‘একদিন হয়তো সব ঠিক হবে, কিন্তু আমরা কি সত্যিই মানুষ হবো?’
আম্মার ফোন পাই না প্রায় তিন মাস হয়ে গেল। আমি খবর নেই, আর না নেই আম্মা প্রতিদিন অন্তত একবার ফোনে খবর নিতোই। আমি খুশি হলেও নিতো, বিরক্ত হলেও নিতো। আর কোন অচলাবস্থা হলে দিনে ৩/৪ বার সবার খোঁজ নিতো। তাই ভাবছি, এই করোনাকালে যদি আম্মা বেঁচে থাকতো তাহলে তাঁর টেনশন হতো আকাশ সমান।
আম্মার ছেলে-মেয়ে, নাতনি, আত্মীয়-স্বজন, চারপাশে থাকা অসহায় মানুষের কথা ভেবে ভেবে নিজেই কাহিল হয়ে পড়তো। সবাইকে নিজের মতো করে সাহায্য করতে পারতো না বলে অসহায়বোধ করতো। আম্মাকে আমি কখনো দেখিনি নিজের কথা ভাবতে। তাঁর সব প্রার্থনা ছিল আমাদের সবাইকে ঘিরে। জগতের সব বাবা-মায়েদের চিন্তা মনে হয় সন্তানকে ঘিরেই থাকে। তারা চান, ‘তাদের সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ আমরাও কি অন্তর থেকে বাবা-মাকে ভালোবাসি না? এখন কেন যেন মনে হচ্ছে— জানি না।
করোনাকালে আমার চিন্তাভাবনাগুলো কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। খবরে পড়ছি, টিভিতে দেখছি করোনা আক্রান্ত মা-বাবাকে রাস্তায় বা জঙ্গলে ফেলে রেখে সন্তানরা চলে গেছে। দেশে চলমান করোনা মহামারির সময়ে একের পর এক অমানবিক সব ঘটনা ঘটে চলছে। করোনার উপসর্গ থাকায় টাঙ্গাইলের সখীপুরের জঙ্গলে বৃদ্ধা মাকে ফেলে যাওয়া ও পাবনার দুর্গম যমুনার চরে এক বৃদ্ধকে ফেলে যাওয়া ঘটনা দুটির পর, একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর উপকন্ঠ সাভারে। মাকে টাঙ্গাইলের সখীপুরে বনে ফেলে যাওয়ার সময় তার সন্তানরা বলেছিল— ‘মা, তুমি এই বনে এক রাত থাকো। কাল এসে তোমাকে নিয়ে যাব’ এই কথা বলে মাকে শাল-গজারির বনে ফেলে যান তাঁর সন্তানেরা। তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে সন্তানরা এমনটা করেছে।
কেন তার সন্তানরা তাকে এইভাবে ফেলে যেতে পারলো? কয়েক দিন ধরে ওনার জ্বর, সর্দি, কাশি শুরু হলে আশপাশের বাসার লোকজন তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। আর সেই অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য শেরপুরের নালিতাবাড়ী যাওয়ার পথে সখীপুরের জঙ্গলে সন্তানরা মাকে ফেলে যায়।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে পরিবারের লোকজন তাদের মরদেহ গ্রহণ পর্যন্ত করছে না। কেউ কেউ হাসপাতালে বাবা-মা, স্বজনদের ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে। পরে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম ও মারকাজুল ইসলাম সেই মরদেহ গ্রহণ করে দাফন ও দাহ করার দায়িত্ব নিচ্ছে।
অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে যে, ছেলে ও আত্মীয়রা সঙ্গে কবরস্থানে গেলেও মরদেহ কবরে নামাচ্ছে না। করোনা আক্রান্ত হতে পারে, এই ভয়ে তারা বাবা-মায়ের লাশ থেকে বেশ দূরে থাকছে। অথচ, বারবার বলা হচ্ছে মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর আর ভাইরাস ছড়ায় না। একজন ডাক্তার জানালেন, সন্তান করোনায় আক্রান্ত বাবার লাশ নিতে না চাইলেও মৃত্যুর সনদপত্র নিতে চাইছে। কারণ, সম্পত্তির জন্য এই সনদ সন্তানের দরকার।
