ভোগবাদিতা পরিহার করি, নিজে বাঁচি-দেশকে বাঁচাই
আমরা মানে শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজ দিনে দিনে মোটামুটি ধরনের ভোগবাদী হয়ে উঠেছিলাম। গ্রামেও এর পরশ লেগেছিল। কারণে-অকারণে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে খরচ বাড়িয়ে তুলেছিলাম। কেমন করে যেন ব্যয় আয়ের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। আর এই সমন্বয়হীনতা কাটাতে সবাইকে পড়িমরি করে ছুটতে হচ্ছে। এই ছোটাছুটি করতে গিয়ে সৎ-অসৎ এর বিভাজনটাও উঠে গেছে অনেকখানি। জনগণের পাশাপাশি সরকারও অনেকটাই ভোগবাদী অর্থনীতির চর্চা শুরু করেছে। উন্নত বিশ্বের জীবন আমরা অনুসরণ করতে চাইছি কিন্তু সেই সব দেশের মতো সাপোর্ট সিস্টেম আমরা তৈরি করতে পারিনি।
আমরা কীভাবে খরচ বাড়িয়েছি এর খুব সাধারণ একটা উদাহরণ আছে- যেমন আগে আমরা বাসায় তিনটা সাবান ব্যবহার করতাম, একটা গা ধোয়া, আরেকটি কাপড় ধোয়ার এবং বাসন মাজার। কালে কালে এল চুল ধোয়ার, হাত ধোয়ার, মুখ ধোয়ার, টয়লেট করার এবং গা ধোয়ার আলাদা আলাদা সাবান। বাসন মাজার দুই ধরণের, কাপড় ধোয়ার এবং ঘরবাড়ি পরিষ্কার করার সাবান। তাহলে সর্বসাকুল্যে দাঁড়াল কমপক্ষে ৯ ধরনের সাবান। এর মধ্যে আবার অনেকগুলোই বিদেশি। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এভাবেই সব খাতে তাদের খরচ বাড়িয়েছে। হাল ফ্যাশনের প্রসাধনী দ্রব্য, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, পোশাক-জুতা, বাইরে খাওয়া, অনলাইন কেনাকাটা, বাচ্চার খেলনা-কাপড়, অসংখ্য উৎসব-দাওয়াত, বেড়াতে যাওয়া, আসবাবপত্র কেনা, গাড়ি-বাড়ি কেনা। সন্তানের শিক্ষা খাতে মধ্যবিত্তরা বোধ করি খরচ বাড়িয়েছি সবচেয়ে বেশি। আমাদের বাবা-চাচারা যে টাকায় সংসার চালাতেন, এর চেয়ে ১০০ গুণ খরচ বেড়েছে আমাদের।
কেন বেড়েছে? এর সোজা উত্তর মানুষ সচ্ছলতা ভালবাসে, আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে জীবনযাপনের ব্যয়ও বেড়েছে। কিন্তু আমরা নিজেরাই বুঝতে পারিনি কখন আমাদের এই সচ্ছলতার চাওয়া ভোগবাদিতায় রূপ নিয়েছে।
সেই তুলনায় কিন্তু আমাদের আয় বাড়েনি লাফিয়ে লাফিয়ে। এর পরেও আমরা নানাভাবে ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের অ্যাডজাস্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে করোনা ঝড় বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এসে আমাদের থমকে দিল। চলমান জীবন-জীবিকার ওপর এমন আঘাত হানল, যা আমাদের চিরচেনা জগৎ থেকে ছিটকেই ফেলে দিল বলা যায়।
পরিচিত-অপরিচিত সব মানুষের মধ্যে একই আতংক লক্ষ্য করছি। সবার জিজ্ঞাসা করোনার পরে আমাদের জীবনে কী নেমে আসছে? কেমন হবে আমাদের সেই বেঁচে থাকার সংগ্রাম? কীভাবে আমরা এই আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠব? করোনাতে বেঁচে থাকব কী না? এর পাশাপাশি সবার চিন্তা সেই বেঁচে থাকাটা কেমন হবে? আমাদের কাজকর্ম থাকবে কী না? থাকলেও বেতন কি কমে যাবে? নাকি প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যাবে? এই চিন্তা কম বেশি সব মধ্যবিত্ত মানুষকে দারুণভাবে অস্থির করে তুলেছে। যাদের ব্যাংকে জমানো টাকা আছে, তারা ভাবছে কতদিন এই টাকায় চলবে?
২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থ সংকটকালে বাংলাদেশিরা কিছুটা হলেও পার পেয়ে গিয়েছিলাম আমাদের পোশাক শিল্প আর অভিবাসী শ্রমিকদের আয়ে। কিন্তু এবারের ঝড়ে এই দুই খাতের অবস্থায়ও টালমাটাল। শুধু আমরা নই, বিশ্বব্যাপী কাজ হারাবে অগণিত মানুষ। বিশ্বজুড়ে শ্রমিকরা অর্ধেক কাজ হারাবে। তবে উন্নত দেশগুলো তাদের নাগরিকদের অর্থ সহায়তা দিচ্ছে, যেন তারা তাদের দিন চালিয়ে যেতে পারেন। কারণ মানুষের হাতে টাকা না থাকলে বাজার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।
প্রতিষ্ঠানের মালিকরা করোনার সময়ে হওয়া তাদের এই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য বেতন কাটার কথা বলছে। কোনো কোনো দেশে বেতন কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কয়েকটি দেশ ব্যবসায়ীদের এবং অন্যান্য নাগরিকদের প্রণোদনা সহায়তা দেওয়ার কথা বলেছে, যেন পরোক্ষভাবে ক্রেতারাও সহায়তা পায়।
বাংলাদেশে কিন্তু বেতন কাটা মানে কাটা। সেই অংশ বাদ দিয়েই আমাদের চলতে হবে। এ দেশের দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষ করোনার কারণে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই বিপদের মধ্যে পড়েছে। তারা দরিদ্র থেকে অধিকতর দরিদ্র হয়েছে। সরকারের দেয়া সাহায্য তাদের কিছুটা রক্ষা করতে পারলেও, চরম অর্থকষ্ট থেকে বাঁচাতে পারেনি।
এবার কিন্তু বিপদে পড়তে যাচ্ছে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা। কাজ হারিয়ে বা বেতন কমে যাওয়ায় মানুষ বাধ্য হবে খরচ কমাতে। বাড়তি খরচ কমলে অসুবিধা নাই কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতে খরচ কমাতে হলে বিপদ। মানুষের স্বভাবটাই এমন যে, একবার ব্যয়ের পারদ উঠলে, তা নামানো খুব মুশকিল। এখানে সরকার তার কর্মীদের বেতন কমাবে না। বেসরকারি সেক্টরে অনেকের বেতনও কাটা যাবে, চাকরিও হারাবে। সেক্ষেত্রে দেশে বৈষম্য বাড়বে নিঃসন্দেহে।
সেদিন পত্রিকায় পড়লাম- হাজার হাজার অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক এই মহামারির কারণে অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে পারেন বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন সিডনী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রেইন অ্যান্ড মাইন্ড সেন্টার। তাদের ধারণা প্রতি বছর অতিরিক্ত ৭৫০ থেকে ১৫০০ জন মানুষ বেশি আত্মহত্যা করবে এবং তা চলবে প্রায় ৫ বছর পর্যন্ত। সে দেশের সরকার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করবে মানুষকে এই হতাশা থেকে উদ্ধার করার ও স্টাফদের চাকরিতে রাখার জন্য। শুধু অস্ট্রেলিয়া নয় আমেরিকা, কানাডা, সিঙ্গাপুর, জাপান সব উন্নত দেশই এটা করছে। কারণ সেই সব দেশের সরকার মনে করে মানুষকে সতেজ রেখে দেশে টাকার চলাচল অব্যাহত রাখতে হবে। তা না হলে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে।
বাংলাদেশে বেসরকারি কোম্পানিগুলো চাকরিচ্যুত না করলেও বা লে-অফ ঘোষণা না করলেও, বেতন কাটা ছাড়া হয়তো তাদের কোনো উপায় থাকবে না। ইতোমধ্যেই কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন কাটছে, অর্ধেক বেতন দিচ্ছে বা বেতন দিচ্ছেও না বলে শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ বিবিসিকে বলেছেন, করোনাভাইরাসজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে মানুষ আর্থিক ঝুঁকিতে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। এর মধ্যে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের বিপদ অনেক বড়। সংকটে এরা পথেও নামতে পারবেন না, কারো কাছে হাতও পাততে পারবে না। এই পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ে হাত পড়বে। তিনি মনে করেন এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে ২/১ মাসের মধ্যে তা প্রবলভাবে দৃশ্যমান হবে।
এদিকে গবেষণা সংস্থা সিপিডিও বলেছে- লকডাউনের কারণে প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ পরিবার ভঙ্গুর জনগোষ্ঠীর মধ্যে পড়বে। বেসরকারি ব্যাংক আইএফআইসি’র এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন- গত এক মাসে অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি মানুষ সঞ্চয়পত্র ভেঙেছে, কিন্তু নতুনভাবে কেনেননি।
একইসঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অবস্থা খুবই সঙ্গিন। ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে। ব্যবসার লাভ থেকে উৎপাদক ও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করে এবং স্টাফদের বেতন দেয়। সঙ্গে নিজের সংসার চলে। এতদিন এভাবেই চলেছে। কম বা বেশি ব্যবসা হলেও ব্যবসা এরকম মুখ থুবড়ে পড়েনি কখনো। অনেকেই জানিয়েছেন এরকম অবস্থায় নিজের সংসার ও প্রতিষ্ঠান চালানো, ব্যাংক লোন শোধ করা এবং কর্মীদের বেতন ভাতা দেওয়া অসম্ভব। সরকার যদি কোনো প্রণোদনা দেয়, তবেই সম্ভব এই চাপ সামলে ওঠা। কিন্তু সরকারের পক্ষে কি অগণিত উদ্যোক্তার দায়ভার গ্রহণ করা সম্ভব? এর মধ্যে যদি বড় বড় প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করে বা বেতন কাটে তাহলে পুরো খড়গটা এসে পড়বে মধ্যবিত্তের মাথায়। ভয়ংকর ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হবে আমাদের মতো ভোগবাদী হয়ে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্তের জীবন। একেকটি পরিবার একেক মাত্রায় ভূকম্পন অনুভব করবে।
এতে দেশের অর্থনীতিও গতি হারাবে। অর্থ বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিশ্বব্যাপী ১৯৩০ এর পর এরকম হুমকি মধ্যবিত্তের জীবনে আর আসেনি। আমাদের অর্থনীতি এই দুর্যোগকে ঠেকা দেওয়ার মত সবল নয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণী ঝড়ের মুখে এবং বেশ ভঙ্গুর অবস্থানে রয়েছে। এ দেশের সাধারণ মানুষ যখন কিছুটা ভালো আয় করতে শুরু করেছে, তখন থেকেই অর্থনীতির চাকা গতি পেতে শুরু করেছে। এখন যদি করোনার কারণে এই আয় কমে যায়, টাকা যদি বাজারে না থাকে তাহলে অর্থনীতির চাকাও ঘুরবে না। মধ্যবিত্ত সমাজ ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত মনে করলে এবং হাতে টাকা না থাকলে খরচ করবে না বা খরচ করতে পারবে না। এ দেশের ধনীরা দেশে বিনিয়োগ করে বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষই দেশের অর্থনীতিকে সজীব রাখে। তবে এটাও ঠিক আমাদের সবাইকে ভোগবাদিতা থেকে সরে আসতে হবে। কারণ ভোগবাদী উন্নত বিশ্ব যা পারে, আমরা তা পারি না। তাই অন্ধভাবে তাদের অনুসরণ করাও ঠিক না।
তাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারকে এবং দেশের ধনীদের এগিয়ে আসতে হবে মধ্যবিত্তসহ সব ধরনের মানুষের হাতে ন্যূনতম উপায়ে টাকার যোগান সচল রাখতে। সরকার কিছু কম দরকারি প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখতে পারে, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর-প্রশিক্ষণ বছর খানেকের জন্য বন্ধ করতে পারে। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং জনবান্ধব সেবা সহায়তা জোরেশোরে চালু করতে হবে। কারণ সাধারণ মানুষ বাঁচলেই দেশ বাঁচবে। মানুষ যখন লাইফ সার্পোটে, তখন তো অক্সিজেনের যোগান বাড়াতেই হবে। কীভাবে বাড়াতে হবে, তা বলে দেবেন দেশের অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা।
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
ranjana@manusher.org
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments