করোনা আলো ফেললো কলসের ফুটায়

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় ঘরে থাকা, একা থাকা ও অন্যের থেকে প্রয়োজনীয় দুরত্ব বজায় রাখা। তাই করছি মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে। প্রাণঘাতী ভাইরাসের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কিত সংবাদ আর সিনেমা দেখেই সময় কাটছে। গভীর রাতে ইয়োরগোস লানথিমোসের দ্য  কিলিং অফ এ সেকরেড ডিয়ার সিনেমাটি আবারও দেখছিলাম।

ছবিটি আমি প্রথমবার দেখি বিশ্বখ্যাত গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে, কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭০তম আসরে। কার্ডিয়াক সার্জনের অবহেলায় অপারেশন থিয়েটারে এক রোগীর মৃত্যুর পর প্রতিশোধে মরিয়া মৃত ব্যক্তির কিশোর ছেলে ডাক্তারের হাত দিয়েই তার সন্তানকে খুন করতে বাধ্য করার গল্প বলা হয়েছে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ধারার এ ছবিতে।

হঠাৎ করে বুকে ব্যথা অনুভব হচ্ছিলো। বুঝতে পারছি, সাধারণ গ্যাস্টিকের ব্যথা। তবুও কেমন জানি অজানা আশংকায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ভাবছিলাম যদি এই সময়ে হার্ট অ্যাটাক হয়, নিশ্চিত বিনা চিকিৎসায় মারা যাবো। সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে ভর্তির উপায় নেই। গত কয়েকদিনে মারা যাওয়া আরও অনেক রোগীর মতো ঘুরতে হবে এই হাসপাতাল থেকে ঐ হাসপাতালে। মন্ত্রী- এমপি ধরে তদবির করে করোনাভাইরাস নেই মর্মে আইইডিসিআরের সনদ আসার আগেই শেষ হবে জীবন। কারণ আমারও হাঁচি-কাশি দুটোই আছে, যা করোনা সংক্রমিত হওয়ার অন্যতম উপসর্গ।

সাধারণ মানুষের অভিযোগ, শকুন যেমন গরুর মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মালিকরাও তেমনি রোগীর জন্য ওৎ পেতে থাকেন। শয্যা সংখ্যার শতকরা বিশ ভাগের উপরে খালি থাকলেই নাকি তাদের হৃদকম্পন বাড়ে, সঙ্গে যোগ হয় উচ্চ রক্তচাপ। বিশেষ করে আইসিইউ আর সিসিইউয়ের বিছানা খালি হলে কর্মকর্তা ও ডাক্তারদের উপর চাপ প্রয়োগ করেন তারা। মস্তিস্কে  রক্তক্ষরণ বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ বা চরম জটিলতার প্রয়োজন হয় না। ফলে গ্যাস্টিক, কোমর ব্যথা অথবা অন্য যে কোনো উপসর্গ নিয়ে কেউ ইমার্জেন্সিতে গেলেই সরাসরি রোগীকে পাঠানো হয় আইসিইউ বা সিসিইউ এর ব্যয়বহুল বেডে, অকারণে।

অনেককে বলতে শুনি, ভ্যানটিলেশন সুবিধা থাকুক বা না থাকুক, পুরো মাসের যাবতীয় খরচ নির্বাহ হয় বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ আর সিসিইউয়ের আয় থেকে। যেহেতু বেসরকারি হাসপাতালগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, সেহেতু বিষযটিকে রোগী বা তার স্বজনরা মেনে নেন উপায়ন্তর না দেখে।

মাত্র কিছুদিন আগেও এতো আতংকের কারণ ছিল না। করোনা নামক দুনিয়া কাঁপানো ভাইরাস বাংলাদেশে ছোবল দেওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। লোক মুখে শুনি, মালিকদের দেওয়া মুনাফার টার্গেটকে থোড়াই কেয়ার করছেন এখন বেসরকারি হাসপতালের ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। করোনা আতংকে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা সুরক্ষা সরঞ্জাম বা  পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) না থাকায়।

দেশের সরকারি হাসপাতালের মতো বেহাল অবস্থা কেনো বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্য সেবায়, আমার মাথায় আসে না। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে কোনো পরিস্থিতিতে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া এবং গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতে কেনো তাদের প্রস্তুতি নেই? সেবার চিন্তা বাদ দিলেও ব্যবসার স্বার্থে নতুন চ্যালেঞ্জ তারা নিতে চাননি। যথেষ্ট সময় পেয়েও পরিস্থিতি বিবেচনায় করেননি নতুন বিনিয়োগ। যাতে অন্যান্য সাধারণ রোগীর চিকিত্সা সেবা তারা দিয়ে যেতে পারেন সংশ্লিষ্টদের সংক্রমণ থেকে দূরে রেখে। তবে তারাও কি চেয়েছিলেন সরকার তাদের ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করুক, বিনামুল্যে? কেন?

করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেরই স্বাস্থ্যসেবা খাতের দুর্বল দিক বেরিয়ে আসছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা নামের বিশাল কলসের ফুটা এখন খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে— সরকার কি তা এখনো দেখতে পাচ্ছে না? ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদন আলো ফেলেছে সেখানে। তুলে ধরেছে ভয়াবহ চিত্র।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য মাত্র ১০টি আইসিইউ বেড আছে। আরও ১৬টি বেড প্রস্তুতের কাজ চলছে। সরকারি হাসপাতালে ৫০৮টি আইসিইউ বেড এবং বেসরকারি হাসপাতালে ৭৩৭টি আইসিইউ বেড যোগ করলে সারাদেশে মোট আইসিইউ বেডের সংখ্যা ১,২৪৫ টি যা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা প্রবীণদের চিকিৎসায় উদ্বেগের কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ। তাদের মধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষের বয়স ৬০ বছরের বেশি। আরেকটি পত্রিকার প্রতিবেদন বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকার বাইরের কোনো হাসপাতালেই কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্র বা ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা নেই।

এ পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ৪৮ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর। সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা তারা পেয়েছেন মোট ১,০৬৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে। সে হিসাবে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা  শতকরা  ৪ দশমিক ৪৯ শতাংশের কাছে। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৫ জন যা শতকরা ১০ দশমিক ৪১ শতাংশের একটু বেশি। যদিও হটলাইনে করোনা সংক্রান্ত ফোন এসেছে ৮২ হাজারের বেশি।

আইইডিসিআরও বলছে, সীমিত আকারে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে।

গত ২৩ মার্চ বিকাল থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক মানুষ রাজধানী ছেড়ে ট্রেনে-বাসে গাদাগাদি করে ঢাকা ছেড়েছেন। তাদের কতো শতাংশের মধ্যে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে তা অজানা রয়ে গেছে। ঢাকার বাইরে এখনো টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। আগামী ৪ এপ্রিল ছুটি শেষ হওয়ার প্রাক্কালে আবারও তাদের আসতে হবে গাদাগাদি করে। সেটি বিবেচনায় নিলে এপ্রিলের প্রথম থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হবে ছুটি ও লকডাউনের সময়সীমা বাড়ানো না হলে। ফলে সামনের দিনগুলোতে ব্যাপক কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশবাসীর মধ্যে।

দেশে গণজমায়েত এখনো বন্ধ করা যায়নি। কার্যকর ব্যবস্থাও দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় বর্তমান হারেও সংক্রমণ পাওয়া গেলে সারাদেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা কত হবে, ভাবতেই গা শিউরে উঠে। আক্রান্ত দেশগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায় ‘কোভিড-১৯’ এ আক্রান্তের হার কিভাবে লাফিয়ে বাড়ে, তেমনি মৃত্যু হারও।

কেবল বয়স্ক মানুষজনের মধ্যে ২ শতাংশ আক্রান্ত হলে সংখ্যাটা কতো দাড়ায়? ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষের আইসিইউ সাপোর্টতো দূরের কথা, এ সংখ্যক সাধারণ বেডও কি আছে দেশের সব হাসপাতাল মিলিয়ে? এ অবস্থায় মানুষের চলাচলকে শূন্যের কোঠায়  নিয়ে আসা, শত ভাগ কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা আর সম্ভাব্য সবার টেস্ট নিশ্চিত করে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে নেওয়া না গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। যেমনটি হয়েছে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন ও আমেরিকায়।

আবার চীন, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইয়ান, সিঙ্গাপুরের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এখানে যত বিলম্ব হবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়বে জ্যামিতিক হারে।

জসিম আহমেদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা

jahmed@glbangladesh.com

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Firefighter dies after being hit by truck while battling Secretariat fire

Another firefighter sustained injuries in his leg while working to extinguish the fire

39m ago