করোনাভাইরাসের সাক্ষাৎকার থেকে গোমূত্রের স্যানিটাইজার
করোনাভাইরাস কোন প্রাণী থেকে এসে মহামারি রূপ নিল, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গবেষণা করছে চীন, জাপান, আমেরিকা, ইউরোপ। করোনাভাইরাসবিষয়ক যত তথ্য সামনে আসছে, তা পূর্বের ভাইরাসগুলোর তথ্য বিবেচনায় নিয়ে অনুমানভিত্তিক। সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ এখনো পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। ফলে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোতে মৃত্যুহার প্রতিদিন বাড়ছে।
এই যখন সারা পৃথিবীর চিত্র, তখন ভারত ও বাংলাদেশে চমকপ্রদ কিছু ঘটনা দৃশ্যমান হচ্ছে। ঢাকার ফুটপাতে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক নামে হোমিওপ্যাথি ওষুধ বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের এ দৃশ্য আলোচিত হচ্ছে মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ভারতের ‘কাউপ্যাথি’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়িয়ে মূলধারার গণমাধ্যমেও স্থান করে নিয়েছে।
মাঝেমধ্যেই ভারতে গোমূত্র আসক্তির সংবাদ সামনে আসে।
১৩৩ কোটি মানুষের দেশে কট্টর হিন্দুত্ববাদী যেমন আছে, তেমনি প্রগতিশীল অগ্রসর মানুষের সংখ্যাও অনেক। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের কট্টরপন্থিরা রাজনীতির কারণে দেশে-বিদেশে সংবাদের শিরোনাম হয়ে আসছে।
এবার ভারতে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্তের পর গোমূত্র ও গোবর সংবাদে স্থান করে নিল। সারা শরীরে গোবর মাখতে শুরু করলেন কিছু সংখ্যক মানুষ। এতে নাকি করোনা থেকে মুক্তি মিলবে। গরুর মূত্র দিয়ে হাত-মুখ ধোওয়া, খাওয়া, গোসলের ধুম লেগে গেল ভারতের কিছু অঞ্চলে। সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়া ও স্যানিটাইজার ব্যবহারের বিজ্ঞানসম্মত প্রচারণা কাজে লাগিয়ে বোতলজাত গোমূত্রের স্যানিটাইজার ও গোমূত্রের প্যাকেটজাত সাবান বাজারে নিয়ে এলো কিছু প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী তা মানুষ লাইন ধরে কিনছে।
সমগ্র ভারতে হয়ত এদের সংখ্যা বেশি নয়। কিন্তু, সংবাদমাধ্যমে উঠে আসায় এরাই যেন ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছে। যে ইমেজ গণতন্ত্রমনা শিক্ষিত-সুস্থ চিন্তার ভারতবাসীর জন্যে অস্বস্তিকর।
মুরগির মাংসে করোনাভাইরাস, এই গুজবে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যের পোলট্রি শিল্প বিপদের মুখে পড়েছে। মুরগি বাদ গিয়ে সবাই পাঁঠা বা খাসির মাংস বা মাছ কিনছে। পাঁঠার মাংসের দাম বেড়েছে কেজিতে ১৫০ থেকে ২০০ রুপি। মাছের দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ রুপি।
অ্যালকোহল করোনাভাইরাস মেরে ফেলে, এই গুজবে বাজার রমরমা। যারা মদ পান করতেন তারা পানের পরিমাণ বাড়িয়েছেন। অনেকে আবার সারা শরীরে তেলের মতো অ্যালকোহল মাখতে শুরু করেছেন। এসব ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে।
পিছিয়ে নেই রাজনীতিকরাও।
‘গো করোনা গো’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগানে স্লোগানে করোনাভাইরাস তাড়ানোর ফর্মুলার আবিষ্কারক ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামদাশ অথাওয়ালা। গত ১১ মার্চ মুম্বাই গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ার সামনে চীনা কনসল জেনারেলকে সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করোনা তাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আরেকটি ভাইরাল ভিডিও যেখানে একদল নারী ভজনভঙ্গিতে গাইছেন ‘করোনা ভাগ যা, ভারত মে তেরা কেয়া কাম? করোনা ভাগ যা’।
বারানসিতে শিবলিঙ্গে মাস্ক পড়ানো নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটেছে। শিবলিঙ্গ ছোঁয়ার উপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
সফলভাবে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে কেরালা যতটা না আলোচনায় আসছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হাসি-রসিকতার বিষয় হয়ে আলোচনায় আসছে এসব উদ্ভট কর্মকাণ্ড।
করোনাভাইরাসের সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্যটি সম্ভবত বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দখলে। ইউটিউবের একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে একজন স্বপ্নে করোনাভাইরাসের সাক্ষাৎকারের তথ্য প্রচার করেছেন। তিনি বলেছেন, একজন ইতালি প্রবাসী স্বপ্নে করোনাভাইরাস দেখেছেন, করোনাভাইরাস দেখতে কদম ফুলের মতো। সেই প্রবাসী স্বপ্নে করোনাভাইরাসের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়ে এই প্রবাসী যাকে বলেছেন, তার কাছে এটা খুবই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। কারণ হিসেবে বলেছেন কেয়ামত যত ঘনিয়ে আসবে মমিনের স্বপ্ন ততই সত্য হতে থাকবে। মমিনের স্বপ্ন মিথ্যা হতে পারে না। প্রবাসীর স্বপ্নে দেখা করোনাভাইরাসের সাক্ষাৎকার বিষয়ে তিনি বলেছেন—
সেই প্রবাসী কদম ফুলের মতো করোনাভাইরাসকে স্বপ্নে দেখে প্রশ্ন করেছে, তোমরা পৃথিবীতে কখন এসেছো?
করোনাভাইরাস বলেছে, আমরা ২৩ অক্টোবর প্রথম চীনে এসেছি।
পৃথিবীতে এতো জায়গা থাকতে তোমরা চীনে কেন এসেছো?
করোনাভাইরাস বলেছে, চীন উইঘুর মুসলিমদের ভয়ঙ্কর নির্যাতন করছে। যা অন্যরা জানতে পারছে না। সে কারণে আমাদের চীনে পাঠানো হয়েছে।
চীন থেকে কোথায় যাবা?
প্রবাসীর এই প্রশ্নের উত্তরে ভাইরাস বলেছে, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায়। প্রথমে উত্তর আমেরিকায় ম্যাসাকার চালিয়ে, দক্ষিণ আমেরিকায় আক্রমণ শানাবো। তারপর ইরানে ম্যাসাকার চালাব। পৃথিবীর সাত ভাগের একভাগ মানুষ অর্থাৎ ১০০ কোটি মানুষ মেরে দেব। তবে সবচেয়ে বেশি মারব বৌদ্ধদের। তারা মুসলমানদের হত্যা করছে। তারপর ম্যাসাকার চালাব ইরানে। তারা কোরান বিকৃত করেছে।
করোনাভাইরাসের সাক্ষাৎকারের এমন আরও অনেককিছু বলেছেন।
করোনাভাইরাস মুসলমান নিধনকারী ইসরাইলে যাবে কিনা, সাক্ষাৎকার থেকে সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। সৌদি আরব কর্তৃক ইয়েমেনে মুসলমান হত্যা বিষয়ে করোনাভাইরাস কি ভাবছে, তাও জানা যায়নি।
লাখ লাখ মানুষ ইউটিউবে করোনাভাইরাসের এই সাক্ষাৎকার দেখছেন। কতজন বিশ্বাস করে দেখছেন, আর কতজন বিনোদনের অংশ হিসেবে দেখছেন— তা অজানা। ইউটিউবে করোনাভাইরাসবিষয়ক আরও অনেক ভিডিও আছে। কিছু ভিডিওতে বলা হয়েছে, কোনো মুসলমানকে করোনাভাইরাস ধরবে না। অন্য ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে করোনাভাইরাসে তারা মারা যাবে। ভয়াবহ রকমের ধর্ম-জাতি বিদ্বেষ ও ঘৃণার চর্চা চলছে।
করোনাভাইরাসে পৃথিবী বিপর্যস্ত। করোনাভাইরাস ধর্ম-জাতিগোষ্ঠী, সাদা-কালো কাউকেই চেনে না, চিনছে না। আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে বৌদ্ধ-খৃষ্টান-হিন্দু-মুসলিম সবাই। আজকের বিপদের এই দিনে কুসংস্কার আচ্ছন্ন হলে বা ঘৃণা ছড়ালে মানবজীবনে বিপদ শুধু বাড়বেই। এখন সময় একে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সচেতন হওয়ার।
s.mortoza@gmail.com
Comments