পরাক্রমশালী যখন প্রান্তিক হয়ে যায়
“আমার দাদা-দাদি হাসপাতালে কোনো বিছানা না পেয়ে করিডোরে পড়ে আছেন। দুজনেরই প্রচণ্ড জ্বর, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। মৃত্যুর মাত্র তিনঘণ্টা আগে দাদা একটি শয্যা পেয়েছিলেন। কিন্তু দাদি পাননি। তার শারীরিক অবস্থাও খুব খারাপ। এর মধ্যে আমিও আক্রান্ত হয়ে কোয়ারেন্টাইনে চলে এলাম।”
বিবিসি’র কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এভাবেই কথাগুলো বলেছেন একজন চীনা তরুণ। আরেকজন জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর তার মাকে স্থানীয় হাসপাতাল ভর্তি নেয়নি। কর্তৃপক্ষ বলেছে, তাদের হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আক্রান্ত ব্যক্তি না পরিবারে থাকতে পারছেন— না হাসপাতালে জায়গা মিলছে। এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত কোনো তথ্য গোপন করলে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছে চীন সরকার। বিপদের ওপর বিপদ চীনা জনগণের।
গার্ডিয়ান পত্রিকা লিখেছে, চীনের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার ও নার্স যারা কাজ করছেন, তারা সবাই পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে এসেছেন। রাত নেই-দিন নেই অক্লান্তভাবে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। সামাজিক মাধ্যমে ডাক্তার নার্সরা তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত স্বজনদের বিদায় জানাচ্ছেন।
সেদিন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিওতে দেখলাম, একজন নার্সকে তার শিশু সন্তান কাঁচের দেয়ালের ওপাশ থেকে চুমু ছুড়ে দিচ্ছেন, আর মা কাঁদছেন। এই দৃশ্য দেখে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। আপনি আপনার ভালোবাসার মানুষের কাছে যেতে পারছেন না, তার কপালে হাত রাখতে পারছেন না, সেবা দিতে পারছেন না— এমনকী ঘরেও জায়গা দিতে পারছেন না। শুধু দূর থেকে তার মৃত্যু দেখতে হচ্ছে।
আব্বার কাছে গল্প শুনেছি, তার শিশুকালে অর্থাৎ ৪০ এর দশকে যখন গ্রামে কলেরা দেখা দিত, তখন গ্রামের পর গ্রাম একদিনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। কোনো চিকিৎসাতো ছিলোই না, এমনকী মরদেহ সৎকারের জন্যও কোনো মানুষ পাওয়া যেত না। সে সময় চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত ছিলো না, যাতায়াত ব্যবস্থাও ছিলো খারাপ। কাজেই অসংখ্য মানুষের মৃত্যু অস্বাভাবিক কিছু ছিলো না। কিন্তু এসময় এসে একটি ভাইরাস চীনের মতো প্রভাবশালী একটি শক্তিকে প্রান্তিকতার মুখে ঠেলে দিয়েছে, তাই দেখে অবাক হচ্ছি।
এই রোগের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বিশ্বের ৬০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে। এমন কোনো ঘর থাকবে না যেখানে অন্তত একজন করোনা আক্রান্ত মানুষ পাওয়া যাবে না। হংকংয়ের শীর্ষস্থানীয় রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক গ্র্যাব্রিয়েল লিয়াং এই সতর্কবাণী দিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, চীনের বাইরে যে অল্পসংখ্যক মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা হয়তো কখনো চীনেই যাননি। তিনি মনে করেন, বিশ্বের এই ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ লোক হয়তো এখনই আক্রান্ত হবেন না, হবেন দফায় দফায়।
লিয়াং আরও মনে করেন, যদি চীনের গৃহীত ব্যবস্থা রোগ প্রতিরোধে কার্যকর হয়, তারপরও ভাবতে হবে কতদিন এটা কার্যকর থাকবে। কতদিন স্কুল বন্ধ থাকবে, কতদিন দোকানপাট বন্ধ থাকবে, কতদিন একটা পুরো শহর অবরুদ্ধ করে রাখা যাবে। সবাই চিন্তিত এই ভেবে যে, ভাইরাসটি ঠেকানো না গেলে কী হবে!
হঠাৎ করে বিশ্বে এমন একটি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলো যা অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বের সব মানুষকে বিশেষ করে নগরের মানুষগুলোকে আতঙ্কিত ও অস্থির করে তুলেছে। প্রবল প্রতাপশালী চীন দেশের এখনকার অবস্থা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের মতো হয়েছে। চীন দেশীয় পণ্য কিনতেও মানুষ দ্বন্দ্বে ভুগছেন। চীনের এই করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতির ওপর সাংঘাতিক রকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। সিঙ্গাপুরের মতো শক্তিশালী পাসপোর্টধারী মানুষদেরও বিভিন্ন দেশে প্রবেশের সময় পরীক্ষা করা হচ্ছে। ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেছে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোরও। ৩,৭১১ জন যাত্রী নিয়ে প্রভাবশালী দেশ জাপানের ক্রুজ শিপকে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হলো। যাত্রীদের মধ্যে ১৩৬ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। শিশু-বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সীদের নিয়ে জাহাজটি এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি করেছে। কোনো দেশই তাকে বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি। অবশেষে কম্বোডিয়া তার বন্দরে ভিড়তে দিয়েছে জাহাজটিকে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড সাগর উপকূলে চীন থেকে ভাঙার জন্য আনা এক জাহাজে তিন দিন আটকা পড়ে ছিলেন ১৭ চীনা নাবিক। করোনাভাইরাসের ভয়ে তাদের নামতে দেয়নি প্রশাসন। মানুষের ঘুরে বেড়ানোতেও ভাটা পড়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে বিমানের যে ক্রুরা চীনে গিয়েছিলেন, তাদের অন্য দেশগুলো ভিসা দিচ্ছে না।
বিপদে পড়লেই বোঝা যায় আসলে কেউ কারো নয়, করোনাভাইরাস আসার পর তা প্রকটভাবে বুঝতে পারলাম। আগে গুরুজনেরা বলতেন, ‘অসুখ-বিসুখ কারো আপন হয় না।’ অনেকদিন পর এই বাণীর একটা বাস্তবরূপ দেখলাম। এই ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর চীনে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনা নিয়ে আমাদের মধ্যে ব্যাপক মতদ্বৈধতা দেখা দিয়েছিলো। অনেকেই বলেছিলাম, বাচ্চাগুলোকে ফিরিয়ে আনা উচিত, অনেকেই এর বিপক্ষে ছিলাম। সরকার যখন তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলো, তখন আমরাই বলেছি— না, ভাইরাস আক্রান্ত এলাকা থেকে কাউকে দেশে ঢুকতে দেওয়া উচিত হবে না। তাহলে দেশেও এই রোগ ছড়িয়ে পড়বে। কারণ বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
ফেসবুকে দেখলাম উহানে অবস্থানরত একজন বাংলাদেশি ছাত্রী নিজেই বলেছেন, তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার দরকার নেই। তিনি চান না যে তাদের জন্য দেশের লোক বিপদে পড়ুক। দেশের জন্য মেয়েটির উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভালোবাসা দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। তাও বারবার মনে হচ্ছিলো আমার বাচ্চাটা যদি উহানে আটকা পড়তো, তখন আমি কী চাইতাম? জানি এখানে দুর্বল ব্যবস্থাপনা, তাও চাইতাম ঘরের বাচ্চা ঘরে ফিরে আসুক। বাস্তবতা বলে যে বাচ্চারা ওখানেই ভালো থাকবে। কিন্তু, মন বলে আমার সন্তান আমার কাছে ফিরে আসুক। করোনাভাইরাস আসার পর দেখলাম নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য মানুষ অস্থির হয়ে আছে।
কথাটি খুব সত্য যে, বাংলাদেশে কোনো ভাইরাসের আক্রমণ ঠেকানোর মতো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। নেই কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা। এ দেশের লোক, বিশেষ করে শহরের লোকজন পথেঘাটে এত থুতু ফেলে যে, রোগ ছড়াতে লাগবে মাত্র কিছু সময়। থুতু, ধুলাবালি, আবর্জনায় সয়লাব আমাদের দেশ, বিশেষ করে শহরগুলো। মানুষগুলোকে চীন থেকে নিয়ে এসে মশারি দিয়ে হাজি ক্যাম্পের মাটিতে ফেলে রেখেছি আমরা, এ-ও কী কম ভয়ের ব্যাপার?
চীনে কীভাবে করোনাভাইরাসের আগমণ ঘটলো সে নিয়ে চারিদিক থেকে নানা তথ্য কানে আসছে। কেউ বলছে চীনাদের সাপ, ব্যাঙ, বাদুর খাওয়ার কারণে এই রোগ ছড়িয়েছে। কেউ বলছে চীনের প্রবল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তিকে কোণঠাসা করার জন্য অন্য কোনো দেশ এই পরিকল্পনা করেছে। আবার কেউ কেউ ভাবছে চীন নিজেই এই ভাইরাস তৈরি করতে গিয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। যে কারণেই ভাইরাস ছড়াক না কেন, একটি কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, কেউ যখন বিপদে পড়ে, তখন সেই রাষ্ট্র বা ব্যক্তি যতোই শক্তিশালী হোক না কেন এক সময় সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। যেমনটা হয়েছে চীনের ক্ষেত্রে।
যে যতই নিজেকে ক্ষমতাধর ভাবুক না কেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে, যে কেউ একঘরে হয়ে যেতে পারে। আবারও প্রমাণিত হলো যে, প্রকৃতিই সবচেয়ে শক্তিশালী। মানুষ প্রকৃতির ওপর যত অত্যাচার করবে, প্রকৃতিও তত রুষ্ট হবে। অস্ট্রেলিয়া ও চীনসহ অন্যান্য দেশের ওপর পতিত এই দুর্যোগ এ কথাই প্রমাণ করে।
Comments