‘উন্নত’ দেশ ও কম ভোটতত্ত্ব: কল্পনা না বাস্তবতা

বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা এত ভালো, এত ভালো যে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, বাড়ছে মাথাপিছু আয়। শুধু ভালো আর ভালোর মাঝেই হঠাৎ করেই পৃথিবীর সেরা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বললেন, “দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না।”

বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা এত ভালো, এত ভালো যে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, বাড়ছে মাথাপিছু আয়। শুধু ভালো আর ভালোর মাঝেই হঠাৎ করেই পৃথিবীর সেরা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বললেন, “দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো না।”

হঠাৎ করে কী এমন ঘটে গেল যে, এত ভালো থেকে “ভালো না” হয়ে গেল?

এক বছর আগে পর্যন্ত নির্বাচন ছিল এদেশের মানুষের কাছে উৎসব। উৎসবের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, মৃত ভোটারও ভোট দিয়েছিলেন। মালয়েশিয়া প্রবাসী বগুড়ার ভোটার দেশে না ফিরেও ভোট দিয়েছিলেন, পোস্টাল বা অনলাইন ভোটের ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও। শতভাগ ভোটের পাশাপাশি, তালিকার চেয়ে বেশি ভোটারের ভোট দেওয়ার ঘটনাও দৃশ্যমান হয়েছিল।

কিন্তু, পহেলা ফেব্রুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট উৎসব দৃশ্যমান হয়নি। অত্যন্ত কম সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে এসেছেন। ভোটার উপস্থিতি কম যে এবারই প্রথম দৃশ্যমান হয়েছে, তা নয়। উপনির্বাচনগুলোতে মানুষ ভোট দিতে যায়নি। তখন বলা হয়েছে, বিএনপি অংশ নেয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় মানুষ ভোট দিতে আসেনি। বিএনপি অংশ নেওয়ায় এবারের সিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেমন যুক্তি দেওয়ার সুযোগ নেই।

তবে যুক্তি দেওয়া বন্ধ হয়নি।

“সিটি নির্বাচনে যারা ভোট দিতে আসেনি তাদের একটি বড় অংশ খুব আরাম আয়েশে আছে। বাসায় খুব আরামে বসে পোলাও খাচ্ছে” নির্বাচনের দিন হবিগঞ্জ সার্কিট হাউজে একথা বলেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

নির্বাচন কমিশন সচিব কম ভোটার উপস্থিত বিষয়ে বলেছেন, তিনদিন ছুটি ছিল। ভোটাররা ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত ছিল।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, এটাই ১০০ বছরের মধ্যে সেরা নির্বাচন।

ভোট কেন কম পড়ল, প্রথমাবস্থায় ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এটা গণতন্ত্রের জন্যে অশনি সংকেত। তারপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, উন্নত দেশে কত মানুষ ভোট দিতে আসেন? গণতন্ত্রের উদাহরণ আমেরিকা। সেখানে কত শতাংশ ভোট পড়ে? সেসব দেশের গণতন্ত্র কি ধ্বংস হয়ে গেছে?

ঢাকা উত্তরের আওয়ামী লীগের বিজয়ী মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, “দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ যে উন্নতির দিকে যাচ্ছে তার প্রমাণ ভোটার উপস্থিতি কম।”

এমন কথা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক, বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন।

সাধারণভাবে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, উন্নত দেশের মানুষ ভোট দিতে যায় না। উন্নত দেশের নির্বাচনে খুব কম ভোট পড়ে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হয়, উন্নত দেশের মানুষের কাজ ও জীবনযাপনের নিশ্চিত নিরাপত্তা থাকায় তারা নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করেন না। কোন দল ক্ষমতায় এলো, কে এমপি বা মেয়র সেসব সংবাদ রাখেন না বা রাখার প্রয়োজন মনে করেন না।

কথাটা যে পুরোপুরি অসত্য তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরগুলোর মেয়র নির্বাচনে ২০-২৫ শতাংশ ভোট পড়ার নজির রয়েছে। প্রশ্ন হলো, কম ভোট পড়ার এমন নজির সর্বজনীন কি না? পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর ভোটের চিত্র কেমন?

এশিয়ার সবচেয়ে ও পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশ জাপান। জাপানের রাজধানী টোকিওর ২০১৪ সালের মেয়র নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৪৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। এশিয়ার আরেক উন্নত দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের ২০১৮ সালের মেয়র নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

ইংল্যান্ডের ২০১৬ সালের সিটি নির্বাচনে চারটি শহরের চিত্র দেখে নেওয়া যাক। লন্ডনে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ব্রিস্টলে ২৪ শতাংশ, লিভারপুলে ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ, ম্যানসফিল্ডে ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ইউরোপের অন্যতম উন্নত দেশ জার্মানির ২০১৬ সালের বার্লিন ও মিউনিখের সিটি নির্বাচনে ভোট পড়েছিল যথাক্রমে ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ৪৪ দশমিক ০১ শতাংশ। ২০১৬ সালের রোমের সিটি নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫০ দশমিক ০১ শতাংশ। গত ৮ ফেব্রুয়ারি দিল্লির বিধান সভা নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৬২ দশমিক ০৫ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। উত্তর আমেরিকার আরেক উন্নত দেশ কানাডা। ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে কানাডার ৬৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। জার্মানি ও ফ্রান্সের ২০১৭ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট পড়েছিল যথাক্রমে ৭৬ দশমিক ০২ শতাংশ এবং ৬৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। নরওয়ের ২০১৭ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ৪৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল ২০১৯ সালের সুইজারল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচনে। ইংল্যান্ডের ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৬৭ দশমিক ৩০ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে জাপানের জাতীয় নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

সুতরাং বাংলাদেশ উন্নত হচ্ছে বা উন্নত হয়ে গেছে, এ কারণে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ভোট কম পড়েছে, কোনো বিবেচনায় কি এটা যুক্তি হতে পারে? যেসব উন্নত দেশের ভোটের চিত্র এখানে উল্লেখ করা হলো, সেসব দেশের মানুষের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৪০-৫০ হাজার ডলার কম। মাথাপিছু ৫০ হাজার ডলার আয়ের মানুষ ভোট দিতে যায়, আর বাংলাদেশের ২০০০ ডলার আয়ের মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায় না!

ঢাকার মানুষ যে ভোট দিতে গেল না, তার প্রকৃত কারণ যে ‘উন্নত’ হয়ে যাওয়া নয়, যুক্তি দিয়ে তা না বোঝালেও চলে। তিনদিনের ছুটি, ফেসবুক বা পোলাও-কোরমা খাওয়াও যে কারণ নয়, যারা এসব কথা বলছেন তারাও তা জানেন। আসলে প্রকৃত কারণ আড়াল করতে চাইলে এমন অনেক কথা সম্ভবত বলতে হয়।

নির্বাচন কমিশন ভোটের দিন গণপরিবহন বন্ধ করে দিল। মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলেরও অনুমোদন থাকল না। যিনি ভোটার হয়েছিলেন মোহাম্মদপুরে, বাসা বদল করে তিনি হয়ত চলে গেছেন উত্তরায়। তিনি উত্তরা থেকে মোহাম্মদপুরে কীভাবে আসবেন ভোট দিতে? বিষয়টি হয় নির্বাচন কমিশন বিবেচনায় নেয়নি, বা যাতে ভোট দিতে আসতে না পারেন তা বিবেচনায় নিয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভোটারদের উৎসাহিত করার পরিবর্তে নিরুৎসাহিত করার অভিযোগে নির্বাচন কমিশন শুরু থেকেই অভিযুক্ত ছিল।

ইভিএমে ভোট হলে রাতে ভোট বা কারচুপির সুযোগ থাকবে না, নির্বাচন কমিশনের এই যুক্তিতে মানুষের আস্থা ফিরে আসেনি। ইভিএমসহ সব যন্ত্রই মানুষ দ্বারা পরিচালিত। মানুষ যন্ত্র দ্বারা পরিচালিত নয়। মানুষের সন্দেহ ইভিএমের প্রতি ছিল না। সন্দেহ এবং অনাস্থা ছিল নির্বাচন কমিশনারদের প্রতি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ইভিএমে ফলাফল পরিবর্তন বা জালিয়াতি করা যায় না। ইভিএমে যেভাবে প্রোগ্রাম করা হবে মেশিন সেভাবে কাজ করবে। এবং যাদের নিয়ন্ত্রণে ইভিএম থাকবে, তারা প্রোগ্রাম পরিবর্তন করতে পারবেন। প্রযুক্তির এই যুগে এসব তথ্য কমবেশি সবাই জানেন।

অনাস্থা বা বিশ্বাসহীনতা নির্বাচন কমিশনের প্রতি হওয়ায়, ভোটের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারিয়েছেন। ইভিএমে না হয়ে নির্বাচন ব্যালটে হলেই যে নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ফিরে আসতো, বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন। বাস্তবের ঘটনা আর নির্বাচন কমিশনের অবস্থান বা বক্তব্যে কোনো মিল খুঁজে পাননি ভোটাররা। এই বিশ্বাসে তারা পৌঁছে গেছেন যে, তাদের ভোটের কোনো গুরুত্ব নেই।

নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ নেতারা অভিযোগ করতে শুরু করলেন যে, বিএনপি সারাদেশ থেকে সন্ত্রাসীদের ঢাকায় নিয়ে এসেছে। তারা ভোটকেন্দ্র দখল করার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগের অভিযোগের জবাবে বিএনপি নেতারা বললেন, আওয়ামী লীগ সারাদেশ থেকে সন্ত্রাসীদের ঢাকায় জড়ো করেছে। দুই দলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের সুযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলল, পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ বের হবেন না। বহিরাগতরা ঢাকা ছাড়ুন।

বাংলাদেশের মানুষ নিজ দেশের রাজধানী শহরে কেন ‘বহিরাগত’ হবেন? ‘পরিচয়পত্র’ সঙ্গে রাখার নির্দেশনা আসবে কেন? একটা আতঙ্ক ছড়ালো ভোটের আগের দিন। ভোটার কম উপস্থিতির এটাও একটি কারণ। নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এসব বক্তব্য বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে নীরবতা পালন করতে দেখা গেল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে এমন কথা বলানোর নির্দেশনা কী তাহলে নির্বাচন কমিশনই দিয়েছিল?

ভোটারদের আস্থা-বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, সরকারেরও। সেদিকে কারো নজর আছে বলে মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণের অভিযোগ আনা হয় নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে। নাগরিক সমাজ তো ভোটারদের ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করেননি। বিএনপিকে অভিযুক্ত করা হয়, তাদের ডাকে মানুষ রাস্তায় নামে না। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সম্মিলিত ডাকেও মানুষ ভোটকেন্দ্রে এলেন না। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা সত্যি-সত্যি জনগণ থেকে কতটা দূরে সরে গেছেন? রাজনীতিবিদদের আত্মোপলব্ধিতে কি আসছে বা আসবে বিষয়টি?

s.mortoza@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

Dubious cases weaken quest for justice

A man named Labhlu Mia was shot dead in the capital’s Uttara during protests on the morning of August 5.

57m ago