যে উৎসবের সঙ্গে মানুষের যোগ নেই, তা শুধুই উদযাপন
আমার বন্ধুর পরিবারের অন্যতম শক্তিশালী সদস্য জেসমিন। তার বয়স হবে সম্ভবত ৪৭/৪৮ বছর। তিনি বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। সেই ছোটবেলা থেকেই জেসমিন আমার বন্ধুর মায়ের সংসারে ছিলেন। কারণ, প্রতিবন্ধী বলে গ্রামে পরিবারে তার স্থান হয়নি। মাঝে টাকা-পয়সা খরচ করে জেসমিনের ভাইদের পছন্দমতো ছেলের সঙ্গে তার বিয়েও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, বছর না ঘুরতেই সেই সংসার ভেঙে যায়। অগত্যা আবার আশ্রয় হয় আমার বন্ধুর পরিবারেই।
এই পরিবারে জেসমিন সুন্দরভাবেই আছেন। বহু বছর ধরে থাকার সুবাদে এই পরিবারের বন্ধুদের সঙ্গেও তার খুব ভালো পরিচয়। জেমমিন সবার কথা বোঝে এবং আমরাও তার কথা বুঝি। জেসমিনের রান্নার হাত অসাধারণ। রান্না খেয়ে প্রশংসা করলে তিনি দারুণ খুশি হয়ে আমাদের জড়িয়ে ধরেন।
সেদিন হঠাৎ জেসমিন আমার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা এত যে অসুখ চারিদিকে, এরমধ্যে ‘রচ্চা’ কেমন আছে? জেসমিন আমাকে ‘রচ্চা’ নামে ডাকে। তিনি বলেছেন, ‘রচ্চাকে সাবধানে থাকতে বলবা। কারণ, রচ্চার বড় অসুখ হইছিল এর আগে।’ এই জেসমিনকে আমি গত বছর কোনো কারণ ছাড়াই একটা সাধারণ শাড়ি দেওয়াতে কমপক্ষে ১০ বার আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন।
এরপর জেসমিন আমার বন্ধুকে বোঝালো— আচ্ছা এই যে তুমি এখন অসুখের কারণে এতদিন অফিস যাওনা, আবার ভাইকেও দেখিনা বাইরে যেতে, তাহলে তোমাদের টাকা-পয়সা আসবে কেমন করে? আমার বন্ধু বললো, তাতো টাকা-পয়সার একটু সমস্যা হচ্ছে। সেটা শুনে জেসমিন খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি বললেন, ‘শোন তাহলে এবার আর আমাকে ঈদে শাড়ি দিতে হবে না। এই টাকাটা রেখে দাও। এই সময়ে তোমাকে কেনাকাটা করতে বাইরেও যেতে হবে না। আমার আরেকটা নতুন শাড়ি আছে, আমি সেটাই পরবো।’
জেসমিন আমাকে হতভম্ব করে দিলো। চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই পানি গড়িয়ে পড়ল। একজন মানুষ, যাকে আমরা বলি প্রতিবন্ধী, যে নিজের পরিবারে জায়গা পায়নি, যে কিছু বুঝে না বলেও আমরা জ্ঞানী মানুষেরা মনে করি, সেই জেসমিনই এই দুঃসময়ে আমার শরীরের কথা ভেবেছে। আমাকে সাবধানে থাকতে বলেছে।
সবচেয়ে বড় কথা জেসমিন তার বড় প্রাপ্তি ঈদের কাপড়, সেটাও ছেড়ে দিতে চেয়েছেন শুধু আমার বন্ধুর পরিবারের টাকা বাঁচাবে বলে। এই ক্রান্তিকালে ওদের সংসার কীভাবে চলছে, সেটা নিয়েও ভেবেছেন। এরপরেও কি আমরা মনে করবো জেমমিনের মতো মানুষেরা প্রতিবন্ধী, আর আমরা যারা এই মহামারি মাথায় করে, মানুষের দারিদ্র্যকে অগ্রাহ্য করে কেনাকাটা করছি, তারাই সুস্থ?
জেসমিনের কথা এখানে তুলে ধরার কারণ একটাই। একজন প্রতিবন্ধী ও অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষ যদি বুঝতে পারেন যে মহামারির এই সময়টায় ঈদের কেনাকাটা করাটা খুব অনুচিত একটা কাজ হবে, তাহলে আমরা কেন বুঝতে পারছি না? কেন আমরা মার্কেট খোলা মাত্র দৌঁড়ে চলে যাচ্ছি কেনাকাটা করতে? ছবি ও নিউজ দেখে মনে হচ্ছে, মানুষের ভেতরে একটা ধারণা হয়েছে শুধু মাস্ক পরে থাকলেই আর কিছু লাগবেনা, তারা নিরাপদ হয়ে গেলেন। এই মাস্কই তাকে করোনার ভয়াল থাবা থেকে বাঁচাতে পারবে। তাই তারা প্রত্যেকেই একটি করে মাস্ক পরে মার্কেটে সমবেত হচ্ছেন।
কেনাকাটা এত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে বগুড়া ও টাঙ্গাইলে মার্কেটে ভিড় সামলাতে না পেরে প্রশাসন মার্কেট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। এদিকে ঢাকায় বড় বড় মার্কেটগুলো খুলেনি ঠিকই, কিন্তু যারা খুলেছে, সেখানে নাকি উপচেপড়া ভিড়। সুপারশপগুলোতেও মানুষের তিল ধারণের জায়গা নেই। যখন ঘর থেকে বের হওয়া মানা ছিল, তখনো মানুষ দোকানপাটে ভিড় করেছিল, আর এখনতো কথাই নাই। সবাই কারণে-অকারণে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বাজারে।
এরকম একটা ভয়ংকর সময়েও আমাদের কেনাকাটা কেন করতে হচ্ছে? একবারও কেউ ভাবছেনা যে, বাজারে ঘুরে করোনা নিয়ে বাসায় ফিরে সে নিজেও অসুস্থ হতে পারে? বা পরিবারের খুব প্রিয়জন কেউ আক্রান্ত হতে পারেন? পরিবারের কেউ যদি আক্রান্ত হন এবং মারা যান, তাহলে সেই ঈদের কী মানে হলো!
এটাতো গেল একটি দিক, অন্যদিকটা হলো, করোনার কারণে লকডাউনে বাংলাদেশের শহরগুলোতে বস্তিতে থাকা দরিদ্র মানুষের আয় গড়ে ৮০ ভাগ কমে গেছে। একটি জরিপে দেখা গেছে, এদের মধ্যে শতকরা ৬৩ ভাগ মানুষ হচ্ছে দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, বাসায় সাহায্যকারী, ছোট হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মী, পরিবহণ শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি, ছোট দোকানদার, তাদের সহযোগী। দ্য পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট এপ্রিলে এই জরিপটি চালিয়েছিল।
৪০ ভাগ দরিদ্র ও ৩৫ ভাগ দরিদ্র নয়, কিন্তু অসচ্ছল, এমন মানুষ তাদের প্রতিদিনের খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এদের হাতে টাকা নেই বললেই চলে। বস্তির মানুষের মাথাপিছু আয় কমেছে শতকরা ৮২ ভাগ। গ্রামীণ দরিদ্রদেরও মাথাপিছু আয় কমেছে শতকরা ৭৯ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, অবস্থা আরও খারাপ হবে। দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্ত বহু পরিবার প্রায় আধপেটা খেয়ে বেঁচে আছেন। তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, ওষুধ, বাচ্চার দুধ কেনার পয়সা নেই। আমরা যদি নিজ নিজ পরিবার ও আশেপাশের মানুষের দিকে দৃষ্টি দেই, দেখবো এদের অনেকেই খুব কষ্টের মধ্যে আছেন। কিন্তু, মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না।
