এখনই কিছু করেন, নয়তো সবাই মিলে মরেন
আমাদের কৈশোরে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাসির গল্পগুলো ছিল খুবই জনপ্রিয়। সেই গল্পের একটি হলো, ভানুর বাসায় চোর এসে চুরি করে নিয়ে গেছে। ভানু অভিযোগ জানাতে পুলিশের কাছে গেল। পুলিশ চুরির ঘটনা জানতে চাইল যে কীভাবে চুরি হলো। ভানু জানাল, চোর জানালার গ্রিল কেটে তার ঘরে প্রবেশ করল।
পুলিশ বলল, ‘আপনি কি টের পেয়েছিলেন?’ ‘হ টের পাইছিলাম।’ ‘তাহলে আপনি জাগলেন না কেন? ভানু: ‘আমিতো ভাবতাছি দেখিনা কী করে?’ ‘তারপর?’, পুলিশ বলল। ‘হেরপর চোর আমার ট্রাংক খুইলা দ্যাখতে থাকলো।’ ‘তখনো আপনি চুপ করেই থাকলেন?’, পুলিশ বলল। ‘হ আমিতো দেখতাছি ব্যাটা করেটা কী?’ পুলিশ চোখ কপালে তুলে জানতে চাইল, ‘আপনি তখনো কিছু বললেন না?’ ভানু: ‘না কই নাই। আমিতো দেখতাছি আর ভাবতাছি দেখিনা কী করে?’ পুলিশ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘তারপর?’ ‘তারপরতো চোর সবকিছু বাইন্ধা ঘরের দরজা খুইলা বাইর হইয়া গেল’, ভানু বলল। এইবার পুলিশ ক্রোধে ফেটে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘চোর সবকিছু নিয়ে চলে যাচ্ছে, তাও আপনি তাকে ধরলেন না?’ ভানু তার ফিচেল হাসি দিয়ে বলল, ‘আমিতো তখনো ভাবতাছি, দেখিনা কী করে?’ পুলিশ মহাবিরক্ত হয়ে বলল, ‘আপনিতো আজব মানুষ মশাই। চোর আপনার সবকিছু চুরি করে নিয়ে গেল। আপনি জেগে জেগে তা দেখছেন আর ভেবেই চলেছেন?’ ভানুও এবার ক্ষেপে গিয়ে বলল, ‘হ ভাবতাছি। চোরে আমার জিনিস নিয়া চইলা যাইতেছে, তাইলে আমি ভাববো না তো কি আপনি ভাববেন?’
আমরাও ঠিক ভানুর মত ভাবছি তো ভাবছিই। ভাবনার শেষ যখন হবে, ততদিনে হয়ত যা ক্ষতি হওয়ার হয়েই যাবে। বিশ্বের মহামারি প্রসঙ্গটিকে উপেক্ষা করে আমরাও ভানুর মত ভাবছি দেখিনা কী হয়। মহামারি শুধু একটি চিকিৎসার বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িত রাষ্ট্রের ক্ষমতা, প্রশাসনিক দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা, পরিসংখ্যান এবং সঠিক তথ্য। আমরা প্রতিদিন যে তথ্য পাচ্ছি, অধিকাংশ মানুষের এর ওপর ভরসা নাই। আর ভরসা নাই বলেই লোকে করোনার ভয়াবহ চিত্রটি বুঝতে পারছে না। মনে করছে সাধারণ ভাইরাস। যদি কঠিন বা ভয়াবহ কিছু হত, তাহলে প্রশাসন এরকম নির্লিপ্ত থাকতে পারত না।
পৃথিবীর যতগুলো দেশে কোভিড-১৯ ছড়িয়েছে তারা সবাই তাদের সংক্রমণ তথ্য শেয়ার করেছে। সিঙ্গাপুর প্রতিটি আক্রান্ত ব্যক্তির ট্রেসিবিলিটি ম্যাপ তৈরি করেছে। চীনের উহান এবং অন্য কয়েকটি দেশের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, মোটামুটিভাবে সংক্রমণ থেকে মৃত্যু ঘটতে ২০-২৫ দিন সময় অতিবাহিত হয় এবং গড়ে প্রতি ৫ দিনে সংক্রমণ দ্বিগুণ হয়।
ইতালিতে ভিজিটিং চাইনিজ করোনা বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান, এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান, রেডক্রস সোসাইটি অব চায়না, শিন সুও পেং বললেন, ‘কিন্তু এখন আমি খুঁজে পেয়েছি ও আবিষ্কার করছি অনেক সমস্যা। এইমাত্র আমরা আসলাম (ইতালির) কর্ডোবা শহর থেকে, আমার মনে হচ্ছে এই মিলান শহরে, যে শহরটাতে কোভিড-১৯ সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে, এখানে খুবই দুর্বল অবরুদ্ধকরণ (লকডাউন) চলছে। কারণ গণপরিবহনগুলো এখনও চলছে, মানুষের চলাফেরা অব্যাহত আছে। হোটেলগুলোতে জনসমাগম আছে। আমি দেখেছি অনেকেই মাস্ক পরে নেই। আমি জানি না আপনারা কী ভাবছেন?’
‘ঠিক এই এখনই আমাদের সময়কে থামিয়ে দিতে হবে (স্টপ দ্য টাইম)। সব ধরণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। সকল ধরণের সামাজিক যোগাযোগ একেবারে বন্ধ করতে হবে, যেগুলো আমরা স্বাভাবিক সময় পছন্দ করি। সকল মানুষকে কোয়ারেন্টিনের জন্য বাড়িতে থাকতে হবে এবং প্রত্যেককে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিতে হবে মানুষের জীবন রক্ষার জন্য। এই মুহূর্তে মানুষের জীবন রক্ষাই সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজ। উহানে আমরা হাসপাতালের সমস্যায় পড়েছিলাম সব আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে, কিন্তু উহান সম্পূর্ণ অবরুদ্ধকরণ (লকডাউন) করা হয়েছিল তার এক মাস আগে।’ (বেসরকারি সংস্থা ডি. নেট’র কর্ণধার সিরাজুল হোসেনের ফেসবুক স্ট্যাটাস)
আমাদের দেশের অনেক মানুষ নিরক্ষর, অনেকেই অল্প পড়াশোনা জানা। আবার ওভার কনফিডেন্ট লোকেরও অভাব নেই। যে দেশে মানুষের সচেতনতার লেভেল কম, সেখানে প্রচার-প্রচারণা বেশি লাগে। আর সরকারের বিভিন্ন সূত্র থেকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে যা বলা হচ্ছে, তা খুবই অকিঞ্চিৎকর গুরুত্ব বহন করছে মানুষের মনে। আর তাই বিশ্বের সব দেশে, এমনকি মক্কা-মদিনাতেও জুমার নামাজ আপাতত বন্ধ রাখলেও, আমরা কোনভাবেই এটা বন্ধের পক্ষে নই। কারো সাহস নাই জুমা বা ওয়াজ বন্ধের নির্দেশ দেয়। তাই লক্ষীপুরে হুজুরের মাইকে পানিপড়া নেওয়ার জন্য অর্ধলক্ষ লোক হাজির হয়েছিল, যা পুরো বিশ্বের লোক হা করে দেখেছে এবং অবাক হয়েছে।
কুসংস্কার এবং অতি উৎসাহ আমাদের দেশের লোকের বৈশিষ্ট্য। এর প্রমাণ বরিশালে দলে দলে লোকজন ছুটেছে দুটি থানকুনি পাতার রস পান করতে। কে নাকি বলেছে করোনা প্রতিরোধে এটা অব্যর্থ। ইতোমধ্যে গাছের নীচে কাপড় বিছিয়ে বসে গেছে একদল ভণ্ড প্রতারক। যারা করোনার কবিরাজি ওষুধ বিক্রি করছে। মানুষ এই ভাইরাসের গুরুত্ব বুঝতে পারছে না বলেই কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষকে দেখতে শত শত মানুষ ভিড় করছে। কোয়ারেন্টিনে থাকা মানে যে কী, এটাই বুঝতে পারছে না।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যে রোগীটি ডেল্টা হাসপাতালে মারা গেলেন, তথ্য গোপন করে তিনি এর আগে নগরীর তিন হাসপাতাল ঘুরে এসেছেন। রোগীর পরিবার তার মৃত্যুর পর উধাও হয়ে গেছে। মৃতের বাড়ি লকডাউন, হাসপাতালের আইসিইউ ও রোগীর রুম লকডাউন করে সেখানকার চার চিকিৎসককে কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়েছে। বাকি হাসপাতালগুলোর অবস্থা ভাবুন।
এখন সেই মৃতের বাড়ির সামনে শত শত লোক এসে ভিড় করেছেন। তিনি কীভাবে, কোন বাসায় থাকতেন এসব জানার কৌতূহল। এই মানুষগুলোকে রোধে কার সাধ্যি? এদিকে ইতালিফেরত বাঁশখালির এক যুবক নাকি ৯ দিন বান্দরবানে লুকিয়ে ছিল। পুলিশ খবর পেয়ে তাকে কোয়ারেন্টিনে নিয়ে আসে।
চীন আক্রান্ত হওয়ার পর আমরা তিন মাস সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু কী করেছি আমরা? কিছু না। কারণ আমরা রোগটাকে গুরুত্ব দেইনি। এই যে এখন আমরা প্রবেশ করেছি স্প্রেডিং টাইমে। এখন শহর থেকে জেলা, জেলা থেকে গ্রামে ছড়াবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন যে, ‘মানুষগুলো হোম কোয়ারেন্টিনে গিয়েছেন, তারা কিন্তু আসলে কোয়ারেন্টিনে থাকছেন না। এরাই ভাইরাসটা ছড়াবে। ভাইরোলজির ভাষায় একে পিক টাইম বলে।’
সবেমাত্র হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছেন যে, বিদেশ থেকে আসা সকল যাত্রীকে অবশ্যই কোয়ারেন্টিনে যেতে হবে। হাইকোর্ট বলেছেন যে, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ অবশ্যই একজন যাত্রীকে আইনরক্ষাকারী সদস্যদের হাতে তুলে দেবেন। তারাই যাত্রীদেরকে নিয়ে নির্ধারিত হাসপাতাল বা কোয়ারেন্টিন সেন্টারে নিয়ে যাবেন। কিন্তু আদালতের সেই আদেশকে তোয়াক্কা না করে গত ২৪ ঘণ্টায় আসা ২ হাজার ৩৭১ জন যাত্রীকে হাতে ‘প্রাউড টু প্রটেক্ট বাংলাদেশ: হোম কোয়ারেন্টিন’ সিল মেরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এরইমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এক ব্যক্তি মারা গেছেন, নাকি অন্য কারণে- এ নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে সংঘর্ষের ঘটনায় রাজবাড়িতে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ১১ জন। বিষয়টা নিছক মুরগি নিয়ে মারামারির জেরের মত।
অন্যদিকে জাতীয় পর্যায়ের একটি পত্রিকায় দেখলাম ফিচার করেছে ‘করোনার ঝুঁকি এড়াতে যেভাবে মেকআপ করবেন’! তাহলে বোঝাই যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী ছড়ানো এই মহামারিকে আমরা কতটা হালকাভাবে গ্রহণ করেছি। এরকম একটা পরিত্রাহি অবস্থার মধ্যেও ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন সরকারি নির্দেশ আমলে না নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিলেন ৩০০ লোককে দাওয়াত দিয়ে। এরকম একটি ঘটনা কেবলমাত্র এদেশেই সম্ভব।
আমাদের দেশে চিকিৎসকদের অবস্থা হবে সবচেয়ে ভয়াবহ। কারণ সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মত সরকারি হাসপাতালেও নোটিশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, হাসপাতাল এত মাস্ক সরবরাহ করতে পারবে না, সবাইকে নিজ নিজ মাস্ক যোগাড় করে নিতে হবে। এর মানে হচ্ছে, করোনার ভয়াবহতা ঠেকানোর জন্য যারা কাজ করবেন, তাদের জন্য সরকার কিছু করতে প্রস্তুত নয়। আমরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে আতশবাজি পুড়াতে পারি, আলোকসজ্জা করতে পারলেও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য সুরক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা করতে পারিনি। ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ বা পিপিই জীবাণুর সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ মানুষ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দেয়। এসব উপকরণের মধ্যে রয়েছে প্রতিরোধমূলক পোশাক, হেলমেট, মাস্ক, বিশেষ ধরণের চশমা এবং আরো কিছু উপকরণ। আমাদের চিকিৎসকরা ইতোমধ্যেই নিজেদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে আশংকা প্রকাশ করছেন।
ইতালি যদি তাদের সংকট মোকাবিলায় চীনের কাছ থেকে সহযোগিতা নিতে পারে, তবে আমরা কেন চুপ করে আছি? এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা পরিস্থিতিকে বেসামাল করে তুলছে। এ কথা স্পষ্ট করে সরকারকে বুঝতে হবে, এ দেশের মানুষকে এইসব সেলফ কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন টাইপ কথা বলে আটকানো যাবে না। এরা নিয়ম মানবে না, এরা সবাই বুঝেও না। তাই যত দ্রুত সম্ভব জরুরি অবস্থা, কারফিউ, ১৪৪ ধারা যা খুশি দিয়ে লকডাউন করুন আমাদের এবং তা এখুনি।
মানুষ ভাবতেই পারে না এতই যদি মারাত্মক ছোঁয়াচে ভাইরাস হয়, তাহলে এরইমধ্যে ঢাকায় ভোট হয় কীভাবে? যেখানে সবাইকে ঘরে বা একা থাকার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে স্যানিটাইজার দিয়ে একটি এতবড় নির্বাচন করা হলো কেন?
সচেতন মানুষ মনে করছেন, সরকার তথ্য গোপন করে গুজব সৃষ্টিতে সহায়তা করছেন। অনেকেই সরকারের দেওয়া তথ্য বিশ্বাস করছেন না, আর তাই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর মানুষ যখন যেকোনো ইস্যুতে বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্বাস করতে শুরু করে, তখন সেই ভুল বা অসত্য তথ্য প্রচারের বড় ভার সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে।
৫৫ দিনে ফিরেছেন ৬ লাখ ২৪ হাজার মানুষ। এই সোয়া ছয় লাখ মানুষ এখন কোথায়? কজনের পরীক্ষা হয়েছে? কজন সত্যিকারভাবে কোয়ারেন্টিনে আছেন? চৌকস সরকার শুনলাম কেবল সিল বানানোর দরপত্র খুলছে (তাও ভারতের অনুকরণে, যারা এটা অনেক আগেই করেছে)।
‘ইউরোপে করোনাভাইরাস মহামারি দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির গুরুতর লক্ষণ দেখা না গেলেও সংক্রমিত ব্যক্তিরা এটি সহজেই ছড়াতে পারে। করোনাভাইরাসের প্রথম উপসর্গ টের পেতে ৫ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। তাই যাদের করোনাভাইরাস একেবারে প্রাথমিক ধাপে, তাদেরও কোনো জনসমাগম স্থলে যাওয়া উচিত নয়। এতে তারা অন্যদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেন।’ (প্রথম আলো, ২০ মার্চ ২০২০)
অনেকেই বলছেন চীন থেকে দ্রুত সাহায্য নিতে, নতুবা গোমূত্র নিয়ে যদি বন্ধুরাষ্ট্র চলে আসে, তখন আমাদের কী হবে উপায়?
শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগকর্মী
Comments