ততদিন পর্যন্ত জেগে থাকবো আমরা
একটি ঘরে এমন কয়েকজন নারী বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করছেন, যাদের মধ্যে বয়সের, অর্থনৈতিক অবস্থার, কালচারের কোনো মিল নেই। এদের মধ্যে আছেন গৃহবধূ, বোরকা পরিহিত এসিড ভিকটিম, প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ মারাঠি নারী, ছাত্রী, করপোরেটে কাজ করা নারী ও বিত্তবান পরিবারের মাদকাসক্ত মেয়ে।
হঠাৎ দেখলে মনে হবে এই বিভিন্ন কালচারের মেয়েগুলো এখানে একসঙ্গে কী করছে? এদের তো একসঙ্গে থাকার কথা নয়। এরপর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, মেয়েগুলোর মধ্যে মিল একটাই— এরা প্রত্যেকেই ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।
এরা সবাই কথা বলছেন, তারা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জীবনের কাহিনী বলছেন। বর্ণনা করছেন কে, কতটা নৃশংসতার শিকার হয়েছেন। তারা তাদের অপরাধীদের পরিচয় দিচ্ছেন, তুলে ধরছেন সেইসব সত্য যা ঢাকা পড়ে গেছে। তারা বলছেন, নারীর পোশাক, বয়স, সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন সে ধর্ষণের শিকার হতে পারে। এমনকী, স্বামীও তাকে ধর্ষণ করতে পারে।
গল্পের শুরু থেকেই দরজায় কলিংবেলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। যা শুনে বোঝা যাচ্ছে নতুন কেউ এখানে ঢোকার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছেন। তারা টিভিতে খবর শুনে বুঝতে পারছেন তাদের এই জায়গায় আরও অনেক নারী, শিশু আসতেই থাকবে এই একই ঘটনার শিকার হয়ে এবং তখন এখানে স্থান সংকুলান হবে কীভাবে?
নারীদের এই যুক্তি শুনে মনে হচ্ছে যে তাদের এই ‘নিরাপদ স্বর্গে’ বা ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ (মৃত্যুর পরে তারা নিরাপদ) আর কারো জায়গা দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। তাতে করে প্রমাণিত হয় যে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ও হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ দেশে কতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যে ভিকটিমদের এখানে স্থান সংকুলান কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তারা চাইছেন না আর কোন নারী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে এখানে আসুক।
স্বভাবতই মনে প্রশ্ন আসবে, এটা কোন জায়গার কথা বলা হচ্ছে যেখানে নারীরা শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যে তারা কীভাবে যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে— তাই নিয়ে আলোচনা করছেন। আর কেনইবা করছেন? ‘দেবী’ নামের ১৩ মিনিটের এই শর্ট ফিল্মটি দেখলে আমাদের সব ধারণা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আর কষ্টে বুকটা ভরে যাবে।
ভারতীয় এই মুভিটিতে দেখিয়েছে দেশ, কাল, পাত্র, বয়স, সামাজিক অবস্থান সব ভেদেই যৌন নিপীড়নের শিকার নারী এই একঘরেই হয়ে থাকেন। পরিচালক দেখাতে চেয়েছেন নারী যেরকমই হোক না কেন, পুরুষের কাছে নারী শুধু যৌনতার শিকার। পরিচালক একদম শেষে এসে সমাজকে একটা ধাক্কা দিয়েছেন এভাবে যে অব্যাহত কলিং বেল বাজার পর ঐ ঘরের দরজা খুলে দেওয়ার পর দেখা গেল একটা শিশু এতক্ষণ দরজায় বেল বাজাচ্ছিল। শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়ে এখানে এসেছে ঠাঁই নেওয়ার জন্য।
‘দেবী’ সিনেমাটি দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। মনে হলো, আমি যেন আমার চারপাশের একটা ছবি দেখতে পারছি। এই যে আমরা গান গেয়ে, মিটিং-মিছিল করে, জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করি— এর ফলাফল কী? আমাদের অর্জন কতটুকু? অর্জন হলো এটাই যে বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ নারীবিদ্বেষী।
ইউএনডিপি প্রকাশিত নতুন এই সূচক বৈশ্বিকভাবে লিঙ্গসমতার প্রতি হতাশার চিত্র তুলে ধরেছে। ১০০টি দেশের উপর ‘সামাজিক লিঙ্গরীতি সূচকটি’ প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়েছে ৭৫টি দেশেই হতাশাজনক চিত্র মিলেছে। অর্ধেক পুরুষই রাজনৈতিক নেতৃত্বে নিজেকে সেরা বলে মনে করেন।
সংস্থাটির মানবাধিকার প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক বলেছেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বে আমাদের বসবাস। কিন্তু, এই প্রতিবেদনে নারীবিদ্বেষকে কিছু নম্বরের মাধ্যমে দেখাতে পেরেছি, যা মর্মাহত করেছে।’ তিনি বলেন, ‘এই প্রতিবেদন আপনারই আয়না।’ অধিকাংশ দেশেই নারীর পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। নারীর প্রতি পক্ষপাতে বিশ্ব পেছনেই হাঁটছে।
বিশ্ব পেছনে হাঁটছে কী হাঁটছে না, এত বড় আলোচনায় যদি নাও যাই, তাও স্পষ্ট চোখে দেখতে পারছি, আমার দেশে নারী ও মেয়েশিশুর অবস্থান সমাজে নাজুক থেকে নাজুকতর হচ্ছে। ‘দেবী’ সিনেমার সেই ঘরবন্দি মৃত নারী আত্মাগুলোতো আর কেউ নয় আমার মা, আমার বোন, আমার সন্তান।
মার্চের ৩ তারিখে মহিলা পরিষদ বলেছে, এই ফেব্রুয়ারি মাসেই ৩৩৭ জন নারী ও শিশু নিপীড়ন ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে। ১১৪ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এরমধ্যে ২৪ জন গ্যাং রেপের শিকার। নয়জনকে মেরে ফেলা হয়েছে ধর্ষণের পর, একজন নিজেই আত্মহত্যা করেছেন।
সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে এই ধর্ষণের শিকারদের মধ্যে ৭৪ জনই শিশু। ৪৩ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২২ জনকে এমনভাবে অত্যাচার করা হয়েছে যে, তারা যেন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। ভাবলেও হাত-পা কেঁপে ওঠে। যুগের পর যুগ নারী আন্দোলন করে আমরা কী পাচ্ছি? হয়তো বা কিছু নারী শিক্ষায়, চাকরিতে, বিমান চালনায়, জাহাজ চালনায়, কৃষিতে, গবেষণায়, খেলায়, পর্বতারোহণে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু, নারীর প্রতি সহিংসতা কি আমরা ঠেকাতে পারছি? কয়টি নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে বিচার পেয়েছেন? কতজন নারী নিহত হওয়ার পর অপরাধী ধরা পড়েছে?
কিছু ঘটনায় অপরাধী শাস্তি পেলেও অধিকাংশ ঘটনাই বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার শিকার। এসব মামলা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আলোর মুখ দেখে না। পাশবিকতার শিকার এসব নারী, শিশু সবাই দলবদ্ধভাবে জমা হতে থাকে ‘দেবী’ সিনেমার সেই ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’। মৃত্যুর পরই এরা আসলে নিরাপদ থাকে। প্রতিবছর এই সংখ্যা বাড়ছে। স্থান সংকুলান হচ্ছে না ঐ ঘরটিতে। সিনেমাটি ভারতের কিন্তু দৃশ্যপট আমাদের অতি চেনা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ অনুযায়ী প্রতি ১০ জনে ৯ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। সমীক্ষা চলাকালীন আগের একমাসে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ৮৯ শতাংশ অন্তত একবার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ৬ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল ৮২ দশমিক ৩ শতাংশ। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে শিশু তার বাবা মা, অভিভাবক ও লালন-পালনকারীদের হাতেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়।
আমাদের সমাজব্যবস্থা নারীর মনোজগতকে এমন করে কবজা করে রেখেছে যে নারী নিপীড়িত হওয়াটাকে মনে না নিলেও মেনে নিতে বাধ্য হয়। যেমন, আমাদের পোশাকশিল্পে কর্মরত নারীদের মধ্যে অধিকাংশই বুঝতে পারে না যে তারা কীভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। শুধু ধর্ষণ করাটাকেই তারা মনে করেন যৌন সহিংসতা। গায়ে হাত দেওয়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, বাজে কথা বলা, পর্নোছবি দেখানোকে তারা যৌন হয়রানি বলে মনে করেন না। ঠিক একইভাবে দেশের চারজন বিবাহিত নারীর একজন পাঁচটি কারণে স্বামীর হাতে মার খাওয়াকে যৌক্তিক মনে করেন। এই নারীদের বয়স ১৫ থেকে ৪৯ এর মধ্যে। তাদের প্রতি অত্যাচার এবং মগজ ধোলাই ঠিক কোন পর্যায়ে গেলে একজন নারী তুচ্ছ পাঁচটি কারণে স্বামীর হাতে মার খাওয়াটাকে যৌক্তিক বলে মনে করতে পারেন।
এই সমাজ ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নারীর প্রতি সহিংসতাসহ যেকোন ধরণের মর্যাদাহানিকর বিষয়কে এখনো শুধুমাত্র নারীর বিষয় বলে মনে করে বলেই, দেশে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা খুবই সাধারণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাই মাত্র ১ বছরে মানে জানুয়ারি ২০১৯-জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১,৫১১ জন নারী, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ২৪৭ জন নারীকে, যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২৭৪ জন নারী, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৩৫২, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৭ জনকে, আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন নারী, ধর্ষণের শিকার ৯১৯ শিশু, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২৩ শিশুকে, যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছে ৮৭ জন মেয়ে ও ছেলে শিশু, আত্মহত্যা করেছে ৯১ শিশু। বছরের পর বছর এই হিসাবগুলো শুধু সংখ্যাই থেকে যায়, বিচারের বাণী লুকিয়ে কাঁদে।
আমরা জানি না ধর্ষণ সংক্রান্ত আমাদের পেন্ডিং মামলা কতগুলো? নারী নির্যাতন ও সহিংসতার মামলা কতগুলো? মামলার ফাইল শুধু জমছে আর জমছে। ‘দেবী’ সিনেমার শেষে ওরা উল্লেখ করেছে যে দেশে নারীর পূজা করা হয়, নারীকে ‘দেবী’ মানা হয় সেই দেশে প্রায় ১ লাখ ধর্ষণ মামলা এখনো পেন্ডিং হয়ে আছে। আমাদের দেশেও দেখছি ধর্ষণ ও হত্যার যেসব কেস নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হইচই হচ্ছে, সেসব কেস ধীরে ধীরে এগুলোও, নিষ্পত্তি হচ্ছে কয়টা?
দিন দিন নারী ও শিশুর প্রতি নৃশংসতা যে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, তাতে করে আমাদের এই সমাজকে কি একটি সভ্য সমাজ বলা যায়? এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে আমরা যতোগুলোই পজিটিভ চেঞ্জ দেখাই না কেন, এই নির্যাতনের মাত্রা সব অর্জনকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেবে। অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেয়েও অনেক বেশি দরকার নারী ও শিশু এবং দেশের সব মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা। নতুবা সবই ব্যর্থ হয়ে যাবে।
আমার শিক্ষক গীতিয়ারা নাসরীনের একটি কথা দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই— নারী দিবস তো থাকবেই না একদিন। শুধু ঐতিহাসিক মাহাত্ম স্মরিত হবে। নারী বা কোন লিঙ্গভিত্তিক ভেদ অপ্রয়োজনীয় হবে। লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ও নির্যাতন অচেনা হবে। শুধু ভাবলেই যদি হতো, তবেই হয়েই যেত এতদিনে। শুধু স্বপ্ন দেখলেই যদি হতো, তবে এতদিনের স্বপ্নসমষ্টির ফল দেখা যেতো ৮ মার্চ ঘুম ভাঙলেই। ততদিন পর্যন্ত জেগে থাকবো আমরা।
শাহানা হুদা: যোগাযোগকর্মী
ranjana@manusher.org
Comments