তাহলে ধরে নিন আপনি সংক্রমিত হয়েছেন। এমনকি আপনার পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এসে থাকলেও।’ ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস মেমোরিয়াল মেডিকেল সেন্টার ইন উরচেস্টারের রোগত্বত্ত্ববিদ ডা. রিচার্ড এলিসন দ্য বোস্টন গ্লোবালকে বলেন, ‘“ফলস পজিটিভ” কমিয়ে আনার জন্য যেসব রোগী নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণাদি থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষায় নেগেটিভ ফল দিচ্ছেন, হাসপাতাল তাদের পুনরায় পরীক্ষা করছে।’ অর্থাৎ এ ধরণের পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের জন্য একটি উপায় হলো পুনরায় পরীক্ষা করা। তবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাক্তাররা ফুসফুসে সংক্রমণের কেমন চিহ্ন দেখা যায় তা পরীক্ষার জন্য বুকের এক্স-রে বা সিটি স্ক্যানের সাহায্য নিচ্ছেন।

প্রশ্ন আসতে পারে, সংবেদনশীলতার বিচারে আরটি-পিসিআরের যে সীমাবদ্ধতা তার অন্তর্নিহিত কারণ কি? এটা কি মেশিন বা পরীক্ষা পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা, নাকি ব্যবহৃত নমুনার ত্রুটির ফল? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরীক্ষায় ব্যবহৃত রিএজেন্টসমুহ যদি ত্রুটিমুক্ত হয় এবং পরীক্ষাটি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে এ পদ্ধতিতে সংবেদনশীলতার প্রশ্নেও শতভাগ সাফল্য আসার কথা। ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-মেডিসিনের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ইউডাব্লিউ হেলথ এর চিফ কোয়ালিটি অফিসার ডা. জেফ পোটহফ বলেন, ‘এটা আসলেই খুব ভালো একটি পরীক্ষা। এতটাই ভালো যে নমুনা থেকে আমরা যদি একটি আরএনএও পাই তাহলেও ফলাফল আসতে পারে।’ (স্লেট ম্যাগাজিন, ৬ এপ্রিল ২০২০)

সুতরাং, সমস্যাটা আসলে ল্যাবে নয়। ল্যাবে পরীক্ষার জন্য যে নমুনা পাঠানো হচ্ছে তাতে। নমুনায় যদি ভাইরাসই না থাকে, পিসিআর শনাক্ত করবে কি?

নমুনা যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে এ ত্রুটি হতে পারে নমুনা সংগ্রহ, পরিবহন, সংরক্ষণ কিংবা প্রসেসিং যেকোনো পর্যায়েই। বিশেষজ্ঞরা বিশেষভাবে নমুনা সংগ্রহের প্রতিই অংশই নির্দেশ করেছেন। এখানে একটি দিক হল, আপনি সংক্রমণের কোন পর্যায়ে রোগীর কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করছেন। দেখা গেছে, অনেক রোগীর কাশি ও জ্বরের মত সুস্পষ্ট উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও প্রথমে পরীক্ষায় নেগেটিভ ফল দিচ্ছে। পরবর্তীতে পুনঃপরীক্ষায় পজিটিভ প্রমাণিত হচ্ছেন। হতে পারে, প্রথমবার নমুনা সংগ্রহের সময় আপনার সংক্রমণ খুব প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল এবং এ কারণে আপনার পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এসেছে। আসলে কোভিড-১৯-এর সুপ্তকাল বেশ দীর্ঘ এবং একটি নতুন রোগ হওয়ায় সংক্রমণের ঠিক কোন পর্যায়ে একজন রোগীর পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসার সম্ভাবনা বেশি সে বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য নেই। তবে, এ বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার, লস অ্যাঞ্জেলেসের প্যাথলজি এন্ড ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ওমাই গার্নার একটি পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত যেসব রোগীর তিন থেকে পাঁচ দিন ধরে উপসর্গ (বিশেষ করে জ্বর ও কাশি) রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে পরীক্ষাটি সবচেয়ে কার্যকর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। যাদের কোনো উপসর্গ নেই তাদের ক্ষেত্রে পরীক্ষাটি কতটা ভালো কাজ করবে কিংবা যারা এরই মধ্যে সেরে উঠতে শুরু করেছেন তাদের ক্ষেত্রে এটির উপর কতটুকু নির্ভর করা যায়, তা বলা মুশকিল। (স্লেট ম্যাগাজিন, ৬ এপ্রিল ২০২০)

নমুনা সংগ্রহের প্রশ্নে আরেকটি এবং সম্ভবত অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দিক হল কতটা দক্ষতা ও সতর্কতার সঙ্গে রোগীর কাছ থেকে নমুনাটি সংগ্রহ করা হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহের জন্য একটি সরু ও নমনীয় কাঠির মত জিনিস, যার আগায় তুলোর মত করে নাইলন বা ফোম জড়ানো থাকে, নাসারন্ধ্রের  অনেক পেছনে ঢুকাতে হয়। এটা কোনো সহজ কাজ না। এমনকি একজন প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর জন্যেও এটা বেশ কঠিন। এছাড়া নমুনা সংগ্রহকালে রোগী ব্যথা পেয়ে এদিক ওদিক নড়াচড়া করতে পারেন। দক্ষ জনবলের স্বল্পতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরণের কাজের জন্য যথার্থ প্রশিক্ষণ নেই এমন মানুষ দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় সংগৃহীত নমুনায় যদি ভাইরাসটি উঠে না আসে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু আছে কি? ল্যাবে যখন এরকম একটি নমুনা পরীক্ষার জন্য আসে, যাতে আসলে ভাইরাসই নেই, তখন আরটি-পিসিআর মেশিন যতটুকুই সংবেদনশীল হোক না কেন, তাতে কিবা আসে যায়?

প্রিয় পাঠকগণ! উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে করোনা শনাক্তকরণে পরিচালিত পরীক্ষাসমূহের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ধারণে সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে নমুনা সংগ্রহের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, একটি সফল পরীক্ষার সাফল্যের শুরুটা হয় নমুনা সংগ্রহ থেকেই। নমুনা যদি সঠিকভাবে সংগৃহীত না হয়, তাহলে নমুনা সংগ্রহ থেকে পরীক্ষা পর্যন্ত পুরো আয়োজনটাই পণ্ডশ্রমে পর্যবসিত হয়। এতে করে বহু সংক্রমিত মানুষ পরীক্ষায় ভুলক্রমে সংক্রমণমুক্ত বলে চিহ্নিত হন এবং সমাজে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে থাকেন। কাজেই, শুধু পরীক্ষার আওতা বাড়ানো যথেষ্ট নয়, নমুনা সংগ্রহ কার্যক্রম যাতে সঠিকভাবে পরিচালিত হয় তার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ দেওয়াও জরুরি। গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, এ মুহূর্তে দেশে বিপুল সংখ্যক মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এ কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন। তাদের কিভাবে জরুরি ভিত্তিতে কাজে লাগানো যায় তা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার দাবি রাখে।

লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

4h ago