বিপজ্জনক রোহিঙ্গা ইস্যু যখন ‘স্বামী-স্ত্রী’র ঝগড়া
ইংরেজি ‘ডিপলোম্যাসি’ শব্দের বাংলা অর্থ করা হয়েছে ‘কূটনীতি’। ‘কূট’ বাংলা ভাষার একটি নেতিবাচক শব্দ। শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘অসত্য’ ‘মিথ্যা’ ‘জাল’ ‘জটিল’ ‘দুর্বোধ্য’ ‘প্যাঁচানো’। ‘কূট’র সঙ্গে ‘নীতি’ যোগ হয়ে যে ‘কূটনীতি’ তার অর্থ ‘অসত্য নীতি’? জাল, জটিল, দুর্বোধ্য বা প্যাঁচানো নীতি? কূটনীতিক বা কূটনৈতিক শব্দ দিয়েও আভিধানিক অর্থে সম্মানজনক কিছু বোঝায় না। কিন্তু, বাংলা ভাষায় শব্দগুলো বহুকাল ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে আভিধানিক অর্থ নয়, প্রচলিত রীতি বা নীতি অনুযায়ী শব্দের অর্থ ধরে নেওয়া হয়।
কূটনীতির সঙ্গে ‘কৌশল’ শব্দের একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। একে অপরের প্রতি ‘সৌজন্যবোধ’ দেখাবেন, সেখানে ‘কৌশল’ থাকতে পারে। কিন্তু, অসম্মানজনক কোনো শব্দ বা আচরণ থাকবে না।
যদিও পৃথিবীর শক্তিধর কোনো কোনো রাষ্ট্র দুর্বল রাষ্ট্রের কূটনীতিকদের সঙ্গে সব সময় যে সৌজন্য বজায় রেখে কথা বলেন, তা নয়। তবে বন্ধুত্ব বা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান দুটি দেশের ক্ষেত্রে যদি এমন কিছু ঘটে, সেটা হয়ে ওঠে আলোচনা-সমালোচনার বিষয়।
এত ভূমিকার অবতারণা, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য প্রসঙ্গে।
“চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার বিরোধ অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার মতো। আর কোনও দম্পতি যদি তৃতীয় পক্ষের কাছে যান, তাহলে তাদের সমস্যার সমাধান হয় না। (দ্য ডেইলি স্টার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)’’
এই মন্তব্যে পারস্পরিক ‘সৌজন্যবোধ’র প্রকাশ ঘটেছে কিনা? বাংলাদেশের জন্যে অত্যন্ত গুরুতর রোহিঙ্গা সমস্যাকে ‘স্বামী-স্ত্রী’র ঝগড়ার সঙ্গে মিলিয়ে হাস্য-রসিকতা করা যায় কিনা? অন্যদেশের একজন কূটনীতিক তা করতে পারেন কিনা?
চীনের রাষ্ট্রদূতের এই মন্তব্যে সাধারণের মাঝে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কিন্তু, কূটনৈতিক রীতি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। প্রশ্ন উঠেছে, প্রতিক্রিয়া না দেখানোর বিষয়টি নিয়েও।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ-মিয়ানমার উভয় দেশের ভালো সম্পর্ক। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চীন বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলবে, তেমন কিছু প্রত্যাশা করা হয়ত যৌক্তিক নয়। কিন্তু, ক্রমাগতভাবে চীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মিয়ানমারকে সহায়তা করবে কেন? জাতিগতভাবে রোহিঙ্গা নিধনকারী মিয়ানমার সরকারকে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাবে কেন? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, চীনের এমন অন্যায়-অনৈতিক কার্যক্রম বাংলাদেশ চুপ থেকে মেনে নিবে কেন?
চীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গিয়ে মিয়ানমারের পক্ষে ‘ভেটো’ ক্ষমতা প্রয়োগ করবে, আর বাংলাদেশ বলবে ‘চীন আমাদের পাশে আছে’। চীন এখন পর্যন্ত দুইবার নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে মিয়ানমারকে রক্ষা করেছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে একটি দ্বিপাক্ষিক সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করেছে। যে সম্মতিপত্রে মিয়ানমারের স্বার্থ দেখা হয়েছে, বাংলাদেশের নয়। মিয়ানমার গণহত্যা চালিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য করেছে। বহু বছর ধরে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে মিয়ানমার। ফেরত নেওয়ার সময় মিয়ানমার সিদ্ধান্ত নিবে, কে মিয়ানমারের নাগরিক কে নয়! সেখানে বাংলাদেশের কোনো মতামতের সুযোগ নেই। বলা হয়ে থাকে চীনের চাপে বাংলাদেশ এমন সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করেছে।
চীন সব সময় বাংলাদেশকে বলছে রোহিঙ্গা ইস্যু মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করতে। সন্দেহ নেই, সেটাই হতে পারতো সমাধানের সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় যে সমাধান সম্ভব নয়, সেটা বাংলাদেশ খুব ভালো করে জানে। চীনেরও তা অজানা নয়। ১৯৭৭-৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টা যে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে, তাতে তো চীনেরও সন্দেহ থাকার কোনো কারণ নেই। তারপরও চীন দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চায়। তৃতীয় কোনো পক্ষের সম্পৃক্ততা চায় না। কারণ তৃতীয় কোনো পক্ষের সম্পৃক্ততা আসলে, তারা হয়ত ন্যায্য কথা বলবে। যে ন্যায্য কথা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যাবে, চীন যা নিশ্চিত করে জানে।
সেই জানার অংশ হিসেবে বিষয়টিকে হালকা করে দেওয়ার জন্যে ‘স্বামী-স্ত্রী’র ঝগড়ার সঙ্গে তুলনা করছে।
বলছে, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার মধ্যে তৃতীয় পক্ষ এলে সমাধান হয় না। কিন্তু, বাস্তবতা হলো, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার এক পর্যায়েও তৃতীয় পক্ষের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সেটা প্রথমে কাছের এক বা একাধিক বন্ধু এগিয়ে আসেন। সমাধান না হলে, স্বামী বা স্ত্রী একজনকে বা উভয়কে আদালতে যেতে হয়। বাংলাদেশের কাছের বন্ধু চীন, ভারত, রাশিয়া সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসেনি। ভারত নীরব থেকে এবং চীন-রাশিয়া সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। এমন অবস্থার জন্যে বাংলাদেশের পরস্পর সাংঘর্ষিক ভুল নীতিও দায়ী। তবে বাংলাদেশ নেপথ্যে তৎপরতা চালিয়ে অসহায়ত্ব কিছুটা হলেও কাটাতে সক্ষম হয়েছে। ওআইসির মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যু আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে নিয়ে যেতে পারা বাংলাদেশের একটি বড় সাফল্য। এর মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে এই প্রথম আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারকে চাপে ফেলা গেছে।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের প্রথম আদেশ মিয়ানমারের বিপক্ষে গেছে। পরবর্তী আদেশগুলোও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যাবে, চীন তা ভালোমতো বুঝতে পারছে। মিয়ানমার বিচার আদালতের রায় বা আদেশ না মানলে বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে যাবে। মিয়ানমারকে বাঁচানোর জন্যে তখন ভেটো প্রয়োগ করতে হবে চীনকে। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক বেশি সমালোচনার মুখে পড়বে চীন। এই সমালোচনার মুখে চীন পড়তে চায় না। সেকারণে চীন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে সরিয়ে আনতে চায়।
বাংলাদেশ চীনের এই কৌশল কতটা বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবে বা পারছে, তার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। সেই বিচক্ষণতার প্রথম উদ্যোগ হিসেবে ‘স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া’ বিষয়ক মন্তব্যের কৌশলী কিন্তু কড়া প্রতিবাদ জরুরি ছিল। বহুবিধ কারণে রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক। তাছাড়া চীনের রাষ্ট্রদূত কূটনৈতিক শিষ্টাচার সম্পূর্ণরূপে লঙ্ঘন করেছেন। একজনের দেখাদেখি আরও অনেকে উৎসাহিত হতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারে সতর্কতা অপরিহার্য। নাগরিক সমাজসহ দেশের মানুষের সচেতনতা বা প্রতিক্রিয়াও দৃশ্যমান নয়। ভারত বিষয়ে যত সহজে বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়, চীনের গুরুতর বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানে তার ছিটেফোঁটাও লক্ষ্য করা যায় না।
s.mortoza@gmail.com
Comments