মাজেদের আটক ও একটি ন্যারেটিভ ফিকশন
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি সম্পর্কে বলেছিলেন, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, আমরা চাই সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব। ঐতিহাসিকভাবেই প্রতিবেশী ভারতের বন্ধু বাংলাদেশ। আবেগী বাঙালির কাছে বন্ধু বলতে নিছক মিত্র নয়। মমতা, আনুগত্য, আস্থা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও গভীর বিশ্বাসের মিশ্রণই বন্ধুত্ব। এর সকল প্রমাণ বাংলাদেশ দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ সরকারের সব শাসনামলে। ভারত কতটুকু আস্থা, বিশ্বাস এবং ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছে এই প্রশ্ন থেকেছে সব সময়। অনেকে ভারত বিরোধিতা বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও প্রশ্নটার সুরাহা কোনো কালেই হয়নি।
স্বার্থের জায়গা থেকে চিন্তা করলে ভারত বাংলাদেশ থেকে কী নিয়েছে আর বিনিময়ে কী দিয়েছে সে আলোচনা অনেক হয়েছে। স্বল্প মাশুলে ট্রানজিট নিয়েছে। দেয়নি তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা। এছাড়া বাণিজ্য বৈষম্য কমাতে ভারতের অনীহা বা অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা আছে। বৃহৎ ও শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতি এখানকার দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফসল, অভিমত অনেকের। দুদেশের বড় বড় স্বার্থ এবং দেনা পাওনার বিষয় নিয়ে আলোচনা দীর্ঘ করতে চাই না। আবেগের জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামি খুনি আব্দুল মাজেদের ২৩ বছর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে থাকতে পারা এ আলোচনা উসকে দিয়েছে। অপরাধী প্রত্যর্পণ বা বন্দী বিনিময় চুক্তি থাকার পরও কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে খুনিকে খুঁজে বের করার জন্য ভারতকে চাপ প্রয়োগ করতে, বছরের পর বছর। ইন্টারপোলের মাধ্যমে পাওয়া নিশ্চিত তথ্যের পরও ভারত অস্বীকার করেছে বলে খবরও বেরিয়েছিল এখানকার সংবাদপত্রে।
খুনি আব্দুল মাজেদকে মঙ্গলবার বাংলাদেশের আদালতে নেওয়ার পর তার গ্রেপ্তারের বিস্তারিত খবর প্রকাশ পায়।
সরকারি কৌঁসুলি হেমায়েত উদ্দিন বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এত দিন আপনি কোথায় ছিলেন? জবাবে খুনি মাজেদ বলেন, ২২-২৩ বছর তিনি কলকাতায় অবস্থান করেন। সেখান থেকে চলতি বছরের মার্চের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। এরপর তিনি ঢাকায় অবস্থান করছিলেন।’
ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপপরিদর্শক (এসআই) আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘নিয়মিত টহলের অংশ হিসেবে তিনি দায়িত্বে ছিলেন। রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে দিয়ে সন্দেহজনকভাবে রিকশায় করে যাওয়ার সময় ওই ব্যক্তিকে থামান। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি অসংলগ্ন কথা বলতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি নিজের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করেন এবং বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। (প্রথম আলো)
খবরটি অত্যন্ত আনন্দের এবং নিঃসন্দেহে মুজিববর্ষে দেশবাসীর জন্য সেরা উপহার। এ উপহারটি হতে পারত ভারত সরকারের পক্ষ থেকে অথবা বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনগণের জন্য, যদি খুনি নিজে এসে ধরা না দিত। মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে বছরের পর বছর পালিয়ে থাকা একজন খুনি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সিল করা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ধরা দেওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। নিশ্চিত ফাঁসি জেনেও নিজে থেকে দেশে এসে সন্দেহজনক ঘোরাফেরা এবং পুলিশের হস্তগত হওয়ার ঘটনা জন্ম দিয়েছে কিছু প্রশ্নের। তার আগে আমি দুভাবে একটা ন্যারেটিভ ফিকশনের গল্প কল্পনা করতে চাই।
১. বাংলাদেশের নিয়মিত অনুরোধ ও সঠিক তথ্য প্রদানে ভারত সরকার খুনির পিছনে লাগিয়ে দেয় বুমকেশ বক্সীকে। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তায় বুমকেশের হাতে ধরা পড়ে মাজেদ। আগে থেকেই বুমকেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন বাংলাদেশের মাসুদ রানা। বুমকেশ খুনিকে ধরে ১৭ মার্চ বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে মাসুদ রানার কাছে হস্তান্তর করেন। মাসুদ রানা কিছুদিন তার আস্তানায় রেখে খুনিকে পুলিশের মাধ্যমে আদালতে পাঠান।
২. মাসুদ রানা আড়ি পাতেন ঢাকায় থাকা খুনির পরিবারের ফোনে। নিয়মিত ফোন কলের রেকর্ড থেকে জানতে পারেন খুনির বর্তমান অবস্থান কলকাতায়। তিনি সাহায্য চান বুমকেশ বক্সীর। বুমকেশ খুনির অবস্থান নিশ্চিত করলে মাসুদ রানা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাহায্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারত সরকারের সহযোগিতা চান। ১৬ মার্চ ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুনিকে গ্রেপ্তার করে ১৭ মার্চ বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে মাসুদ রানার হাতে তুলে দেয়। মাসুদ রানা ১৭ মার্চ খুনিকে পুলিশের মাধ্যমে আদালতে নিয়ে যান।
ফিকশনের সঙ্গে বাস্তবের মিল পাওয়া কঠিন। প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক যে, প্রথম গল্পের বাস্তব রূপদান কি ভারতের জন্য অসম্ভব ছিল? বন্ধুরাষ্ট্রকে মুজিববর্ষের সেরা উপহার দেওয়ার সুযোগ কেন হাতছাড়া করল ভারত? ভারত সরকার এ পথে হাঁটেনি কি অতীতে খুনির অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য অস্বীকারের কারণে? লেইট বেটার দ্যান নেভার, দেরিতে স্বীকার করলেও বাংলাদেশ কি অভিযোগ তুলত যে ভারত আমাদের জাতির পিতার খুনিকে ২৩ বছর লালন পালন করেছে? অবশ্যই না। বাংলাদেশের অল্প সংখ্যক মানুষ ভারত বিদ্বেষী হলেও বৃহৎ অংশ এবং বর্তমান সরকার আস্থা এবং বিশ্বাস রাখতে চায় বন্ধু রাষ্ট্রের উপর।
দ্বিতীয় গল্পটির বাস্তবায়নও অসম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে জাতিকে দেওয়া সেরা উপহার হতো। এটি ভারতের সাহায্য ছাড়া সম্ভব ছিল না। মাজেদের ভারতে অবস্থানের তথ্য অতীতে অস্বীকারের ফলে একটু অস্বস্তির বিষয় হয়ত ছিল ভারতের জন্য। ভারত কি ভেবেছিল অপরাধী প্রত্যর্পণ চুক্তির মাধ্যমে খুনিকে হস্তান্তর করলে প্রচুর নথিপত্রে মাজেদের ২৩ বছর ভারতে অবস্থানের প্রমাণ চলে আসবে বাংলাদেশের হাতে?
যেহেতু দুটি গল্পের সঙ্গে মাজেদের ধরা পড়ার ঘটনার কোন মিল নেই সেহেতু এই উপহার কারো পক্ষ থেকেই দেওয়া হয়নি। বলা যায়, নোবডি এরেস্টেড মাজেদ। তাকে দৈত্য এনে গাবতলিতে ফেলে গেছে।
লেখাটি শেষ করার আগে একটু পিছনে যেতে চাই। ২০১১ সালে ভারতের সঙ্গে অপরাধী প্রত্যর্পণ বা বন্দী বিনিময় চুক্তি ছিল না বাংলাদেশের। তবুও বাংলাদেশ রাজি হয়েছিল আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তর করতে। ১৯৯৭ সালে অনুপ চেটিয়াকে ঢাকায় আটকের পর অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ, বিদেশি মুদ্রা এবং স্যাটেলাইট ফোন রাখা সংক্রান্ত মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এ মামলায় তার সাত বছরের সাজা শেষ হলে বন্দি বিনিময় চুক্তি না থাকা ও আইনগত আরও কিছু জটিলতার কারণে তখন বাংলাদেশ তাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করতে পারেনি। ২০১৩ সালে দু দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময় চুক্তির পর সব আইনগত বাধা দুর করে ২০১৫ সালে ভারতের কাছে অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তর করা হয় গোপনে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়ার শুরুতেই আব্দুল মাজেদ ভারতে পালিয়ে যায়। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ভারত, থাইল্যান্ড,আমেরিকা, কানাডাসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে অপরাধী প্রত্যর্পণ চুক্তির চেষ্টা চালান পালিয়ে থাকা সকল খুনিদের ফিরিয়ে আনতে। থাইল্যান্ড খুব দ্রুত সাড়া দেয় এবং বজলুল হুদাকে হস্তান্তর করে। ব্যাংককের একটি দোকানে চুরি করতে গিয়ে আটক হয়েছিল খুনি বজলুল হুদা। পরবর্তীতে আমেরিকা হস্তান্তর করে পলাতক আরেক খুনি মহিউদ্দিন আহমেদকে। এখনো পলাতক আছে পাঁচ জন। খন্দকার আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, এম রাশেদ চৌধুরী ও মোসলেম উদ্দিন৷
মুজিববর্ষে সবগুলো পলাতক খুনিকে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির মঞ্চে তুলতে পারলে জনগণের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার হতে পারে সরকারের পক্ষ থেকে। আমরা কি তা দেখতে পাব সহসা?
জসিম আহমেদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments