ইংল্যান্ডে এক বাংলাদেশি কোভিড-১৯ যোদ্ধা

Dr Golam Rahat Khan
বাংলাদেশি-ব্রিটিশ ডা. গোলাম রাহাত খান। ছবি: সংগৃহীত

‘সময় কাটে করোনাভাইরাস আক্রান্ত কোভিড-১৯ রোগীদের সঙ্গে। কিছু মানুষ জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। বেঁচে থাকতে চাইছেন, আমরা তার বেঁচে থাকার যুদ্ধে সহায়তা করছি। অনেকেই বলেন, এই যে প্রতিদিন করোনা রোগীদের মাঝে যাচ্ছেন নিজেও তো আক্রান্ত হতে পারেন। অনেক ডাক্তারও তো মারা যাচ্ছেন— এসব মনে হয় না? তাদের বলি, আমরা তো একটা যুদ্ধের মাঝে আছি। সৈনিক তো যুদ্ধে যেতে ভয় পান না। ডাক্তার হিসেবে মানুষের চিকিৎসাসেবা দেওয়াই তো আমাদের কাজ। আমরা সেই কাজই করছি।’

দ্য ডেইলি স্টারকে টেলিফোনে কখাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশি-ব্রিটিশ ডা. গোলাম রাহাত খান। ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে কর্মরত ডা. রাহাতের এখনকার দায়িত্ব কোভিড-১৯ রোগীদের ইমার্জেন্সি মেডিসিন বিভাগের ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ)। বিবিসিসহ ইংল্যান্ডের গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন বাংলাদেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

ইংল্যান্ডের করোনাভাইরাস মহামারিকালে সামনে থেকে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। একদিন পর পর টানা ১২ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয় কোভিড-১৯ রোগীদের আইসিইউতে।

Dr Golam Rahat Khan
সহকর্মীদের সঙ্গে ডা. গোলাম রাহাত খান। ছবি: সংগৃহীত

ডা. গোলাম রাহাত খান ১৯৯১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হয়েছিলেন বরিশাল মেডিকেল কলেজে। ২০০০ সালে এমবিবিএস ও ইন্টার্নি শেষ করে দেশে কয়েক বছর ডাক্তারি করেন। ইংল্যান্ডে চলে যান ২০০৫ সালে। ২০০৯ সাল থেকে ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে কাজ করছেন। ডা. রাহাতের পৈত্রিক বাড়ি বরিশালের ঝালকাঠি জেলার ধামসিঁড়ি ইউনিয়নে। বাবার কর্মসূত্রে বেড়ে উঠেছেন ঢাকার মতিঝিল এলাকায়। এখন কাজ করছেন ইংল্যান্ডের বার্টস হেলথ অ্যান্ড এইচ এস ট্রাস্ট হসপিটালে

এই করোনাকালে ব্যথিত হৃদয়ে দূর থেকে বাংলাদেশকে দেখছেন, বাংলাদেশের ডাক্তারদের দেখছেন।

‘আমাদের দায়িত্ব পালনে ঝুঁকি আছে। নিজেদের রক্ষা করেই দায়িত্ব পালন করছি। একটি সাক্ষাৎকারে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এই যে করোনা রোগীদের মাঝে যান, ভয় করে না? উত্তরে বলেছিলাম, সৈনিক যুদ্ধে যাওয়ার সময় কি বলে অস্ত্র-গুলি নেই, যুদ্ধে যাব না? একথা দিয়ে এমন কিছু বোঝাতে চাইনি যে, পিপিই ছাড়াই কোভিড-১৯ রোগীদের সেবা করছি। নিজেদের রক্ষা করেই দায়িত্ব পালন করছি। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম নিয়ে সারা পৃথিবীতেই একটা সংকট তৈরি হয়েছে। আমরা কিন্তু পিপিই ব্যবহার করছি। এন৯৫ মাস্ক ব্যবহার করছি। একবার ব্যবহার করে ফেলে দিচ্ছি,’ বলছিলেন ডাক্তার রাহাত।

বাংলাদেশে পিপিই নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। রেইনকোট, এন৯৫ মাস্কের প্যাকেটে নিম্নমানের মাস্ক, খুব সাধারণমানের গ্লাভস ডাক্তারদের দেওয়ার অভিযোগ এসেছে। পিপিই সংকট তো সারা পৃথিবীতেই। আপনারা যেগুলো ব্যাবহার করছেন, মান নিয়ে প্রশ্ন বা সন্দেহ আছে?

