তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া

পিঠমোড়া করে হাতকড়ায় বাঁধা ক্যামেরাশিল্পী

যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী আজও ইফতার করেছি। রোজা যে রাখেননি, হয়ত তিনিও ইফতার করেছেন। আমরা কি জানি কাজলের সন্তান-স্ত্রী আজ ইফতার করেছেন কি না? কী করছিলেন তারা আজ ইফতারির সময়? নগর জীবনের ঘরবন্দী আমাদের সেই সময় কোথায় যে, সাংবাদিক কাজল বা তার স্ত্রী-সন্তানের কথা ভাববো!
অনুপ্রবেশের অভিযোগে বিজিবির করা মামলায় আদালতে হাজির করা হয় সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে। ছবি: স্টার

যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী আজও ইফতার করেছি। রোজা যে রাখেননি, হয়ত তিনিও ইফতার করেছেন। আমরা কি জানি কাজলের সন্তান-স্ত্রী আজ ইফতার করেছেন কি না? কী করছিলেন তারা আজ ইফতারির সময়? নগর জীবনের ঘরবন্দী আমাদের সেই সময় কোথায় যে, সাংবাদিক কাজল বা তার স্ত্রী-সন্তানের কথা ভাববো!

গতরাত তিনটার দিকে কাজল তার ছেলে মনোরম পলকের মোবাইলে কল করে বলেছিলেন, আমি বেঁচে আছি। আমাকে নিতে বেনাপোলে আসো। পলক ভোররাতে রওনা দিয়েছে বেনাপোলের উদ্দেশে। রাস্তা থেকেই শুনেছে তার বাবাকে যশোর আদালতে আনা হচ্ছে। তারপর থেকে আদালতে অপেক্ষা করে থাকে ছেলে বাবার পথ চেয়ে। পৌনে তিনটার দিকে তার বাবা এসে পৌঁছান। মুখ ভর্তি বেশ বড় বড় দাড়ি। এতদিন পর ছেলেকে সামনে পেয়েও বুকে টেনে নিতে পারেননি বাবা। বাবার দুই হাত পিঠমোড়া করে হাতকড়া পরানো। সন্তান কি বাবার এই চেহারা দেখার প্রত্যাশা নিয়ে ঢাকা থেকে গেছে!

কারও পক্ষে কি অনুধাবন করা সম্ভব, কাজল ও তার ছেলের ভেতরটা কেমন করছিল তখন! কাজলের যে পেশা তাতে বিত্তবান হওয়ার সুযোগ নেই। কাজল বিত্তবান ননও। হয়ত সন্তানের অনেক চাহিদা তিনি পূরণও করতে পারেননি। তারপরও সন্তানের হয়ত গর্ব ছিল তার বাবা সাংবাদিক। জনমানুষের জন্যে কাজ করেন, করার চেষ্টা করেন। সত্য বলেন, ন্যায়ের পথে চলেন। তার পরিণামই কি এই হাতকড়া?

১৯৪৩ সালের যে পুলিশ আইন তাতে, হাতকড়া পরানোর কথা সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই। তবে পালিয়ে যাওয়ার বা বল প্রয়োগের আশঙ্কা থাকলে পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে। সাংবাদিক কাজলের কি পালানোর বা বল প্রয়োগের কোনো সম্ভাবনা ছিল? কাজলের নিখোঁজ বা অপহরণের বিষয়টি এদেশে কে না জানতেন? বিজিবি, পুলিশ কারোরই অজানা থাকার কথা নয়। কাজল নিজেও নিশ্চয় বিজিবিকে পরিচয় দিয়েছে। পুলিশ অবগত ছিল বা কাজলের থেকে জেনেছে। তারপরও পুলিশ মনে করেছে যে কাজল পালিয়ে যাবে! অথচ সাত খুনের আসামিদেরও হাতকড়া ছাড়া আদালতে আনতে দেখা গেছে।

সাংবাদিক কাজল জঙ্গি বা সন্ত্রাসী নন। ভয়ঙ্কর খুনি বা হত্যা মামলার আসামিও নন। কাজল অপহৃত হয়েছিলেন। অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। এ বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে বলছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ‘কাজল অপহৃত বা নিখোঁজ হন এবছরের ১০ মার্চ। ২৪ মার্চ অজ্ঞাতনামা আসামিদের নামে চকবাজার থানায় একটি অপহরণ মামলা করা হয়েছে। সেই মামলা বিষয়ে পুলিশের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। যখন তাকে ভারত সীমান্ত থেকে উদ্ধারের কথা বলে পাসপোর্ট আদেশ, ১৯৭৩ এর ১১(৩) ধারায় মামলা করা হলো তখন পুলিশের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। এতদিন অপহরণ বা গুম করে রাখার অভিযোগ নাকচ করার জন্য এই নাটক সাজানো হয়ে থাকতে পারে। এটি দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার স্পষ্ট ব্যর্থতা, যেখানে সাধারণ নাগরিক সত্যিকারের নিরাপত্তা পাচ্ছে না। আইনের বেড়াজালে হয়রানির শিকার হচ্ছে।’

কাজল বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকতে গিয়ে বিজিবির হাতে গ্রেপ্তার হননি। কেউ দেখেনি যে কাজল বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সীমান্তে ঢুকছিলেন বা ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকছিলেন। ভারতীয় বিএসএফ তাকে গ্রেপ্তার করলে সেটা হতো অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ। কাজলকে বিজিবি গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশের মাটি থেকে। কাজল ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, এটা বিজিবি অনুমান করেছে। এটা পাসপোর্ট ছাড়া দেশে প্রবেশের অনির্দিষ্ট অপরাধ করার অভিযোগ, অনুপ্রবেশের অভিযোগ নয়। কিন্তু বলা হচ্ছে কাজলের নামে অনুপ্রবেশের মামলা করা হয়েছে।

যে মামলা হয়েছে, তাতে তিনি জামিন পেলেও ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তারচেয়েও ভয়ঙ্কর বিষয় নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার নামে মামলা আছে।

সাংবাদিক কাজলের নিখোঁজ বা অপহরণ নিয়ে বহু প্রশ্ন আকাশে-বাতাসে। গুঞ্জন আছে, উত্তর নেই। কাজল এদেশে সেই অল্প কয়েকজন ভাগ্যবানদের একজন যিনি নিখোঁজ বা অপহৃত হয়ে জীবিত ফিরে এসেছেন। বহু সংখ্যক নিখোঁজ বা অপহৃতের সন্ধান মেলেনি। মিলবে কিনা, অনিশ্চিত...। বহু মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোনের চোখের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।

কাজলের মতো যে কয়েকজন ফিরে এসেছেন, তারা কেউ কিছু বলেননি। কাজল বলবেন? কেন কাজলরা ফিরে এসে কিছু বলেন না? জানি না বা হয়ত জানি।

নিখোঁজ বা অপহরণ এবং ফিরে আসা ও তার পরবর্তী ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ভয় দেখানো ও অপমান-অসম্মানের বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে সম্পন্ন করা হয়। সাংবাদিক কাজলের ক্ষেত্রেও যা করা হলো। নাগরিকরাই তো রাষ্ট্রের মালিক। সেই নাগরিকরা কেন গুম-খুন-নিখোঁজ হবেন?

কেনই বা হবেন অপমানিত-অসম্মানিত? মু্ক্ত গণমাধ্যম দিবসে পৃথিবী দেখবে পিঠমোড়া করে হাতকড়ায় বাঁধা ক্যামেরাশিল্পী!

s.mortoza@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

‘Vested groups behind violence in the hills’

Three advisers, who visited Rangamati and Khagrachhari yesterday, have pointed out that vested groups are trying to destabilise the situation in the hills with a view to putting the interim government in an awkward position.

1h ago