কপালের কালো মেঘের নাম উপসর্গহীন করোনা রোগী

Corona BD.jpg
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

গাজীপুরের পোশাক কারখানার শ্রমিক শফিউল আলম ১৫ এপ্রিল পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলায় নিজের গ্রামে যান। করোনার উপসর্গ না থাকলেও উপজেলা প্রশাসন সাবধানতা হিসেবে তাকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলে এবং ২২ এপ্রিল তার করোনা পরীক্ষা করানো হয়। পরীক্ষার ফলাফলে এসেছিল কোভিড-১৯ পজিটিভ।

শফিউল আলম (ছদ্মনাম) গত শুক্রবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমার এখনও কোনো উপসর্গ নেই। আমি অসুস্থ বোধও করি না। গাজীপুর থেকে ফেরার পর থেকে আমি আমার বাড়ির একটি কক্ষে আলাদা আছি।’

পিরোজপুরের সিভিল সার্জন মো. হাসনাত ইউসুফ জাকি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত জেলায় সনাক্ত হওয়া সাতজন করোনা রোগীর মধ্যে শফিউল আলমসহ ছয় জনেরই কোনো উপসর্গ নেই।

একইভাবে, টাঙ্গাইলের এক পরিবারের চার সদস্য এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাইরাস সংক্রমিত চিকিৎসকের দুই আত্মীয় করোনায় আক্রান্ত হলেও তাদের কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায়নি।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত সনাক্ত হওয়া পাঁচ হাজার ৪১৬ জন করোনা রোগীর মধ্যে এক হাজার ২৫০ জনেরই কোনো উপসর্গ নেই বলে জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংখ্যা ইঙ্গিত করে যে সারা দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত রয়েছেন যাদের কোনো উপসর্গ নেই।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এক কর্মকর্তাও একই মত পোষণ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি গতকাল রবিবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আইইডিসিআর বাছাই করে পরীক্ষা করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরীক্ষা করা হচ্ছে যাদের উপসর্গ আছে তাদের। পর্যাপ্ত পরিমাণে পরীক্ষা না হওয়ার কারণে সত্যিকারের চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না।’

২৮ জানুয়ারি থেকে রাজধানীর ১০টি এবং রাজধানীর বাইরের ১২টি সহ মোট ২২টি ল্যাবে মোট ৪৬ হাজার ৫৮৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।

জানতে চাইলে আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা দাবি করেন, উপসর্গহীন রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি হবে না।

গতকাল তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা সনাক্ত হওয়া কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে ২৩ শতাংশ পেয়েছি উপসর্গহীন।’

সম্প্রতি, আইইডিসিআরের আট জন কর্মী কোভিড-১৯ পজিটিভ বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে তাদের কারো মধ্যে উপসর্গ নেই। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে আইইডিসিআরের একজন চিকিৎসক বলেন, ‘করোনা রোগীদের সংস্পর্শে আসার কারণে আইইডিসিআর কর্মীদের নিয়মিত চেকআপ করা হয়। সনাক্ত হওয়া আট কর্মীর কারো মধ্যেই করোনার উপসর্গ দেখা যায়নি।’

এই আট জনের মধ্যে ছয় জনের ইতিমধ্যে কোনো প্রকার উপসর্গ প্রকাশ না পেলেও সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বাকী দুজন রাজধানীর সংক্রমক রোগ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চের সাম্প্রতিক এক গবেষণার কথা উল্লেখ করে এই চিকিৎসক জানান, ভারতে কোভিড-১৯ রোগীদের ৮০ শতাংশই উপসর্গহীন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এই সংখ্যা অনেক বেশিও হতে পারে।’

রাজধানীর পান্থপথের সম্প্রতি এক বেসরকারি হাসপাতালের ২৫ কর্মী এই ভাইরাসের আক্রান্ত বলে সনাক্ত করা হয়েছে, যাদের কোনো উপসর্গ নেই। এ ছাড়াও ভাইরাসে আক্রান্ত স্বামীবাগের ইসকন মন্দিরের ২৮ ভক্তেরও কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি।

বিশেষজ্ঞরা কি বলেন

মেডিসিন ও সংক্রমক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান সম্প্রতি বাংলাদেশে সনাক্ত হওয়া উপসর্গহীন রোগীর সংখ্যাকে তুলনা করেছেন ‘হিমশৈলীর চূড়া’ হিসেবে।

তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের অনুমানের সপক্ষে প্রমাণ যে এখানে সংক্রমিত অনেকে রয়েছেন যাদের সনাক্ত করা যায়নি। এমন পর্যায়ে ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা আরও বেশি কঠিন। ভাইরাসটি তাদের মাধ্যমেই বেশি ছড়ায় যারা পরীক্ষা করানোর জন্য যান না। আমরা যেহেতু পর্যাপ্ত পরীক্ষা করছি না, তাই আমাদের কাছে আসল চিত্রটি নেই। আমরা যা দেখছি তা হলো হিমশৈলীর চূড়া মাত্র। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব না।’

যোগাযোগ করা হলে ঢাকা অঞ্চলে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ ও রোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শক এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শাহ মনির হোসেন জানান, সারাদেশে অনেক উপসর্গহীন রোগী রয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা এখন ভাইরাস সংক্রমণের চতুর্থ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। এর অর্থ কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হচ্ছে। এই পর্যায়ে সন্দেহভাজন রোগীর পাশাপাশি তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছেন তাদেরও পরীক্ষা করা জরুরি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতে, চতুর্থ পর্যায় বলতে বোঝায় উচ্চ স্তরের সংক্রমণ। এই পর্যায়ে একই সঙ্গে দেশের অনেক অঞ্চলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়।

অধ্যাপক মনির বলেন, ‘কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদের খুঁজে বের করার অংশ হিসেবে সারা দেশে পরীক্ষা করা হচ্ছে। উপসর্গহীন ভাইরাসের বাহকের যে কোনো সময় কিছু উপসর্গ দেখা যেতে পারে। ইনকিউবেশন পিরিয়ডের কারণে এটা হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের মহামারিবিজ্ঞানের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী দুসপ্তাহে সনাক্ত হওয়া করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে। এরপরে এটা কমতে শুরু করবে। তবে আমাদের চিন্তার কারণ হচ্ছে আমাদের দেশটি জনবহুল। যদি নিম্ন আয়ের মানুষের (যেমন বস্তিবাসী)  মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটে তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’

Comments

The Daily Star  | English

Time to build the country after overcoming dictatorship: Tarique

Highlights need to build skilled generations across all sectors

3h ago