‘একটি কথা মনে হয় বলে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের পিপিইর যে সংকটের তথ্য গণমাধ্যমে আসছে, তার সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার সংকট এক করে দেখা যাবে না। বাংলাদেশে পিপিই সংকটের যে সব সংবাদ দেখছি, তা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের সঙ্গে মিলবে না। বাংলাদেশের সংবাদ জেনে একই সঙ্গে হাসি পায়, ক্ষুদ্ধ ও আতঙ্কিতও হই। পিপিই‘র স্টান্ডার্ড সারা পৃথিবীর জন্যে একই। ইউরোপের জন্যে একরকম আর বাংলাদেশের জন্যে আরেক রকম না। রেইনকোট দিয়ে ভাইরাস ভেতরে ঢুকে যাবে। এন৯৫ মাস্ক ভেবে ডাক্তার যদি নিম্নমানের মাস্ক পড়ে কোভিড-১৯ রোগীর কাছে যান, তিনি নিজেও আক্রান্ত হবেন। সাধারণ গ্লাভস দিয়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করা যাবে না। আমি আতঙ্কিত। এই অভিযোগ সত্যি হলে ডাক্তারদের তো মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।’

‘আমরা যে পিপিই ব্যাবহার করছি সেগুলো চীন থেকে আনা হচ্ছে। তিনস্তরে কঠোরভাবে মান পরীক্ষা করার পর আমাদের কাছে আসে। এখানেও পিপিইর সংকট আছে। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা পাচ্ছি না। সবার জন্যে পিপিই জরুরি না। যারা রোগীকে স্পর্শ করবে না, অন্তত দুই ফিট দুরে অবস্থান করবে, পিপিই না পড়লেও তাদের আক্রান্তের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যদিও এখানকার সঙ্গে বাংলাদেশের হাসপাতাল-চিকিৎসা ব্যবস্থার তুলনা করা যাবে না।’

‘সবার জন্যে পিপিই সরবারাহ করা এখন খুবই কঠিন। কারণ পিপিই একবার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয়। কিন্ত যারা সরাসরি কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে আসবেন, তাদের পিপিই অবশ্যই থাকতে হবে। রেইনকোট বা পলিথিন দিয়ে পিপিইর মতো কিছু একটা বানালেই তা পিপিই হয়ে যাবে না,’ যোগ করেন ডা.রাহাত।

Dr Golam Rahat Khan
হাসপাতালের আইইউসিতে ডা. গোলাম রাহাত খান। ছবি: সংগৃহীত

পিপিই কি রি-ইউজেবল হয় না?

‘আমাদের এখানে রিইউজেবল পিপিই বলতে কিছু নেই। একটি পিপিই একবার ব্যবহার করা যায়। কারণ পিপিই পড়ে যখন কোভিড-১৯ রোগী দেখছেন, তখন পিপিইতে করোনাভাইরাস লেগে যাচ্ছে। সেটা খুলে রাখবেন, তারপর আবার ব্যবহার করবেন— এতে তো আপনি আক্রান্ত হয়ে যাবেন। আমরা কোনো পিপিই দ্বিতীয়বার ব্যবহার করি না।’

ইউরোপে করোনাভাইরাস এতো ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণ কী। কেন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না?

‘ইতালিতে করোনাভাইরাস প্রথম ছড়ায়। সেখান থেকে ইংল্যান্ডে আসে। প্রথমাবস্থায় সুপ্ত ছিল, দৃশ্যমান হয়নি। ফলে ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারেনি। ইংল্যান্ডে মার্চের ৩ তারিখে দুই জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, ১০ তারিখে শনাক্ত হয় আট-নয় জন। তারপর অবিশ্বাস্য গতিতে সংখ্যা বেড়েছে। ইংল্যান্ডসহ ইউরোপ অনুধাবন করতে পারেনি যে, করোনাভাইরাস দ্বারা তারা এতো ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হতে পারে। তাছাড়া চীন যে তথ্য জানিয়েছে তা থেকেও ইউরোপ বিভ্রান্ত হয়েছে। চীন ভয়াবহতা ও মৃত্যুর সংখ্যার সঠিক তো জানায়নি বলেই ধারণা করা হচ্ছে। করোনাভাইরাস ছয় সপ্তাহ তাণ্ডব চালিয়েছে চীনে। এতে মাত্র সাড়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করেছে চীন। এসব তথ্যই গণমাধ্যম প্রচার করেছে।’

আপনারা যেসব কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসা করছেন, তার মূল সমস্যাটা কী? ডাক্তারদের চ্যালেঞ্জটা কী, কেন এতো ডাক্তার মারা যাচ্ছেন?

‘আমরা কোভিড-১৯ আক্রান্ত সবচেয়ে গুরুতর রোগীদের চিকিৎসা করে থাকি। মেডিকেল টার্ম বাদ দিয়ে আমি যদি সাধারণভাবে বলি, যাদের ফুসফুস বা লাঙ্ক এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে— একেবারে ঝাঁঝড়া হয়ে গেছে। এসব রোগীদের তিন থেকে চার সপ্তাহ ভেন্টিলেটরে রাখি। আর্টিফিশিয়ালি ফুসফুসকে কাজ করানো, ব্লাড প্রেশার ঠিক রাখা, কিডনি ফাংশন ঠিক রাখা হয়। এটা ইন্টেনসিভ কেয়ারের রোগীদের কথা বলছি। আইসিইউতে একজন রোগীর গলার ভেতরে যখন একটি নল ঢোকাতে হয় এটাকে বলে অ্যারোসল জেনারেটিং প্রসিডিউর, তখন নলের মধ্য দিয়ে ভাইরাস ডাক্তারের শরীরে আসতে পারে। সামান্য স্পর্শ লেগে গেলে ডাক্তারদের আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে।

তবে কোভিড-১৯ সাধারণ রোগীদের ক্ষেত্রে ডাক্তারদের তেমন কিছু করার নেই, দরকারও হয় না। আইসোলেশনে ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ভালো হয়ে যান তারা।‘

পরীক্ষা করে শনাক্তের দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ইংল্যান্ডের অবস্থা কী?

‘পরীক্ষার ক্ষেত্রে সব দেশের নীতি এক নয়। ইংল্যান্ড দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশি পরীক্ষার দিকে যায়নি। এটা নিয়ে প্রচণ্ড সমালোচনায় পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। আমরা প্রতিদিন সরাসরি কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা করছি। এখন পর্যন্ত আমাদেরও পরীক্ষা করায়নি। বলছে, যাদের সিম্পটম আছে তাদেরই পরীক্ষা করা হবে। কিন্তু, ৩০ শতাংশ রোগীর কোনো সিম্পটম থাকে না। ৫৫ শতাংশের খুব সাধারণ জ্বর-কাশি থাকে। ১৫ দিন আইসোলেশনে থাকলে তারা নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। বাকি ১৫ শতাংশের মধ্যে ৫ শতাংশের আইসিইউ সাপোর্ট দরকার হয়। এই ৫ শতাংশ থেকে ২-৩ শতাংশ মারা যায়। এই ৫ শতাংশের হাসপাতালের চিকিৎসা দরকার। ৮০ শতাংশের হাসপাতালের চিকিৎসা দরকার নেই। গণপরীক্ষা করে সাফল্য পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানি। সে হিসাবে পরীক্ষা কম করার নীতি তো সঠিক না।’

বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনুমান করা খুব কঠিন। প্রতিদিন সংখ্যা বাড়ছে। আরও বেশি পরীক্ষা করলে সংখ্যা আরও বাড়বে। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। কিছুটা আশার কথা হচ্ছে, মার্চের ২ তারিখে ইংল্যান্ডে প্রথম শনাক্ত এবং আজকে এপ্রিলের ১৮ তারিখ, এই ছয় সপ্তাহে যেভাবে দানবীয় আকারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে, ১৪-১৫ হাজার মানুষ মারা গেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত তেমনটা দৃশ্যমান হয়নি। হবে না তা যদিও বলা যায় না। সত্যি যদি তেমন হয়, বাংলাদেশের যে সক্ষমতা-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা তা দিয়ে কীভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব? সে কথা ভাবলেই আঁতকে উঠতে হয়। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আর তো কিছু করার দেখছি না।’

ইংল্যান্ড বা ইউরোপ সম্পর্কে সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ কী?

ইংল্যান্ডে গত তিন দিনে আমাদের হাসপাতালে নতুন রোগীর সংখ্যা কমছে। যদিও মৃত্যুর সংখ্যা কমেনি। তবুও এটা ভালো চিত্রের ইঙ্গিত। কারণ মারা যাচ্ছে পূর্বে আক্রান্ত হওয়া রোগী। নতুন রোগী বাড়ছে না। একই চিত্র ইতালি, স্পেনের ক্ষেত্রেও। ধারণা করছি, ইউরোপ পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারছে।

s.mortoza@gmail.com

Comments