সংকটকালে কি মানুষ একাত্ম হয়? নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট ডেভিড ব্রুক লিখেছেন, সাধারণত দেখা যায় কোনো মহামারি দেখা দেওয়ার প্রথম দিকে মানুষ সহযোগিতা পরায়ণ থাকলেও পরে, মানে মহামারির প্রকোপ বাড়লে মানুষের আচরণ পাল্টে যায়। মহামারি যদি সংক্রমক হয়, তাহলে তা মানুষের ভালোবাসার বাঁধনকে ছিন্ন করে ফেলে। মানুষ ভয়ে অমানবিক আচরণ করে থাকে।’
এর বহু প্রমাণ আমরা ক্রমাগত পেয়েই চলেছি। করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর আক্রান্ত ব্যক্তির পুরো পরিবারকে একের পর এক অবর্ণনীয় হেনস্থা আর হয়রানি পোহাতে হয়েছে। ডাক্তার বলার পরও করোনা রোগীকে বাসায় রাখা যায়নি বাড়িওয়ালা ও পাড়া প্রতিবেশীর চাপে। এদিকে, হাসপাতালে নেওয়ার সময় সিএনজিচালক জোর করে নামিয়ে দিয়েছে করোনা শোনার পর। যে ডাক্তার ও সেবাকর্মীদের আমাদের প্রয়োজন এই ভয়াবহ দুর্য়োগে, সেই চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ জরুরি সেবায় নিয়োজিত মানুষ ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশে কটুক্তি ও অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন। এমনকী, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি মারা গেলে তার জানাজা করা ও কবর দেওয়া নিয়েও ঝামেলা হচ্ছে। করোনাকে ঘিরে নানাধরণের গুজব থেকে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে জনমনে।
মানুষের এই আচরণের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘চিকিৎসক, নার্সসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কোনো কোনো স্বাস্থ্যকর্মীকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। রূঢ় আচরণের শিকার হচ্ছেন তারা। একসময় মানুষ মনে করতেন, ফ্ল্যাটে একজন ডাক্তার থাকলে অনেক সহায় হবে। কিন্তু তাঁরাই আবার মনে করছেন, ফ্ল্যাটে একটা ডাক্তার থাকা মানে ঝুঁকি। এই মনোভবের কারণ, করোনাভাইরাস সম্পর্কে আমাদের কুসংস্কার বা স্টিগমা।’
স্টিগমা, যাকে সহজ বাংলায় বলা যায় কুসংস্কার বা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে কাউকে লজ্জা দেওয়া, কলঙ্কযুক্ত করা এবং এর কারণে একঘরে হতে বাধ্য করা। সমাজের সমালোচনা, ভীতি ও অচ্ছুৎ হওয়ার ভয়েই মানুষ অনেক ক্ষেত্রে সত্য গোপন করে। সমাজে কোন ধরণের অসুস্থতা নিয়ে মিথ্যা ধারণা একদিকে যেমন নানারকমের সমস্যা সৃষ্টি করে, অন্যদিকে তেমনি অসুস্থ মানুষের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে। স্টিগমা সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করে।
শুধু আমাদের দেশে নয়, মার্কিন গণমাধ্যম জানিয়েছে করোনা আসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও স্বাস্থ্যকর্মী ও জরুরি অবস্থায় প্রথম যারা এগিয়ে আসেন, তাদেরকেও স্টিগমার শিকার হতে দেখা গেছে।
১৯৯০ সালে একজন মেডিকেল সাইকোলজিস্ট ফিলিপ স্ট্রং ‘এপিডেমিক সাইকোলজি: এ মডেল’ শীর্ষক এক গবেষণায়— মানুষের মনো-সামাজিক অবস্থা বর্ণণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভয়, আতঙ্ক, নীতি-নৈতিকতা মহামারির সময় মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে থাকে। এর আগে ১৯৮০ সালে মরণব্যাধি এইডসও জনগণ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের যথেষ্ট ভীত করে তুলেছিল। এইডস নিয়ে প্রচার-প্রচারণার আগে মানুষ এইডস রোগীদের কুষ্ঠরোগীদের মতো অচ্ছুৎ মনে করতো। ইবোলা ও মার্স এর সময়েও তাই ঘটেছিল।
এই স্টিগমার কারণেই অসুখ নিয়ে তথ্য গোপনের সংস্কৃতি চালু হয়েছে। কেউ চায় না সমাজে অচ্ছুৎ হতে, নিগৃহীত হতে। তাই ভয়েই অসুখের কথা স্বীকার করে না। আর অসুখের কথা লুকানোর ফলে সংক্রামক ব্যধি আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ে। মিডফোর্ট হাসপাতাল ও বারডেম হাসপাতালে এভাবেই করোনা ছড়িয়েছে। মূলত ভুল তথ্য ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্যের অভাব স্টিগমা তৈরি করে।
কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন থেকে বেরিয়ে আসার পর কোনো ব্যাক্তি কিন্তু আর অনিরাপদ নন। চিকিৎসকরা মনে করেন রোগী সুস্থ হয়ে বাসায় যাওয়ার আগেই তাদের এলাকাবাসীকে প্রস্তুত করার প্রয়োজনীয়তা আছে। স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরা যদি বিষয়টি ঠিকমতো বুঝতে না পারেন, তাহলে সন্দেহ, কুসংস্কার ও বৈষম্য বেড়ে যাবে। অসুখের জন্য কাউকে দায়ী করা হলে এটা আরেক ধরণের অসুস্থতা বলে ধরে নিতে হবে।
রোগীরা ভালো হয়ে ফিরে গেলে তারা তাদের অভিজ্ঞতার কথা সবাইকে জানাতে পারেন। সেই সুস্থ হয়ে ফিরে আসা রোগী হতে পারেন তথ্যভাণ্ডার। তাদের কাছ থেকে মানুষ শিখতে পারে— কী করতে হবে, কী করতে হবে না।
মানুষের এই ভুল ধারণা দূর করার জন্য সরকার, গণমাধ্যম, প্রভাবশালী মহল, ধর্মীয় নেতা, মোড়ল ও তারকাদের স্টিগমার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। রোগটা সম্পর্কে সত্য তথ্য, সহজ ভাষায়, বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করতে হবে। লোকে যত বেশি জানবে, তত কম ভয় পাবে এবং স্টিগমা দূর হবে।
ভয়াবহ এই আপদকালে বাবা-মা, সন্তান, পরিবার, স্বজন, বন্ধু— সবাই কেমন যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। এসব দেখে-শুনে আমিও স্বার্থপরের মতো বারবার ভাবছি—এই সময়ে যদি আম্মা করোনায় মারা যেত তাহলে আমরা কী করতাম? আমরাও কি তার পাশে থাকতাম না? তাকে কবরে নামানোর জন্য এগিয়ে যেতাম না? সবার চাপে পড়ে তাকেও কি কোথাও ফেলে দিয়ে আসতাম? পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনরাই বা কী ভূমিকা পালন করতো?
তাই এই কিছুদিন আগে আম্মার চলে যাওয়াটাকে কেন যেন বারবার অনুভব করছি। অবচেতনভাবে কিছুটা স্বস্তিও পাচ্ছি বোধ হয়। শেষে এসে কবি অভ্র ভট্টাচার্যের ভাষায় বলতে চাই—
একদিন হয়তো সব ঠিক হবে,
কিন্তু আমরা কি সত্যিই
মানুষ হবো?
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
ranjana@manusher.org
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments