কথার প্রস্তুতিতে করুণা করবে না করোনা
বাংলাদেশের মানুষকে করুণা না করে করোনা চলে এলো। আতঙ্ক, হাসি-রসিকতা সঙ্গে নিয়ে সুদূর ইতালি থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে করোনাভাইরাস। চীন থেকে ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছিল করোনা। বাংলাদেশে আসবে কি না বা কবে নাগাদ আসবে, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। সবাইকে নিশ্চিত করে ভাইরাসটি বাংলাদেশে এসে গেছে।
করোনাভাইরাস বাংলাদেশে আসার আগে থেকেই ‘সতর্কতামূলক’ পরামর্শ দেওয়া হচ্ছিল। ডাক্তার-বিশেষজ্ঞ, নেতা-মন্ত্রী সবাই পরামর্শ দিচ্ছিলেন। রাজনৈতিক পরামর্শ বিশ্বাস বা আস্থায় নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি পরিলক্ষিত হলেও, ডাক্তারের পরামর্শে মানুষের অগাধ বিশ্বাস আছে। করোনাভাইরাস শনাক্তের কিছুক্ষণের মধ্যে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের মাধ্যমে ডাক্তার এবিএম আবদুল্লাহ যে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা শেয়ার হয়েছে এক লাখ ৭০ হাজার। এ থেকেই বোঝা যায় করোনাভাইরাস বিষয়ক পরামর্শ বিষয়ে মানুষের জানার আগ্রহ কতটা। বিশেষজ্ঞ-ডাক্তার-রাজনীতিবিদদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে যে সতর্কতামূলক পরামর্শ আসছে, তা মোটামুটি এমন:
যতটা সম্ভব গণপরিবহন এড়িয়ে চলুন, জনসমাগমে যাবেন না, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবেন, স্যানিটাইজার ব্যবহার করবেন ইত্যাদি। এই পরামর্শ কি দেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্যে, না ঢাকার দুই কোটি মানুষের জন্যে? নিশ্চয়ই সব মানুষের জন্যেই এই পরামর্শ। দেশের সব মানুষকে হিসাবের মধ্যে না এনে যদি শুধু রাজধানীর দুই কোটি মানুষ বিবেচনায় নিয়ে আলোচনা করি, পরামর্শগুলো কতটা কার্যকর? কতটা বাস্তবসম্মত? এসব পরামর্শের বাইরে সরকারের আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল কি না? সম্ভব ছিল কি না? প্রথমে পরামর্শ বিষয়ক পর্যালোচনা।
ক. ব্র্যাক’র গতবছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকা শহরের ৩৭ শতাংশ মানুষ ঠিকমতো পানি পেয়ে থাকেন। তার মানে ৬৩ শতাংশ মানুষ ঠিকমতো পানি পান না। টিআইবির এবছরের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ঢাকার ৪৫ শতাংশ মানুষ ঠিকমতো পানি পান না। সব হিসাব বাদ দিয়ে অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, ঢাকার কমপক্ষে ৩০ শতাংশ মানুষ সারাদিনে পানি পান না বা পেলেও সামান্য পরিমাণ পান। যারা পানিই পান না, তারা কী করে বারবার হাত ধোবেন? যারা রাস্তার পাশের ফুটপাতে থাকেন তাদের টয়লেট-পানি সম্পর্কে ধারণা আছে আমাদের? যারা গোসল-বাথরুমের জন্যে পানি পান না, তারা বারবার হাত ধোবেন তাও আবার সাবান দিয়ে!
খ. গণপরিবহন এড়িয়ে চলুন, মানে বাস-ট্রেন এড়িয়ে চলুন। তো বাস-ট্রেন এড়িয়ে মানুষ চলবেন কীসে? যারা বুদ্ধি-পরামর্শ দিচ্ছেন, তাদের সবার ব্যক্তিগত বা অফিসের গাড়ি আছে। ধারণা করে নেওয়া হচ্ছে ঢাকা শহরের সব মানুষের গাড়ি আছে বা গাড়ির সুবিধা আছে? হয়তো গণপরিবহন এড়িয়ে পায়ে হেঁটে চলাচলের কথা বোঝানো হয়েছে। মতিঝিল-শাহবাগ-ফার্মগেট-মহাখালী...ফুটপাতে কত মানুষের ঠেলাঠেলি, ধারণা আছে?
গ. বলা হচ্ছে জনসমাগম এড়িয়ে চলবেন। প্রয়োজন ছাড়া কাঁচাবাজার, সুপার স্টোর বা শপিং মলগুলোর ভিড় হয়তো এড়িয়ে চলা যায়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো সবচেয়ে বেশি জনসমাগমের অন্যতম স্থান। বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কেমন স্ববিরোধী পরামর্শ?
ঘ. বারবার হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। করোনা শনাক্তের একদিনের মধ্যে বাজার থেকে স্যানিটাইজার উধাও হয়ে গেছে। মুখোশ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়নি। নিজে থেকেই যে যতগুলো পেরেছে-পেয়েছে মুখোশও কিনে ফেলেছে। ফলে বাজারে স্যানিটাইজার-লিকুইড সাবান-মুখোশের সংকট দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, কত শতাংশ মানুষ এসব জিনিস ব্যবহার করেন বা করার সামর্থ্য রাখেন?
২. প্রশ্ন আসবে, সরকার মানুষকে সতর্ক করার জন্যে প্রয়োজনীয় এসব পরামর্শ দিয়েছে। এত মানুষের জন্যে এ ছাড়া আর কী করার ছিল? খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশে এত মানুষের জন্যে ইচ্ছে করলেই যেকোনো কিছু করে ফেলা যায় না। প্রশ্ন এখানেই, যা করা যায় বা যা করা সম্ভব ছিল, তা করা হয়েছে কি না? সরকার বলেছে, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছে গত বছর ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে। সেই হিসাবে ভাইরাসটি বাংলাদেশে আসতে সময় নিয়েছে প্রায় আড়াই মাস। ইতালি থেকে যে বিমানবন্দর দিয়ে ভাইরাসটি আসলো, সেই বিমানবন্দরের স্ক্যানিংয়ের অবস্থা এত দুর্বল কেন? আড়াই মাসে মানসম্পন্ন থার্মাল স্ক্যানারের ব্যবস্থা করা গেল না?
গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলো— ঢাকা বিমানবন্দেরের তিনটি থার্মাল স্ক্যানারের দুটিই নষ্ট। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, ‘করোনাভাইরাস প্রতিরোধের অংশ হিসেবে দেশে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দরে পাঁচটি নতুন স্ক্যানার মেশিন বসানো হবে।’ (প্রথম আলো, ৯ মার্চ ২০২০)।
নতুন থার্মাল স্ক্যানারের বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান আজ মঙ্গলবার সকালে বলেন, ‘আগের স্ক্যানারগুলোই তো নষ্ট। শাহজালাল বিমানবন্দরে তিনটি থার্মাল স্ক্যানার রয়েছে। এর মধ্যে দুটি নষ্ট।’ তিনি বলেন, ‘নতুন থার্মাল স্ক্যানার বসানোর কথা বলা হলেও আমরা সেগুলো পাইনি। তা ছাড়া সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের থার্মাল স্ক্যানারগুলো আগে থেকেই নষ্ট হয়ে আছে। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে।’ (প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০২০)।
দ্য ডেইলি স্টারের ১০ মার্চের সরেজমিন প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালনরত স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে কোনো কর্মকরতারই করোনাভাইরাস প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় পোশাক ও সরঞ্জাম নেই।
স্থল বন্দরগুলোর দিকে প্রায় কোনো নজরই দেওয়া হলো না।
বলা হচ্ছে, করোনা প্রতিরোধে ডাক্তার-বিশেজ্ঞদের নিয়ে ১০টি কমিটি করা হয়েছে। কমিটিতে থাকা ডাক্তারদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে বলেছেন, কমিটিতে থাকার বিষয়টি তিনি নিজেই জানেন না। করোনাভাইরাস পরীক্ষার উন্নতমানের পর্যাপ্তসংখ্যক কিট নেই। ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তার-নার্স-কর্মচারী কারোরই করোনাভাইরাস প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় পোশাক নেই। রাজশাহী, পাবনা-চট্টগ্রামের তিনটি সদর হাসপাতালের কয়েকজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পোশাক দূরের কথা, প্রশিক্ষণ বা নির্দেশনাও পাননি তারা। চট্টগ্রামের একজন ডাক্তার বলছিলেন, জ্বর নিয়ে একজন রোগী হাসপাতালে আসলেন। এটা কি সাধারণ জ্বর না করোনাভাইরাস, পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। আমার বা নার্সের বা কর্মচারীদের করোনাভাইরাস প্রতিরোধের পোশাক নেই।
৩. ১৬ কোটি মানুষের দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষাগার মাত্র একটি! ঢাকার আইইডিসিআর’র মতো আরও কিছু অস্থায়ী পরীক্ষাগার স্থাপন কি অসম্ভব ছিল? খুলনা বা যশোরে কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তাকে ঢাকায় এনে পরীক্ষা করতে হবে। তাকে আনা হবে বাসে বা ট্রেনে। এতে আরও কত মানুষের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। বিষয়গুলো নীতিনির্ধারক পর্যায়ে গুরুত্বই পায়নি।
৪. এ কথা জানাই ছিল যে, করোনাভাইরাস দেশের বাইরে থেকেই দেশে ঢুকতে পারে। কিন্তু প্রতিরোধে যা করা সম্ভব ছিল, দৃশ্যমান হচ্ছে তা করা হয়নি। এখন সতর্কতার জন্যে স্যানিটাইজার বা হাত ধোয়ার প্রচারণা চালানো খারাপ কিছু নয়। কিন্তু, রাস্তায় রাস্তায় পানি-সাবানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা অন্তত করা যেত। বাজার থেকে একদিনের মধ্যে স্যানিটাইজার উধাও হয়ে যাওয়ার পর ঘোষণা এসেছে, একজন একটির বেশি স্যানিটাইজার কিনতে পারবেন না। স্যানিটাইজার কেনার সামর্থ্য কতজনের আছে? যারা বাজার থেকে সব স্যানিটাইজার কিনে ফেলছেন, তারা কি ভাবছেন নিজেরা পরিচ্ছন্ন থাকলেই করোনামুক্ত থাকা যাবে? আপনার আশেপাশে যারা আছেন বা আপনার বাসার যে গৃহকর্মী বা গাড়ি চালক যদি পরিচ্ছন্ন না থাকেন? এককভাবে করোনাভাইরাসমুক্ত থাকার রোগ এটা নয়। আমরা ব্যক্তিগত বা জাতীয় কোনোভাবেই তা অনুধাবন করতে পারছি বলে মনে হয় না। ইতালির সেনাপ্রধান বা ইরানের এমপি এমনকী সর্বোচ্চ ক্ষমতার খামেনির উপদেষ্টাকে করোনা করুণা বা ভয় করেনি।
s.mortoza@gmail.com
Comments