মামলা-পেটানো-জেল-নিখোঁজ, সাংবাদিক নিপীড়নের সকল ধারা সচল
কোন ঘটনাটি লিখব? একটির পর একটি সামনে আসছে।
ভাবছিলাম মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলা নিয়ে লিখব। ৩২ জনের একজন শফিকুল ইসলাম কাজল মামলার পর থেকে নিখোঁজ। তাকে নিয়েও লেখার তাড়না অনুভব করছিলাম। মধ্যরাত, ভাবতে ভাবতে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি। এমন সময় খবর পেলাম বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিকে মাঝরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। সকালে জানলাম ভ্রাম্যমাণ আদালত এক বছরের জেল দিয়ে সাংবাদিককে কারাগারে পাঠিয়েছে। বিকালে সংবাদ এলো পটুয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেতা দুজন সাংবাদিককে সুযোগ মতো পেটানোর নির্দেশ দিয়েছেন নেতাকর্মীদের।
ইদানীং সাংবাদিক নিপীড়ন-নির্যাতনের সংবাদে খুব একটা বিচলিত হই না। মনে হয় আমরা সাংবাদিকরা বিষয়টিকে অনিবার্য করে তুলেছি। এমনভাবে দলান্ধ হয়ে গেছি, সত্য দেখি না-বুঝি না বা দেখতে-বুঝতে চাই না। ফলে ক্ষমতাবানরা নিশ্চিত হয়ে গেছেন যে, সাংবাদিকদের নিপীড়ন-নির্যাতন করলে তাদের কিছু হবে না। কেন কিছু হবে না, সেই আলোচনায় আসার আগে ঘটনাগুলোর দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।
১. মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী এদেশের খুবই পরিচিত সাংবাদিক-সম্পাদক। মাঠ পর্যায়ের রিপোর্টার থেকে যোগ্যতা প্রমাণ করে আজকের অবস্থানে এসেছেন। তার লেখা ’কূটনীতির অন্দরমহল’ কূটনৈতিক সাংবাদিকতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বই। মতিউর রহমান চৌধুরী ও মানবজমিন নিয়ে আলোচনা সমালোচনা আছে, থাকবে। এরশাদ-বিচারক টেলিফোন কথোপকথন ‘ক্যাসেট’ মামলার আসামি হয়েছেন। খালেদা জিয়ার সময় জেলে গেছেন। সবই সাংবাদিকতার কারণে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা।
এবার তার নামে মামলা হয়েছে পাপিয়াকাণ্ডের সংবাদ প্রকাশের কারণে। পাপিয়া গ্রেপ্তারের পর বিস্ময়কর সব অপকর্মের সংবাদ সামনে আসে। যুব মহিলা লীগ তাকে বহিষ্কার করে। পাপিয়ার অর্থবিত্ত ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষক কারা, কারা যেতেন পাপিয়ার ফ্ল্যাটে, ভাড়া করা পাঁচতারকা হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের নামসহ সংবাদ ভাইরাল হয়। মানুষের মুখরোচক আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়।
দৈনিক মানবজমিন ‘আমলা এমপি ব্যবসায়ীসহ ৩০ জনের নাম’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। আওয়ামী লীগ নেতা ও সরকারের মন্ত্রীরাও বলেন, খতিয়ে দেখা হচ্ছে পাপিয়ার ফ্ল্যাট-স্যুটে কারা যেতেন, কারা তার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তদন্তে যদি কারো নাম আসে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নেতা-মন্ত্রীরা যা বলেছেন মানবজমিনের সংবাদে তার চেয়ে বেশি কিছু লেখা হয়নি। সরাসরি বা আকারে ইঙ্গিতে সুনির্দিষ্ট করে কারো নাম প্রকাশ করেনি মানবজমিন। একই রকমের সংবাদ প্রকাশ করে দেশের প্রায় সকল গণমাধ্যম।
মানবজমিনের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানহানির মামলা করেছেন সাইফুজ্জামান শিখর এমপি। পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের কারণে সম্মানহানি হলে তিনি বা যে কেউ প্রতিকার চাইতে মামলা করতেই পারেন। যদিও মামলার আগে প্রেস কাউন্সিলে যাওয়া যুক্তিযুক্ত। বাংলাদেশে যেহেতু যুক্তি ছাড়া বহুকিছু হয়, ফলে ধরে নিলাম সাইফুজ্জান শিখর এমপি মামলা করতে পারেন। কিন্তু, মানবজমিনের রিপোর্টে তার বা অন্য কারো নাম তো লেখা হয়নি।
প্রশ্ন হলো, তিনি কেন মনে করলেন যে তার কথা লেখা হয়েছে, তার মানহানি হয়েছে? কারণ হিসেবে বলেছেন, মানবজমিনের রিপোর্ট অনেকে ফেসবুকে শেয়ার দিয়েছেন। ফেসবুকের সেসব পোস্টে অনেকে সুনির্দিষ্ট করে অনেকের নাম লিখেছেন। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া নামের তালিকা মানবজমিনের রিপোর্টের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। এই দায় কার? মানবজমিনের? মতিউর রহমান চৌধুরীর? বাংলাদেশে ফেসবুক কি মানবজমিন বা মতিউর রহমান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়? ফেসবুকে কে, কি লিখবেন তার দায় মতিউর রহমান চৌধুরীকে নিতে হবে?
মতিউর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে করা এই মামলার তাৎপর্য কী?
অনেক ক্ষেত্রেই বড় বড় অন্যায়-অনিয়ম বা দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকে না। কিন্তু, বোঝা যায় যে অপকর্মটি সংগঠিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম পরিচয় উল্লেখ না করে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এখন নাম প্রকাশ না করলেও দুর্নীতি বা অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ক্ষমতাবান ব্যক্তি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করতে পারবেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করলেই যেহেতু গ্রেপ্তার করা যায়, সুতরাং গণমাধ্যমের জন্যে যে কোনো সংবাদ প্রকাশ করা দুরূহ হয়ে পড়বে।
মতিউর রহমান চৌধুরী এখনো গ্রেপ্তার হননি। সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু, সাংবাদিক কাজল নিখোঁজ হয়েছেন। এই মামলা দিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো বা ভয় দেখানোর চেষ্টা তা প্রায় সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। এধরণের মামলার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত করা গেলে, সেলফ সেন্সরশিপ তীব্রভাবে চেপে ধরবে গণমাধ্যমকে।
এখন বিপদ শুধু মানবজমিন বা সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর নয়, ভয়ঙ্কর সংকটের মুখে বাংলাদেশের গণমাধ্যম।
২. মধ্যরাতের কুড়িগ্রাম প্রসঙ্গ। প্রশাসনিক কর্তাদের রাগ-ক্ষোভের বড় একটি অংশ জুড়ে অবস্থান করেন সংবাদকর্মীরা। কুড়িগ্রামের সংবাদকর্মী আরিফুল ইসলাম সেই দলেরই একজন। গত দুই দিনে খোঁজ-খবর নিয়ে যা জানলাম, সৎ সাংবাদিক হিসেবে আরিফুল ইসলামের সুনাম আছে। তিনি ধূমপান করেন না। তাকে যখন অর্ধেক বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করা হয়, অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে আসে। যা শুধু প্রশ্নে সীমাবদ্ধ থাকে না বিস্ময়ও জাগে তখন, যখন দৃশ্যমান হয় মধ্যরাতে বাড়ি থেকে সাংবাদিককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। মধ্যরাতেই ভ্রাম্যমাণ আদালত মাদক রাখার অপরাধের দায়ে এক বছরের জেল দেয়।
এত তৎপর কুড়িগ্রামের প্রশাসন, ভ্রাম্যমাণ আদালত? মাঝরাতে অভিযান, মাঝরাতে আটক, মাঝরাতে জেল!
নেপথ্যের ঘটনা সামনে আসতে সময় নেয়নি। ডেপুটি কমিশনার সুলতানা পারভীন ক্ষিপ্ত ছিলেন আরিফুল ইসলামের উপর। কারণ জেলা প্রশাসনে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। তা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন আরিফুল ইসলাম। এতে নতুন করে ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ডেপুটি কমিশনার। পুরনো ক্ষিপ্ততা ছিল একটি পুকুরকে কেন্দ্র করে। পুকুরটি খনন করা হয়েছিল কাবিখার টাকায়। পুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ডেপুটি কমিশনার তার ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন ‘সুলতানা সরোবর’র সামনে। তখনই হইচই শুরু হয়, তিনি নিজের নামে পুকুরের নামকরণ করেছেন। সংবাদ প্রকাশ করেন আরিফুল ইসলাম। ফলে পুকুরটি আর নিজের নামে করতে পারেননি। নতুন-পুরনো ক্ষিপ্ততা মিলিয়ে প্রতিশোধের জন্যে বেছে নেন মাঝরাত।
মাঝরাতে অভিযান-আটক-আদালত-জেলের ঘটনায় গুরুতর কিছু অভিযোগ সামনে এসেছে। আরিফুলের স্ত্রী অভিযোগ করেছেন, তাকে আটকের সময়ই মারধর করা হয়েছে। পেটাতে পেটাতে জেলা প্রশাসনে নেওয়া হয়েছে। সেখানে বিবস্ত্র করে পেটানো হয়েছে। তারপর মাঝরাতে আদালত বসিয়ে জেল দেওয়া হয়েছে। ডেপুটি কমিশনার বলেছেন, তিনি এসবের কিছুই জানতেন না। তিনি সেদিন শহরে ছিলেন না। আটকের সময় আরিফুলের স্ত্রী যে আরডিসিকে চিনেছিলেন, তিনিও দাবি করছেন সেদিন কর্মক্ষেত্রে ছিলেন না। এ যেন সেই সুইডেন আসলামের কাহিনির মতো। সবকিছু ঠিক করে দিয়ে আসলাম সুইডেন চলে যাওয়ার পর দেশে হত্যাকাণ্ডটি সংগঠিত হতো। প্রমাণ হতো যে সুইডেন আসলাম দেশেই ছিলেন না।
ডেপুটি কমিশনারের অজান্তে জেলায় এমন হুলস্থূল কাণ্ড ঘটানো যে সম্ভব নয়, তা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধি না থাকলেও চলে।
৩. এখন সামনে এসেছে সেই মুখস্থ কথা ‘যদি তদন্তে...।
এসব তদন্ত সাধারণত যাদেরকে দিয়ে করানো হয়, তাদের সাধ্য থাকে না কিছু প্রমাণ করার। ঘাটতি থাকে আন্তরিকতাতেও। সাংবাদিকরা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটু বেশি হইচই হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হয় ‘বদলি’।
প্রতিমন্ত্রী ইতিমধ্যে কুড়িগ্রামের এই ডিসিকে প্রত্যাহারের ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিভাগীয় শাস্তির কথাও বলেছেন। সাধারণত ‘প্রত্যাহার’ এর পর ‘ওএসডি’সর্বোচ্চ শাস্তি হয়ে থাকে। কিছুদিন পর তাদের আবার পদন্নোতি হয়।
মামলা-পেটানো-জেল-নিখোঁজ, সাংবাদিক নিপীড়নের সকল ধারা সচল রেখে, মলম লাগানোর প্রক্রিয়াও চালু রাখা হয়েছে। যেমন ডিসি প্রত্যাহার। এতেই সাংবাদিকরা খুশি, অভিনন্দনের জোয়ার বইয়ে দেবেন।
সাংবাদিকদের বিশেষ করে নেতাগোছের সাংবাদিকদের প্রতিবাদের বিষয়টি বেশ চিত্তাকর্ষক।
একজন এসআই যখন একজন সাংবাদিককে পেটান বা নির্যাতন করেন, তখন তারা সুনির্দিষ্ট করে ঐ এসআইয়ের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লিখতে ও টেলিভিশনে বলতে শুরু করেন। বলেন, এসআই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করে সাংবাদিক নিপীড়ন করছেন। সরকার যে এসআইকে এমন নিপীড়নের ক্ষমতা দিয়ে ক্ষমতায়ন করেছে, সে বিষয়ে কিছু বলেন না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগই এমন, এসআই যা করছেন তা ‘অপপ্রয়োগ’ নয়-তা বলেন না। যেমন, এখন ডিসি সুলতানা পারভীনের বিচার-শাস্তি চাইছেন। যে ক্ষমতা দিয়ে সুলতানা পারভীনদের জবাবদিহিতাহীন প্রায় দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে কিছু বলেন না। সাংবাদিকদের সংগঠন একটি-দুটি মানববন্ধন ও বিবৃতি দিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমরা তো বিবৃতি দিয়েছি, প্রতিবাদ করেছি।’
সাংবাদিক নেতা ও বড় একটি অংশ যখন রাজনীতিক-নেতা-মন্ত্রী-আমলা, সরকারে ঘনিষ্ঠজনে পরিণত হন, তখন সাংবাদিকতার খুব বেশি কিছু অবশিষ্ট থাকে না। তখন যারা সাংবাদিকতা করতে চান, তাদের পরিণতি হয় কাজল বা আরিফুলের মতো। নাম না লিখলেও মানহানি হয়েছে ভেবে মামলা করা যায়। নিখোঁজ-পেটানো-জেল সবই দেওয়া যায়। ক্ষমতাবানরা জানেন, একটি বিবৃতি বা মানববন্ধন যারা করবেন, তারা প্রায় সবাই তাদের ঘনিষ্ঠজন।
এই ঘনিষ্ঠজনরা সর্বোচ্চ একটি বিবৃতি দিয়ে চুপ হয়ে যাবেন, একথা ক্ষমতাবানদের অজানা নয়।
s.mortoza@gmail.com
Comments