ঢাবির চাঁদাবাজ দুই শিক্ষার্থী: দায় কি এড়াতে পারেন উপাচার্য, শিক্ষকরা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। ঢাবির ইতিহাসে শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার নতুন কিছু নয়। অন্যায়-অন্যায্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গ্রেপ্তার হওয়ার বহু নজির আছে। কিন্তু এই দুজন শিক্ষার্থী অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হননি, গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্যায় করতে গিয়ে। গ্রেপ্তার হয়েছেন চাঁদাবাজি করার অভিযোগে সংবাদটি জানার পর থেকে কেমন যেন একটা বিষণ্ন বোধ তৈরি হয়েছে। এমন নয় যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এই প্রথম। তারপরও কেন যেন খারাপ লাগার অনুভূতি জাপটে ধরছে।
গতকাল দ্য ডেইলি স্টারের অনলাইনে প্রথমে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে। পদ-পদবি না থাকলেও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত অভিযুক্ত দুই শিক্ষার্থীর নাম, বিস্তারিত পরিচয়, ছবি সবই ছিল। কিন্তু তাদের নাম, ছবি না দিয়ে সংবাদটি প্রকাশ করা হয়েছে।
যদিও কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম নাম, পরিচয়, ছবিসহ সংবাদ প্রকাশ করেছে।
ভাবনায় আসছে অনেক কিছু। বাংলাদেশের আর দশটি সাধারণ পরিবারের মতো একটি পরিবার থেকেই হয়তো শিক্ষার্থী দুজন পড়তে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের নিয়ে বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজনের গর্বের শেষ নেই। তারা পড়ছেন, পাস করবেন, প্রতিষ্ঠিত হবেন। সন্তানের গর্বে বাবা-মা গৌরবান্বিত হবেন। ভাবনা বা স্বপ্ন তো এমনই ছিল! একাডেমিক রেজাল্ট বা গবেষণায় কিছু উদ্ভাবন করে তার সন্তান পত্রিকার শিরোনাম হবেন, বাবা-মায়ের খুশির অনুভূতি জানতে চাইবেন সংবাদকর্মীরা, হয়তো তারা এতদূর পর্যন্ত ভাবতে পারেননি। নিশ্চিত করেই বলা যায় এও ভাবেননি যে, তাদের সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে চাঁদাবাজি করবে, পুলিশের হাতে ধরা পড়বে, ছবিসহ সেই সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হবে!
এই দায় কার? কেন শিক্ষার্থীদ্বয়ের এমন পরিণতি?
প্রশ্নের উত্তরে হয়তো একযোগে সবাই বলে উঠবেন, তারা ছাত্রলীগ করেন। ছাত্রলীগের রাজনীতির কারণেই তারা চাঁদাবাজ হয়ে উঠেছেন। ছাত্রলীগ বলবে, তারা আমাদের দলের কেউ নয়। অথবা বলবে, ব্যক্তির অপরাধের দায় সংগঠন নেবে না। বাস্তবে মানুষের বিশ্বাস বা সিদ্ধান্তে কোনো পরিবর্তন আসবে না। কারণ মানুষের মনে এই বিশ্বাস ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভিত্তি পেয়েছে।
এর পরের প্রশ্ন দায় কি শুধুই ছাত্রলীগের?
যেদিন থেকে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়েছেন, সেদিন থেকে তাদের অভিভাবক শিক্ষকরা। বাবা-মায়ের অবর্তমানে শিক্ষকরা অভিভাবক হিসেবে সন্তানদের দেখে রাখার দায়িত্ব কতটা পালন করছেন? শিক্ষার্থীর চাঁদাবাজির দায় কি শিক্ষকদের ওপর পড়ে? উপাচার্যসহ প্রশাসন পরিচালনাকারী শিক্ষকরা কোনোভাবেই দায় নিতে রাজি হবেন না। আমরা চাঁদাবাজির শিক্ষা দেই না, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা, অপরাধ প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে ইত্যাদি যুক্তি দেবেন।
তারা কি আসলে দায়মুক্ত হতে পারেন? মূল দায় কি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাকারী উপাচার্য, প্রক্টর, শিক্ষকদের নয়? কেন এবং কীভাবে?
সুনির্দিষ্ট দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নাজেহাল করলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগের হল শাখার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনলেন ছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঠিক ও আন্তরিক তদন্তের উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের কার্যালয়ের গেটে তালা দিয়ে অবস্থান নিলেন। উপাচার্য ছাত্রলীগকে ডেকে আনলেন। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এসে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের কিল-ঘুষি-লাথি মারলেন। লাঠি দিয়ে পেটালেন। উপাচার্যকে পাহারা দিয়ে কার্যালয় থেকে বের করে নিয়ে গেলেন। পত্রিকায় ছবিসহ সংবাদ প্রকাশিত হলো, স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে ভিডিওচিত্র দেখানো হলো। কাউকে দায় নিতে হলো না, শাস্তি পেতে হলো না। উপাচার্য ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ জানালেন। এসব অসংখ্য অপকর্মের ছিটেফোঁটা চিত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতি আছে, শিক্ষকদের সমিতি আছে। শিক্ষার্থীদের প্রতি যেন তাদের কোনো দায় নেই। সন্ত্রাস-মাস্তানি-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে তাদের কোনো কথা বলতে শোনা যায় না, উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। হলগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ছাত্রলীগের হাতে। সেখানে শিক্ষক বা প্রশাসন শুধুই দর্শক। অথচ ‘গেস্টরুম’ কালচারে শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন চলছে বছরের পর বছর ধরে। শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করলেও শিক্ষকদের ঘুম বা নীরবতায় ব্যাঘাত ঘটে না। যার সরাসরি দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের দেখে রাখা, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে আরেক শিক্ষককে ঘুষি দিয়ে নাক ফাটিয়ে দেওয়ার। নূরদের নিয়মিত বিরতিতে পিটিয়ে রক্তাক্ত করলেও তদন্ত বা শাস্তি হয় না। যারা এতসব অপকর্ম করে রেহাই পেয়ে যান, তাদের কেউ কেউ চাঁদাবাজি করবেন, তা কী অস্বাভাবিক কিছু?
তাদের বিরুদ্ধে শুরুতেই ব্যবস্থা নেওয়া হলে হয়তো তারা চাঁদাবাজি পর্যন্ত পৌঁছাতেন না। তাহলে এই চাঁদাবাজির দায় কি উপাচার্য এড়াতে পারেন? শিক্ষক সমিতি বা শিক্ষক নেতারা এড়াতে পারেন? প্রক্টরিয়াল বডি এড়াতে পারেন?
অস্বীকার করা যাবে, আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি দেওয়া যাবে, দায়মুক্তি মিলবে না।
জাহাঙ্গীরনগরসহ প্রায় সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভিন্ন নয়। প্রচলিত একটি কথা আছে, এখনো সময় আছে সতর্ক হওয়ার। আসলেই কি তাই? সময় কি এখনো আছে, চলে গেছে, না চলে যাচ্ছে? শিক্ষক সমাজ কি নির্মোহভাবে প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করবেন?
s.mortoza@gmail.com
Comments