আমাদের অর্থনীতি এতটা ভাল না যে দিনের পর দিন রিলিফ দিয়ে সরকার মানুষকে বাঁচাতে পারবে। যদিও সরকার কৃষি ও গার্মেন্টেসসহ বিভিন্ন খাতে ১১ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রেখেছেন। কিন্তু, এখনি এক কোটি মানুষের জন্য খুব জরুরি সাহায্য দরকার। কারণ, এদের কাজ নেই, আয় নেই। আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে শক্তিশালী খাত গার্মেন্টস এবং অভিবাসী শ্রমিকের রেমিট্যান্সের টাকা, সবটাতেই টান ধরেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির এগিয়ে চলা হঠাৎ ধাক্কা খেয়েছে এই করোনার কারণে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, দরিদ্র মানুষ ও অনানুষ্ঠানিক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মহামারির কারণে আয় কমে যাওয়ায় দেশে দারিদ্রের হার বেড়ে হয়ে যাবে ৪০ দশমিক ৯ ভাগ। যা বর্তমান দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ ভাগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
একে মোকাবিলা করার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি এগিয়ে আসতে পারি আমরাও, যারা এখনো খেয়ে-পরে ঈদের কেনাকাটা করার সামর্থ্য রাখি। আর এবার সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে— ঈদের কেনাকাটার নামে আমরা বাজার থেকে নিজেদের, পরিবারের, পাড়া-প্রতিবেশীর মৃত্যু পরোয়ানা কিনে আনছি!
একবার বন্যার পরে কোরবানির ঈদ ছিল। আমি ডেইলি স্টারেই একটা লেখা লিখে সবার কাছে অনুরোধ করেছিলাম, কোরবানির খরচ কিছুটা কমিয়ে টাকাটা বন্যার্তদের মাঝে দান করে দিতে। যেমন: কেউ যদি দুই লাখ টাকা দিয়ে একটা গরু কোরবানি দিতে চান, তিনি শুধু এই খরচটা সামান্য কমিয়ে দেড় লাখ টাকায় গরু কিনে বাকি টাকাটা দরিদ্র মানুষকে ভাগ করে দিতে পারেন। যারা ৪/৫ ভাগ কোরবানি দেন, তারা ২/৩ ভাগ দিয়ে দিয়ে বাকি টাকাটা দান করতে পারেন।
যে যেভাবেই দান করুন না কেন, আল্লাহর কাছে দানের কথাটা ঠিকই পৌঁছে যাবে। আমি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেও আবেদন করেছিলাম, সামনের পূজায় খরচ কিছুটা বাঁচিয়ে বন্যার্তদের কিছু ত্রাণ দিতে। এরপর আমাকে পত্রিকা মারফত পাঠকদের এত গালি হজম করতে হয়েছিল যে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। লেখাটি ঠিকমতো না পড়েই উনারা ভেবে নিলেন আমি কোরবানি দিতেই নিষেধ করেছি, তাই এই গালির বন্যা।
তাই এইবারের ঈদে কেনাকাটা না করে সেই টাকার কিছুটা অংশ মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানাতে গিয়ে ভাবছি, আবার না গালাগালি খেতে হয়। ঈদে নতুন জামা-কাপড়, জুতা বা অন্য কিছু কেনা এবং পেট ভরে মিঠাই-মণ্ডা ও পোলাও-কোর্মা খাওয়াটা হচ্ছে একটা আনন্দ উদযাপন। এই আনন্দ তখনই ভালো লাগবে, যখন আমার চারপাশের মানুষ সেই আনন্দে কিছুটা হলেও অংশ নিতে পারবে। আমার আব্বা বলতেন, যে উৎসব আয়োজনের সঙ্গে মা-হারা সন্তান আর অসহায় মানুষের যোগ নেই, সেই উৎসব আসলে কোনো উৎসব নয়, এ হয় শুধু উদযাপন। তাইতো কবি গেয়েছেন,
‘যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরিব ইয়াতিম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ।’
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
ranjana@manusher.org
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments