‘সবচেয়ে সেরা অভিনয়টা এখনো করতে পারিনি’
নাট্যজন মামুনুর রশীদ এ দেশের মঞ্চ নাটককে সমৃদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার পরপরই তিনি মঞ্চ নাটক শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন আরণ্যক নাট্যদল। তার দলের নাটক নিয়ে বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর বহু দেশে গেছেন মামুনুর রশীদ। পাশাপাশি টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্রেও অভিনয় করে আসছেন দীর্ঘ দিন ধরে।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও পেয়েছেন একুশে পদক। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন দুই বার। এখনো তিনি অভিনয়, নাটক পরিচালনা ও নাটক লেখা— তিনটিই করে যাচ্ছেন। আজ ২৯ ফেব্রুয়ারি গুণী এই শিল্পীর জন্মদিন। বিশেষ এই দিনে ব্যক্তি ও অভিনয় জীবনের নানা বিষয় নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে মামুনুর রশীদের কথা হয়।
চার বছর পরপর আপনার জন্মদিন আসে, আপনার কাছে এই অনুভূতি কেমন?
এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করে। প্রতি বছর জন্মদিন হলে হয়তো এত উত্তেজনা-আনন্দ কাজ করতো না। চার বছর পরপর জন্মদিন আসে বলেই হয়তো উত্তেজনাটা একটু বেশিই কাজ করে। অনেক দিন অপেক্ষা করি, কবে আসবে আমার জন্মদিন। আসলে সময়ের তো বিভাজন হয় না। কোথাও রাত, কোথাও দিন। নানান দেশে নানা রকম। তারপরও বিষয়টি দীর্ঘ অপেক্ষার, তাই প্রবল আনন্দেরও।
মামুনুর রশীদের জন্মদিন উদযাপনে শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজন করা হয়েছে দ্রোহ দাহ স্বপ্নের নাট্য আয়োজন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এই আয়োজন চলবে আগামী ৩ মার্চ পর্যন্ত। তার লেখা পাঁচটি নাটক মঞ্চায়ন হবে সেখানে। থাকবে সেমিনার ও নৃত্যানুষ্ঠান। ভারত থেকে আসছেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র ও থিয়েটার সমালোচক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়।
অনেক বছর ধরে অভিনয় শিল্পের সঙ্গে জড়িত আপনি। এই সময়ে এসে চাওয়া কী?
আমার এখনো মনে হয়, সবচেয়ে ভালো নাটকটি নির্দেশনা দিতে পারিনি। সবচেয়ে ভালো নাটকটি লিখতে পারিনি। সবচেয়ে সেরা অভিনয়টা এখনো করতে পারিনি। সব শিল্পীরই একটা ড্রিম থাকে। আমারও আছে। সে রকম একটি কাজ করে যেতে চাই, যা কি-না মাইলস্টোন হয়ে থাকবে। অনেকেই আমাকে বলেন, সব কিছু করে ফেলেছি, সব কিছু পেয়ে গেছি। আমি বলি না। সব কিছু করতে পারিনি।
আজই মঞ্চে উঠবে আরণ্যকের নতুন নাটক ‘কহে ফেসবুক’। নাটকটি নিয়ে কী ভাবছেন?
এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। আমার জন্মদিনে এটি মঞ্চে আসছে। আরণ্যকের ৬২তম প্রযোজনা এটি। আমারই লেখা। নির্দেশনাও আমার। তবে আমি অভিনয় করছি না।
আপনাকে সবসময় দেখা যায় সমসাময়িক বিষয় নিয়ে নাটক লিখতে। আপনার নাটকে মাটির কথা, খুব সাধারণ মানুষদের কথা বেশি থাকে, এটা কেন?
আমি মনে করি, নাটক সব সময়ই সমসাময়িক। শেকসপিয়ার থেকে শুরু করে সব নাট্যকারই সমসাময়িক বিষয় নিয়ে নাটক লিখে গেছেন। মাটির কথা, সাধারণ মানুষদের কথা উঠে আসাটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার। মানবিক চেতনার জায়গা থেকে এসব নিয়ে লিখি। কোথায় আমার জন্ম, কোথায় বেড়ে ওঠা, এসব লিখে আনন্দ পাই। মাটির কথা না লিখলে কার কথা লিখব?
কোনো অপূর্ণতা আছে কি আপনার শিল্পী জীবনে?
অসংখ্য অপূর্ণতা আছে। আমাদের দিগন্তটা ছোট। জার্মানি, ইংল্যান্ডে থিয়েটারের দিগন্তটা অনেক বড়। আমাদেরটা যতটুকু আছে, সেটাকে আরও ছোট করা হয় এখানকার কিছু মানুষের জন্য। যারা কিনা মৌলবাদী। যারা আমাদের থিয়েটারকে, শিল্প-সাহিত্যকে ধ্বংস করতে চায়। তারা ধ্বংস করতে না চাইলে ছোট দিগন্ত নিয়েই আমরা আরও অনেক দূর যেতে পারতাম।
শিল্পী জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কোনটি?
মানুষের ভালোবাসা। এ দেশের মানুষতো বটেই, বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ যেখানেই আছেন, আমাকে অসম্ভব ভালোবাসেন। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও পেয়েছি। কিন্তু মানুষের ভালোবাসার মতো বড় পুরস্কার আমার জীবনে আর নেই।
আপনি অভিনেতা, নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, শিল্পের সঙ্গে আপনার বসবাস, শেষ ইচ্ছা কী?
কাজ করতে করতে মরতে চাই। মানুষের কথা বলতে চাই। থিয়েটার দিয়েও মানুষের কথা বলা যায়। নাটক হচ্ছে শ্রেণি সংগ্রামের হাতিয়ার। নাটকের মধ্যে দিয়ে মানুষের কথা বলতে বলতে আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাই।
এ দেশের মঞ্চ নাটক অনেক দূর এগিয়েছে, তারপরেও ঢাকা ও কলকাতার মঞ্চ নাটকের তুলনা করতে বললে কী বলবেন?
কোনো বাংলাকেই ছোট করতে চাই না। দুই বাংলার মঞ্চ নাটকই অনেক সমৃদ্ধ। আমাদের এখানে নাটক গড়ে উঠেছে, কিন্তু নাট্যসংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। ওদের ওখানে নাট্যসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
নাট্যকার হিসেবে আপনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কেন?
এটা ১৯৮২ সালের কথা। সে সময় শিশু একাডেমিতে শিশুদের ওপর গুলি চালানো হয়েছিল। এছাড়া টিভি নাটকে সেন্সর ছিল। এর প্রতিবাদে আমি বাংলা একাডেমির পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। এরপর আমিই প্রথম সেন্সরবিহীন নাটকের উৎসব শুরু করেছিলাম।
Comments