পুলিশকে পেটালে গ্রেপ্তার, সাংবাদিককে রক্তাক্ত করলেও মাফ!

edit-photo.jpg
রক্তাক্ত সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন ও জিসাদ ইকবাল। ছবি: সংগৃহীত

ক. গত ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন ৬ জন সাংবাদিককে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনের অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর। এর জন্যে কাউকে গ্রেপ্তার বা কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

খ. ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে অভিযোগ ওঠে পুলিশের একজন উপপরিদর্শককে মারধর করেছেন নবনির্বাচিত একজন কাউন্সিলর। ৫ ফেব্রুয়ারি অভিযুক্ত কাউন্সিলর শাখাওয়াতসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা এখন কারাগারে।

গ. ৬ জন সাংবাদিককে মারধর করে আহত করার জন্যে কাউকে গ্রেপ্তার করা না হলেও, একজন পুলিশ সদস্যকে মারধর করার অভিযোগে ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

একটি গল্প স্মরণ করি ব্রিটিশ শাসনকালের। সহায়তা নেই প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর। তার লেখা ‘পাদটীকা’ গল্পের ঘটনাটি এমন।

স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন লাট সাহেব। সঙ্গে ছিলো ট্রেনের নিচে একটি পা কাটা যাওয়া, লাট সাহেবের তিন ঠ্যাঙওয়ালা একটি কুকুর। যে কুকুরের জন্যে মাসে বরাদ্দ ৭৫ টাকা। লাট সাহেব চলে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের পণ্ডিত মশাই বললেন, “অপিচ আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, তবে বুজি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?

১. তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মাথার আঘাত গুরুতর। ডাক্তার টেলিফোনে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। বলছি সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান সুমনের কথা।

গত ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন রায়ের বাজার সাদেক খান রোড এলাকায়। সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন নিজের মুখে দানবীয় সেই নিপীড়নেই বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-

“ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী যিনি ছিলেন তার সমর্থকরা অস্ত্র নিয়ে মিছিল করছিলো। আমি মিছিলের ছবি তুলি। ভিডিও করি। সেসময় তারা আমার মোবাইল ফোন কেড়ে নিতে চায়। আমি ফোন নিয়ে সরে যেতে চাইলে তারা দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আমাকে কোপ দেয়। প্রথম কোপটা লাগে নাই, পরের কোপটাও লাগে নাই।

যাদের হাতে হকিস্টিক ছিলো তারা আমাকে হকিস্টিক দিয়ে পেটাতে থাকে। হকিস্টিকের আঘাত মাথায় লাগে। মাথা ফেটে রক্ত পড়তে থাকে। সংখ্যায় তারা বিশ পঁচিশজন হবে, আমাকে রাস্তায় ফেলে পেটাতে থাকে। লাথি, কিল-ঘুষি মারে। আমি চিৎকার করছিলাম, কেউ এগিয়ে আসেনি।

পুলিশ আশ-পাশেই ছিলো। দশ বারো গজের মধ্যেই পুলিশের গাড়ি দেখেছি। আমার ওপর হামলার দুএক মিনিট আগেও আমার সামনে-পিছনে পুলিশ দেখেছি। দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমের সাংবাদিকরাও ছিলেন। এর আগে, সেই এলাকায় একটা ঝামেলা হয়েছিলো। সেই কারণে সাংবাদিকরা সেখানে এসেছিলেন।

আমি ভিডিও করেছি কেনো? সেই অপরাধে সন্ত্রাসীরা আমাকে মেরেছে। যারা মেরেছে তাদের বয়স ১৮ থেকে ২০ বছর মধ্যে। তারা ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর ক্যাডার ছিলো।”

২. এখানে গুরুতর অভিযোগ দুটি।

এক. একদল সন্ত্রাসী আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে মিছিল করছিল।

দুই. সেই দৃশ্য ভিডিও করায় এবং ছবি তোলার কারণে সাংবাদিক সুমনকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছিল।

অস্ত্র নিয়ে মিছিল করার কারণেই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অস্ত্রসহ সন্ত্রাসীদের ছবি তোলায় সন্ত্রাসীরা সাংবাদিক সুমনকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে। এক্ষেত্রেও পুলিশ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, সুমনকে রক্ষা করেনি বা রক্ষার চেষ্টাও করেনি।

পুলিশের বড়কর্তারা কী পুলিশের বিরুদ্ধে আসা এমন গুরুতর অভিযোগ তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছেন? আমাদের জানা মতে নেননি। উদ্যোগ কী নিবেন? বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এই প্রশ্নের উত্তর জানার অধিকার কী আমাদের নেই?

অভিযোগে বলা হয়েছে, অস্ত্রধারী এই সন্ত্রাসীরা কাউন্সিলর প্রার্থী মোহাম্মদ হোসেন খোকনের বাহিনী। এটা কী শুধুই অভিযোগ, না সত্যতা আছে? পুলিশ কী তদন্ত করেছে? আমাদের জানামতে করেনি। কেন করেনি?

৩. একটি বিষয় বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত সত্যে পরিণত হয়েছে যে, সাংবাদিকদের পেটালে-পিটিয়ে গুরুতর আহত করলে, এমনকী হত্যা করলেও তদন্ত বা বিচার হয় না। স্কুল শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ‘হেলমেট বাহিনী’ সাংবাদিকদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিল। গণমাধ্যম ছবিসহ হেলমেট বাহিনীর পরিচয় প্রকাশ করেছিল। তাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

একটি বা দুটি নয়, কমপক্ষে এক ডজন সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দিয়ে দেখানো যায়। সাংবাদিকদের সংগঠন ও নেতারা সাংবাদিকতা নয়, রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে পরিচিত। সাংবাদিকদের স্বার্থের চেয়ে রাজনৈতিক দলের স্বার্থ তাদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়। এতে সাংবাদিক নেতাদের লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকলেও, সাংবাদিকদের স্বার্থ দুস্থভাতার মধ্যে সীমিত থাকে। সুমনসহ ৬ জন সাংবাদিক আহত হওয়ার পর সাংবাদিক সংগঠন বা নেতাদের সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। কেউ কেউ মৃদুস্বরে কথা বলেছেন। কোনো কোনো সংগঠন দুএকটি মানববন্ধন করেছে। তারা সবাই একটি ‘বায়বীয় শক্তি’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছে। অথচ হামলাকারী সন্ত্রাসীদের পরিচয় গোপনীয় বা অজানা নয়।

কেউ কেউ এমন প্রশ্নও সামনে এনেছেন যে, মোস্তাফিজুর রহমান সুমন কম পরিচিত ‘আগামী নিউজ’ অনলাইনের সাংবাদিক। ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সুমনের ‘সাংবাদিক পরিচয়পত্র’ ছিল কী না? বিষয়টি যেন এমন যে, সাংবাদিকের সঙ্গে সাংবাদিক পরিচয়পত্র না থাকলে তাকে পেটানো যাবে!

৪. সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশনের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ের মত এক্ষেত্রেও নীরব-উদাসীন থেকেছে। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম মানদণ্ডে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা ‘আংশিক স্বাধীন’। সাংবাদিকের নিরাপত্তা ইস্যুতে সেই ‘আংশিক’ যে শূন্যতে পরিণত হচ্ছে, তা অনুধাবন করছেন শুধু তারা, যারা সত্যি সত্যি সাংবাদিকতা করতে চাইছেন। সাংবাদিক নেতাদের তা বোঝার বা অনুধাবন করার কথা নয়।

Comments

The Daily Star  | English

Firefighter dies after being hit by truck while battling Secretariat fire

Another firefighter sustained injuries in his leg while working to extinguish the fire

1h ago