করোনাভাইরাস

বাংলাদেশ কি পারবে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামাল দিতে?

তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইর সভাপতি রুবানা হকের একটা ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে তিনি করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিপর্যস্ত পোশাক রপ্তানি খাতের উল্লেখ করতে গিয়ে যে তথ্য দিয়েছেন তা হচ্ছে, গত কয়েকদিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রেতারা এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১০৮৯টি কারখানার ৮৭ কোটি ৩২ লাখ ৩৬ হাজার ৬২২টি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে যার অর্থমূল্য ১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ছবি: স্টার ফাইল ফটো

তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইর সভাপতি রুবানা হকের একটা ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে তিনি করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিপর্যস্ত পোশাক রপ্তানি খাতের উল্লেখ করতে গিয়ে যে তথ্য দিয়েছেন তা হচ্ছে, গত কয়েকদিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রেতারা এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১০৮৯টি কারখানার ৮৭ কোটি ৩২ লাখ ৩৬ হাজার ৬২২টি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে যার অর্থমূল্য ১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

এই কারখানাগুলোতে কর্মরত ১২ লাখেরও বেশি শ্রমিকের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বিষয়টিকে ভয়াবহ বলছেন। এই সংবাদটি তিনি দিয়েছেন তাদের সংগঠনের ওয়েবসাইটে দেওয়া সদস্য কারখানার সরবরাহ করা তথ্য থেকে।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের আরেকটি সংগঠন বিকেএমইএর সদস্যরা কেমন আছেন প্রকাশ্যে না বললেও তারাও যে অনিশ্চিত, অন্ধকার ভবিষ্যতের শঙ্কায় পড়েছেন তা নিশ্চিত করে বলা যায়।

এই ভিডিওটি দেখেছি গতকাল। কিন্তু এমনটি ধারণা করছিলাম কয়েকদিন আগে থেকেই। আজ যখন লেখাটি লিখছি তখনো হয়তো আরও অনেক কারখানা নতুন করে ক্রয়াদেশ বাতিলের দুঃসংবাদ পাচ্ছে এবং পাবে। আগামী দিনগুলো শুধু দুঃসংবাদই তাদের পিছু হাঁটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেননা, বিশ্বে করোনা পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।

রপ্তানি সংশ্লিষ্ট ছাড়াও অনেকে জেনে থাকবেন তৈরি পোশাকের চলতি যেসব ক্রয়াদেশের বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছিলো তার সিংহভাগই এসেছে নভেম্বর- ডিসেম্বর ২০১৯ বা এ বছরের জানুয়ারিতে যার জাহাজীকরণ হওয়ার কথা এ বছরের মার্চ, এপ্রিল বা মে মাসের মধ্যে। মার্চ-এপ্রিল ডেলিভারির পণ্য এখন প্রস্তুত বা ফিনিশিং পর্যায়ে আছে। আর মে ডেলিভারির সমস্ত কাঁচামাল প্রস্তুতকারী কারখানার গুদামে সংরক্ষিত থাকার কথা।

সাধারণত তৈরি পোশাকের কাঁচামাল দেশ-বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় যার মূল্য এফওবির ৭০ ভাগ। এ ক্ষেত্রে বাতিল হয়ে যাওয়া ১ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ক্রয়াদেশের বিপরীতে কারখানাগুলো ১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল আমদানি করেছে ব্যাক টু ব্যাক এলসি অথবা টিটির মাধ্যমে যা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক পরিশোধ করেছে বা করতে বাধ্য গ্রাহকের হিসেবে ঋণ তৈরি করে। এই ঋণ কারখানাগুলোর পরিশোধ বা সমন্বয় করার কথা রপ্তানি আয় থেকে।

ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ায় নিজস্ব সম্পদ থেকে এই ঋণ পরিশোধ করা প্রায় অসম্ভব। আয় না থাকলে লাখ-লাখ শ্রমিকের বেতনই তারা দেবেন কোথা থেকে। এ অবস্থায় দেউলিয়া হয়ে অনেককেই হয়তো ব্যবসা ছেড়ে দিতে হতে হবে। খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ ব্যাংগুলোতে বাড়বে আরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ।

উল্লেখিত তথ্য বিশ্লেষণ করলে ধারণা করা যায় দেশে করোনাভাইরাস ছড়ানোর প্রাথমিক পর্যায়ে কেবল একটি খাত (ওভেন গার্মেন্টস) কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে এবং সবগুলো খাত নিয়ে বিশ্লেষণ করলে কী ভয়ঙ্কর চিত্র উঠে আসবে আমাদের সামনে, তা কল্পনা করাও যাচ্ছে না।

প্রশ্নটা এখনি প্রাসঙ্গিক যে, এই মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশ কি পারবে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামাল দিতে বা এই ক্ষমতা কি বাংলাদেশের আছে?

তথ্য গোপন ও চাপাবাজির এই দেশে জনগণ আসলে জানে না প্রকৃত চিত্র কী? সরকার বলছে, এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে পরিস্থিতি। যদিও মানুষ তা বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। বিশ্বাস না করার যথেষ্ট যুক্তি আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার পর আমরা প্রায় ৩ মাস পেয়েছিলাম প্রস্তুতি নেওয়ার। সেই প্রস্তুতি নিতে সরকার ব্যর্থ হওয়ায় চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) সংগ্রহ ও সরবরাহ করতে সরকারকে নির্দেশ দিতে হয়েছে হাইকোর্টকে।

চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা ও টেস্টিং কিট না থাকার ফলে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভাইরাসটি আসলে কত সংখ্যক মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে তাও জানা যাচ্ছে না। সরকারকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছিল আগে থেকেই।

উদাহরণ হিসেবে চীনের কথা বলা হচ্ছে, কমিউনিস্ট শাসিত চীন সরকার জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলেই তারা সফল হয়েছে। ইউরোপ আমেরিকার ঠিক তার বিপরীত বলে তারা করোনার ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে।

এরই মধ্যে অনেক দেশ করোনা মোকাবিলায় কারফিউ জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ এখানে সবকিছুতেই বিলম্বিত সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণযোগ্য অবস্থায় কঠোর হলে স্বল্প সময়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব। এক দেড় মাসের লকডাউনের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সম্ভাব্য ক্ষতি হয়তো দীর্ঘ সময়ে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। না হয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনে বাধ্য করবে ও অচলাবস্থা তৈরি করবে। এতে জানমালের যে সীমাহীন ও ভয়াবহ ক্ষতি হবে তা সামলে উঠা কি সম্ভব দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামোর একটা দেশের পক্ষে সম্ভব?

শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ চীন দুই মাসের লকডাউনের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সব পর্যায়ের ব্যবসায়ী ও জনগণকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সহায়তা দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশও হয়তো তেমনি সক্ষম। বাংলাদেশে সে আশা কি করা যায় যেখানে সরকারই চলে ঋণের টাকায় আর ঋণের মুনাফা শোধ করে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে পুনরায় ঋণ নিয়ে?

জসিম আহমেদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা

jahmed@glbangladesh.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Bangladeshi-Americans eager to help build new Bangladesh

July uprising and some thoughts of Bangladeshi-Americans

NRBs gathered in New Jersey showed eagerness to assist in the journey of the new Bangladesh forward.

5h ago