ডাক্তার বরখাস্ত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়মুক্তির চেষ্টা?

ঘটনা এক:

তার নিজের দুটি সন্তান আছে, চার ও ছয় বছর বয়সী। ছয় বছর বয়সী সন্তান প্রতিবন্ধী। তার বাড়তি যত্ন দরকার হয়। যার কথা বলছি, তিনি একজন নারী চিকিৎসক, যিনি নিজেও হৃদরোগী। চিকিৎসা করছেন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের। মার্চ মাসের শেষ দিকে নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অন্য হাসপাতালে তিন দিন কাটিয়ে, বিশ্রাম ছাড়াই আবার কোভিড-১৯ রোগীদের সেবা শুরু করেন।

প্রথম দিকে সারাদিন কাজ করে রাতে বাসায় ফিরতেন। বিল্ডিংয়ের অন্য বাসিন্দারা ভালোভাবে নিতেন না। তিনি লিফট ব্যবহার না করে, সিঁড়ি দিয়ে উঠতেন সাততলা ভবনের ছাদে। গোসল করে চারতলায় বাসায় ঢুকতেন। তারপর সন্তানরা আক্রান্ত হতে পারেন, এই বিবেচনায় বাসায় ফিরছেন না। হাসপাতালের পাশেই একটি হোটেলে থাকছেন। (দ্য ডেইলি স্টার, ৮ এপ্রিল ২০২০)।

ঘটনা দুই:

ছয় জন ডাক্তার সাময়িকভাবে বরখাস্ত। কারণ তারা কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। না জানিয়ে বা ছুটি না নিয়ে অনুপস্থিত থাকছেন। হাসপাতালে যাচ্ছেন না। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সেহাব উদ্দিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এই ছয়জন ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন ১১ এপ্রিল। সেদিনই সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ছয়জন ডাক্তারকে বরখাস্ত করেন। (প্রথম আলো, ১২ এপ্রিল ২০২০)।

ঘটনা তিন:

বরখাস্তকৃত ছয় ডাক্তারের একজন মুহাম্মদ ফজলুল হক। মেডিসিন বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক। কুর্মিটোলা হাসপাতাল থেকে তাকে এই হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। জানুয়ারি মাস থেকে তিনি কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা করছেন। তিনি বলেছেন, এপ্রিল থেকে নতুন রোস্টার হয়েছে। আমি সতর্কতার জন্যে উত্তরায় একটি হোটেলে উঠেছি কোয়ারেন্টিনের অংশ হিসেবে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সবই জানেন। এপ্রিলের ১৫ তারিখে আমার হাসপাতালে যোগদানের কথা। এর মধ্যেও আমি দু-একদিন পরপর হাসপাতালে যাই। গতকালও গিয়েছি। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা করব না, এমন কথা কখনও বলিনি। বাংলাদেশে প্রথম যে কোভিড-১৯ রোগী মারা গেছেন, তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়েছি আমি। চীন থেকে যারা সন্দেহভাজন এসেছেন তাদের গ্রহণ করেছি আমি। হাসপাতাল থেকে কোনো কিছু না জানিয়ে আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। (একাত্তর টেলিভিশন, ১১ এপ্রিল ২০২০)।

বরখাস্তকৃত ছয় জনের আরেকজন ডা. শারমিন হোসেন। তিনি বলেছেন, ১ এপ্রিল থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত টানা দায়িত্ব পালন করেছি। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা করেছি। লিখিত বা মৌখিক কোনোভাবে কারো কাছে বলিনি যে, কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা করব না। হাসপাতালে অনুপস্থিতও থাকিনি। অথচ আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। হাজিরা খাতার অনুলিপি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) বেলাল হোসেনের সঙ্গে দেখা করেছি। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি বলেছেন, ভুল হয়ে গেছে। (ফেসবুক লাইভ)।

ঘটনা চার:

দুই জন নার্সের কান্না, তারা খাবার পাচ্ছেন না। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে, বাজেট সংকট। রাত সাড়ে ১১টায় খাবার পেয়েছিলেন। পরদিন আর খাবার পাননি। নার্স ও মিডওয়াইফ মহাপরিদপ্তরের উপ-পরিচালক জাহানরা খাতুন বলেন, ‘হোটেল ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করেছি। বলেছে অনেক মেয়ে তো...ওখানে নাকি থাকারও সমস্যা হচ্ছে। এনিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে অলরেডি আমাদের কথা হচ্ছে, ডিজি স্যার জানিয়েছেন। এটা হোটেলেরও মিসম্যানেজমেন্ট। করোনার দিকে যারা থাকে তাদের দিকে দৃষ্টি নজর কম। রাতে পচা খাবার দেওয়া হয়েছিল। আমি ফোন করেছি। তারপর আলু, চাল কেনা হয়েছে। (একাত্তর টেলিভিশন, ১২ এপ্রিল ২০২০)।

এই সবকয়টি ঘটনা বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের। করোনা চিকিৎসার বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এখানকার ডাক্তাররা জীবনবাজি (ঘটনা এক) রেখে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা করছেন, এমন সংবাদ জানা যাচ্ছিল। এর মধ্যেই ছয় জন ডাক্তার বরখাস্তের ঘটনা অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিল।

১. সত্যি যদি ডাক্তাররা কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা করতে অনীহা প্রকাশ করে থাকেন, তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বা বরখাস্ত নিয়ে তেমন কিছু বলার থাকে না। দৃষ্টান্ত হিসেবেও দেখা যায় বিষয়টিকে। কিন্তু ছয় জনের মধ্যে দুই জন ডাক্তারের বক্তব্য গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে এল, তাতে দৃষ্টান্ত বলার সুযোগ থাকল না। তৈরি হলো অনেকগুলো প্রশ্ন। সামনে এল দায় চাপানোর সংস্কৃতি।

২. হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সেহাব উদ্দিন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযোগ ও বরখাস্তের তাৎপর্য বা বিশ্লেষণ কী? ডা. শারমিন হোসেন ৭ এপ্রিল পর্যন্ত হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করলেন, আর তত্ত্বাবধায়ক তার নামে ১০ বা ১১ এপ্রিল অভিযোগ করলেন যে তিনি হাসপাতালে অনুপস্থিত। তার মানে দাঁড়ায়, কোন ডাক্তার হাসপাতালে আসছেন কোন ডাক্তার আসছেন না, তত্ত্বাবধায়ক নিজে তা জানেন না। তত্ত্বাবধায়কের কাছে ডাক্তার নিজে বলেননি দায়িত্ব পালনে অনীহার কথা, লিখেও জানাননি। তাহলে তত্ত্বাবধায়ক জানলেন কীভাবে? কেউ তাকে বলেছেন, অভিযোগ করেছেন? হতে পারে। অভিযোগ যাচাই ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানোর কথা নয়। তিনি কীভাবে যাচাই করতে পারতেন? প্রথমত, ডাক্তারদের হাজিরা খাতা দেখতে পারতেন। দ্বিতীয়ত, অভিযুক্ত ডাক্তারদের কাছে টেলিফোনে জানতে চাইতে পারতেন। তৃতীয়ত, অন্য ডাক্তারদের থেকে জানতে পারতেন। সত্যতা পেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানোর আগে নিজে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে পারতেন। ঘটনাক্রম এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সহায়তা করছে যে, তিনি এসবের কোনোটিই অনুসরণ করেননি।

৩. হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সেহাব উদ্দিন অভিযোগ যেদিন জানালেন সেদিনই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চিকিৎসকদের সাময়িক বরখাস্ত করলেন। এত তড়িৎ ব্যবস্থা? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কি তথ্য যাচাইয়ের কোনো মেকানিজম নেই? প্রয়োজনও মনে করে না? তত্ত্বাবধায়ক বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে অভিযোগ করলেন কিনা, তা বিবেচনায় নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো কিছু যাচাই না করেই বরখাস্ত করা যায়? প্রথম আলোর প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসনে) বেলাল হোসেন বলেছেন, আজ সকালে শারমিন হোসেন তার সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি শারমিনকে তার বক্তব্য লিখিতভাবে স্বাস্থ্যসচিবকে জানাতে বলেছেন।

বুঝুন অবস্থা!

ডা. শারমিন বা ডাক্তার ফজলুল হকের বক্তব্য অনুযায়ী কোনো অন্যায় না করে, ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করার পরও তারা বরখাস্ত হলেন। সামাজিক-মানসিকভাবে নিপীড়িত হলেন। এখন আবার লিখিত বক্তব্য নিয়ে সচিবের কাছে যেতে হবে! তাদেরকেই প্রমাণ করতে হবে যে, তারা অন্যায় বা অপরাধ করেননি!

৪. হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এত তৎপর, তো নার্সরা খাদ্য সংকটে কেন? বাজেট সমস্যায় খাবার নেই কেন? পচা খাবার দেওয়ার অভিযোগ কেন আসছে?

৫. ডাক্তাররা দায়িত্ব পালন না করলে পুলিশ-সেনাবাহিনীকে জানান, এই নোটিশ ইস্যু করে সমালোচনার মুখে আবার প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন ক্ষিপ্রগতিতে ডাক্তার বরখাস্ত করা হলো। এতে ডাক্তারদের বিষয়ে প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবন করা যায়। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নজিরবিহীন হ-য-ব-র-ল অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তারা সম্ভবত ‘বাইপাস’ খুঁজছেন। দায়টা নিজেদের থেকে অন্য কোনোদিকে ঠেলে দিতে চাইছেন। এজন্যে বেছে নিয়েছেন ডাক্তারদের। কারণ এদেশে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বাজারে ছড়িয়ে দিলে, কোনো কিছু বিচার না করেই মানুষ সেটাকে লুফে নেয়। এবার করোনাভাইরাস ইস্যুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তারা সেই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

৬. একজন ডিসি যখন মাঝরাতে একজনকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পিটিয়ে আধমরা করেন, মাঝরাতে সম্পূর্ণ বেআইনি প্রক্রিয়ায় আদালত বসিয়ে দণ্ড দেন, তার বিরুদ্ধেও তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ক্লোজ বা বদলি ছাড়া একজন পুলিশের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, মানুষ পিটিয়ে হত্যার অভিযোগেও। সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ডাক্তাররা। ডাক্তারদের সমাজে খলনায়ক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। অথচ এই মহামারিকালে প্রকৃত নায়ক ডাক্তাররাই। ব্যতিক্রম আছে, তবে জীবনবাজি রেখে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন ডাক্তাররাই। তারাই আমাদের রক্ষাকর্তা। তাদের আস্থায় নেওয়া, শ্রদ্ধা-সম্মান করা এখন প্রতিটি মানুষের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। নিজেদের দায় ডাক্তারের ওপর চাপিয়ে দায়মুক্ত হওয়া যাবে না। করোনাভাইরাস প্রতিরোধের প্রস্তুতি পর্বের যে ব্যর্থতা, জোর করে দায় চাপানোর চেষ্টা করলে, ব্যর্থতার পাল্লা শুধু ভারি হবে। বাড়বে মানুষের বিপদ। এই বিপদ মানে প্রাণহানির বিপদ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের উপলব্ধিতে বিষয়টি আসা দরকার।

প্রত্যাশা রাখি, শুভবুদ্ধির উদয় হোক।

s.mortoza@gmail.com

আরও পড়ুন:

ডাক্তার বা করোনাভাইরাস কি বিরোধীদল?

গরিব পেটানোর মূলেও আইনের শাসনহীন বিচারহীনতা

১ শতাংশও নয়, ০.১৪ শতাংশের করোনা পরীক্ষা ও মীরজাদির তথ্য

মন ভালো করা ভুটানের চিকিৎসা ব্যবস্থা

ট্রাম্পের ৬ সপ্তাহের গাফিলতি, আমেরিকার অপূরণীয় ক্ষতি

Comments

The Daily Star  | English

People didn’t sacrifice lives just for election: Asif Mahmud

The adviser stresses the need for reforms for which people came out and ousted 'fascist' Awami League government

1h ago